আমাদের ছোট নদী, চলে বাকে বাকে/ বৈশাখ মাসে তার হাঁটুজল থাকে/ পার হয়ে যায় গরু, পার হয় গাড়ি/ দুই ধার উঁচু তার ঢালু তার পাড়ি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আমাদের ছোট নদী’ কবিতার মতোই এখন হাঁটু পানি গোবিন্দগঞ্জের করতোয়া-কাটাখালী নদীতে। নদী দিয়ে অনায়াসে পার হচ্ছে মোটরসাইকেল। অনেকে ভ্যানে কিংবা হেঁটেই নদী পার হচ্ছেন। শুধু তাই নয়, নদীটির বহু জায়গা শুকিয়ে এখন পরিণত হয়েছে ফসলের মাঠে। অনেক জায়গা এখন পানিশূন্য ধু-ধু বালুচর। কিন্তু একসময় নদীটির অবস্থা এমন ছিল না। এ নদীতে বড় বড় পাল তোলা নৌকা, লঞ্চ, স্টিমার চলত। এ নদী পথেই গোবিন্দগঞ্জের সঙ্গে উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন এলাকার বাণিজ্যিক যোগাযোগ গড়ে উঠেছিল। শুকনো মৌসুমে এই করতোয়া নদীর পানিতে কাটাবাড়ী, শাখাহার, হরিরামপুর, নাকাই, রাখালবুরুজসহ সাতটি ইউনিয়নে সেচ দিয়ে গম, বোরো ধানসহ বিভিন্ন ফসলের উৎপাদন করা হতো। নদীতে ছিল প্রচুর দেশি প্রজাতির মাছ।
বর্তমানে দখল, আর পলি জমে চর জেগে ওঠায় পানি ধারণক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে করতোয়া-কাটাখালী নদী। নদীতে জেগে ওঠা শত শত একর চরের জমিতে চাষ হচ্ছে বিভিন্ন ফসল। এছাড়া গোবিন্দগঞ্জের খলসী এলাকায় পানি উন্নয়ন বোর্ড একটি স্লুইসগেট নির্মাণ করায় নদীর আদিগতিপথ বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে নদীর গোবিন্দগঞ্জ সীমানা থেকে বগুড়ার সীমানা পর্যন্ত নদীর উল্লেখযোগ্য অংশ দখলদাররা দখল করে ইটভাটা, রাস্তা, বাড়িঘর, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছে প্রভাবশালীরা, এ তালিকায় বিভিন্ন শ্রেণির মানুষও রয়েছে। কোথাও কোথাও নদীর তীর কেটে, আবার কোথাও নদী থেকে বালু উত্তোলন করে নিয়ে যাচ্ছে মাটি-বালুখেকোরা। নদীর কোথাও খাল, কোথাও নালা এবং কোথাও ফসলের মাঠে পরিণত হয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডসহ প্রশাসনের কর্মকর্তারাও এ ব্যাপারে নির্বিকার। এতে মরে যাচ্ছে নদী, বিপন্ন হচ্ছে জীববৈচিত্র্য, সেচের পানির অভাব দেখা যাচ্ছে। থাকছে না মাছের অভয়ারণ্য। বেকার হয়ে পড়েছে নদী তীরবর্তী জেলে পরিবার।
নদী পাড়ের কৃষক বার্ণা গ্রামের জায়েদ আলী ও ঘোড়ামারা গ্রামের ধলু মিয়া জানায়, তারা একসময় এ নদীর পানি ফসলের খেতে সেচ দিত। এখন সে অবস্থা আর নেই। বার্ণা গ্রামের কলেজ ও স্কুলপড়ুয়া সাবু, তোফায়েল, বুলবুল জানায়, আগে নদীতে যখন পানি থাকত, দুপুর হলেই আমরা বন্ধুরা মিলে নদীতে গোসল করতাম, সাঁতার কাটতাম, মাছ ধরতাম। চৈত্র মাসে নদীতে মাছ ধরার ‘বৈত’ উৎসব হতো। এখন নদী ধু-ধু বালুচর, পানি নেই। বৈতও আর হয় না।
রাখাল বুরুজ গ্রামের মোন্তাজ মিয়া, ফতেউল্লাপুর গ্রামের স্বপনবাবুসহ অন্য জেলেরা জানান, সারা বছর মাছ ধরে বাজারে বিক্রি করে তারা জীবিকা নির্বাহ করতেন। কিন্তু এখন নদীতে পানিই নেই, মাছ পাব কোত্থেকে। নদীর যেখানে অল্প পানি, সেখানে প্রভাবশালীরা দখল করে মাছ চাষ করছে। বহু জেলে তাদের পৈতৃক পেশা ছেড়ে দিতে বাধ্য হচ্ছেন।
এ ব্যাপারে গোবিন্দগঞ্জ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবদুল লতিফ প্রধান বলেন, বছরের পর বছর এই করতোয়া নদীতে পলি জমে নদীর বিভিন্ন অংশে চর জেগে উঠেছে। এছাড়া চৈত্র-বৈশাখ মাসের শুষ্ক মৌসুমে এ এলাকার ভূগর্ভস্থ পানির স্তর অনেক নিচে নেমে যাওয়ায় নদীতে পানি থাকছে না। তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নদী জরিপ ও খননের উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। প্রথমে বড় বড় নদীগুলো খনন করা হবে। পরবর্তী সময়ে অন্যান্য নদীও খনন করে নদীপথ স্বাভাবিকসহ নদীর দুই পারের ফসলি জমিতে সেচের ব্যবস্থা করা হবে। এই খননের অংশ হিসেবে করতোয়া নদীর অবৈধ দখলদার উচ্ছেদ করে খননের প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে।