গ্যাসের দাম বাড়ায় বেড়ে গেছে জ্বালানি কাঠের চাহিদাও। এতে প্রতিদিন বরগুনা থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে অন্তত দশ হাজার মণ কাঠ যাচ্ছে। ফলে নির্বিচারে গাছ কাটা হচ্ছে; উজাড় হচ্ছে বন। এতে পরিবেশবাদীরা গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
বরগুনা-বাকেরগঞ্জ সড়ক ঘুরে সরেজমিনে দেখা গেছে, গ্রাম থেকে নির্বিচারে বিভিন্ন আকৃতির গাছ কেটে সড়কের পাশে বিভিন্ন স্থানে জড়ো করে রাখা হয়েছে। কিছুক্ষণ পর পর সেই গাছ ট্রাকে তুলে দিচ্ছেন শ্রমিকরা; গাছগুলো নিয়ে যাওয়া হচ্ছে দেশের বিভিন্ন স্থানে।
স্থানীয়রা জানান, গ্রাম থেকে গাছ কেটে এনে জড়ো করা হচ্ছে জেলার বিভিন্ন সড়কের দুই শতাধিক স্থানে। পাইকারদের মাধ্যমে এ গাছ সংগ্রহ করেন কাঠ ব্যবসায়ীরা। জেলার ছয় উপজেলা থেকে প্রতিদিন অন্তত ২০টি ট্রাকে করে এসব গাছ যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন স্থানে।
গাছ কেটে বন উজাড়ের কারণ
যেকোনো উন্নয়নমূলক কাজে তথা রাস্তাঘাট ও কলকারখানা নির্মাণ এবং জ্বালানির চাহিদা পূরণে প্রকৃতি ও পরিবেশের ক্ষতি করে কাটা হয় বনের গাছ।
বেতাগীতে গলাচিপা এলাকার কাঠ ব্যবসায়ী সোহরাব হোসেন বলেন, ‘গ্রাম থেকে পাইকারের মাধ্যমে আমরা গাছ কিনে থাকি। সেসব গাছ সড়কের পাশে এনে রাখা হয়। পরে ট্রাকে করে বিভিন্ন জেলায় পাঠাই।’
আবুল নামে গৌরীচন্না এলাকার গাছের পাইকার আবুল বলেন, গ্রামে ঘুরে ঘুরে আমরা গাছ কিনি। দাম কম এবং চাহিদা বেশি থাকায় সাধারণত কম বয়সী গাছ কিনে থাকি। মাসখানেক ধরে কাঠের চাহিদা খুব বেড়েছে। এ কারণে বেশ লাভবান হচ্ছি আমরা।’
হোসেন নামে এক ট্রাকচালক বলেন, ‘পটুয়াখালী থেকে কাঠ নিতে আমি ট্রাক নিয়ে বরগুনা এসেছি। এখান থেকে কাঠ নিয়ে রাজবাড়ী যাবো। জ্বালানি কাঠ পরিবহনের জন্য আমার ট্রাক ভাড়া করা হয়েছে। এতে ২৭ টনের মতো কাঠ ধরবে।’
গ্যাসের দাম বাড়ায় জ্বালানি কাঠের চাহিদাও বেড়েছে
বরগুনার টাউন হল এলাকার এক কাঠ ব্যবসায়ী বলেন, গ্যাসের দাম বাড়ার পর কাঠের চাহিদা অনেক বেড়েছে। প্রতিদিন বরগুনা থেকে অন্তত ১২ ট্রাক কাঠ চালান করা হচ্ছে।
এ বিষয়ে গ্লোবাল ল’ থিংকার্স সোসাইটির চিফ অপারেটিং অফিসার অ্যাডভোকেট মাহিন মেহরাব অনিক বলেন, গাছ কাটায যেমন এক ধরনের ক্ষতি, ঠিক তেমনি কাঠ পোড়ানোও ক্ষতি। এতে কার্বন-ডাই অক্সাইড বাড়ছে; ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ওজন স্তর। তাই গাছ কাটার পাশাপাশি কাঠ পোড়ানো বন্ধ করা না গেলে পরিবেশে বিপর্যয় নেমে আসবে।
এ বিষয়ে বরগুনা সদর উপজেলার রেঞ্জ কর্মকর্তা মো. মতিয়ার রহমান বলেন, ‘গাছ কাটা ও এক উপজেলা থেকে অন্য উপজেলায় কাঠ পরিবহনে বন বিভাগের অনুমোদন প্রয়োজন। বরগুনায় নির্বিচারে গাছ কাটা এবং জ্বালানি হিসেবে অন্য জায়গায় নিয়ে যাওয়ার বিষয়টি আমরা অবগত নই। এ বিষয়ে খোঁজ নিয়ে সত্যতা পেলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
গাছ কাটার ওপর নিষেধাজ্ঞা
২০২২ সালের ১ অক্টোবর দেশের জীববৈচিত্র্য রক্ষার লক্ষ্যে ২০৩০ সাল পর্যন্ত সংরক্ষিত ও প্রাকৃতিক বনাঞ্চলে গাছ কাটার ওপর নিষেধাজ্ঞা অব্যাহত রাখার প্রস্তাবে অনুমোদন দেয় মন্ত্রিসভা।
সে সময় তৎকালীন মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, ২০৩০ সাল পর্যন্ত কোনোভাবেই সংরক্ষিত বনাঞ্চলের গাছ কাটা যাবে না। তবে, সামাজিক বনের গাছ কাটতে বাধা নেই।
২০১৬ সালের আগস্টে মন্ত্রিপরিষদে গৃহীত পূর্ববর্তী সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ২০২২ সাল পর্যন্ত দেশের সংরক্ষিত ও প্রাকৃতিক বনাঞ্চলে গাছ কাটার ওপর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রতিকূলতা মোকাবিলায় জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনার (২০২৩-২০৩০) খসড়াও অনুমোদন করে মন্ত্রিসভা। এছাড়াও, সভা অপরিহার্য পরিষেবা (রক্ষণাবেক্ষণ) আইন, ১৯৫২ এবং অত্যাবশ্যক পরিষেবা (দ্বিতীয়) অধ্যাদেশ, ১৯৫৮ – এ দুটি পুরানো আইনকে একীভূত করে অপরিহার্য পরিষেবা আইন, ২০২২-এর খসড়ার চূড়ান্ত অনুমোদন দেয়া হয়। খসড়া অনুযায়ী বালুমহাল এক বছরের বেশি ইজারা দেয়া যাবে না। এ সংক্রান্ত গুরুতর অপরাধের সর্বোচ্চ শাস্তি দুই বছরের কারাদণ্ড, ১০ লাখ টাকা জরিমানা বা আইনের অধীনে উভয় দণ্ড।
হুমকিতে বন্যপ্রাণী
বাংলাদেশে বন্যপ্রাণীর প্রজাতির সংখ্যা প্রায় ১১শ। এ রকম বন্যপ্রাণীর সমাহার খুব কম দেশেই পাওয়া যায়। এ দেশে পাখি প্রজাতির সংখ্যা প্রায় ৭২১। অথচ সারা ইউরোপে ৫০০ প্রজাতির পাখি দেখা খুব কঠিন।
বাংলাদেশে বন্যপ্রাণীর কী অবস্থা, তা দেখার জন্য ২০১৫ সালে প্রকাশিত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচারের (আইইউসিএন) লাল তালিকায় দেখা যায়, প্রায় ১২৫ প্রজাতির বন্যপ্রাণী হুমকি বা বিলুপ্তির মুখে, যা মোট প্রজাতির প্রায় ১৪ শতাংশ। তবে বৈশ্বিক এ তালিকা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, প্রায় এক লাখ ৫০ হাজার প্রজাতির মধ্যে প্রায় ৪২ হাজার প্রজাতি হুমকির মুখে আছে, যা মোট প্রজাতির প্রায় ২৮ শতাংশ।
গত ১০০ বছরে প্রায় ৩১ প্রজাতির বন্যপ্রাণী হারিয়ে গেছে, যা এ দেশের মোট বন্যপ্রাণীর প্রায় দুই শতাংশ।