রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় বাড়ছে বিদ্যুৎ বিভ্রাট। বিশেষ করে রাজধানীতে বিদ্যুৎ বিভ্রাটের ঘটনা ২৪ ঘণ্টায় ছয়-সাতবারও ঘটতে দেখা যাচ্ছে। দিনে ও রাতে গড়ে ৫-৬ ঘণ্টা বিদ্যুৎ মফস্বল এলাকায় থাকছে বলে খবর পাওয়া গেছে। তীব্র গ্যাস সংকট দেখা যাচ্ছে শিল্প, আবাসিক ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে। শিল্প মালিকদের অনেকের অভিযোগ, শিল্প-কারখানায় নির্ধারিত গ্যাসের চাপ পাচ্ছেন না তারা। এতে উৎপাদন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে।
পেট্রোবাংলার দৈনিক প্রতিবেদন অনুযায়ী দেখা গেছে, গতকাল জাতীয় গ্রিডে গ্যাস সরবরাহ হয়েছে প্রায় ২৮২ কোটি ঘনফুট। এর মধ্যে স্থানীয় উৎস থেকে সরবরাহ হয়েছে প্রায় ২৩১ কোটি ঘনফুট। আমদানীকৃত এলএনজি সরবরাহ হয়েছে প্রায় ৫০ কোটি ঘনফুট। এর আগে গত ২৭ জুন জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ হয়েছিল প্রায় ৩১০ কোটি ঘনফুট। সে হিসেবে এক সপ্তাহের ব্যবধানে সরবরাহ কমেছে ৩০ কোটি ঘনফুটেরও বেশি।
মূলত স্পট এলএনজির সরবরাহ কমে যাওয়ায় এ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন পেট্রোবাংলার ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা। গ্যাস সরবরাহ কমে যাওয়ায় ব্যাঘাত ঘটছে বিদ্যুৎ উৎপাদনে। বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি) সূত্রে জানা গেছে, দেশের গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর জন্য সংস্থাটির দৈনিক ১৫০ কোটি ঘনফুট গ্যাসের প্রয়োজন পড়ে। যদিও এখন দৈনিক সরবরাহ হচ্ছে ১০০-১১০ কোটি ঘনফুট। বিদ্যুৎ উৎপাদনে এ ঘাটতি পূরণ করতে না পেরে এখন লোডশেডিংয়ের পথে হাঁটছে বিপিডিবি। ৩ জুলাই পিক আওয়ারে বিপিডিবি সারা দেশে প্রায় দেড় হাজার মেগাওয়াট লোডশেডিং করে। এর মধ্যে ঢাকায় ৪০০ মেগাওয়াট, চট্টগ্রামে ২০০, খুলনা ও রাজশাহী অঞ্চলে ২২০ করে, কুমিল্লায় ১৪০, ময়মনসিংহে ১২০, সিলেটে ৫০ ও রংপুর অঞ্চলে ১৫০ মেগাওয়াট লোডশেডিং করা হয়। গত দুদিন বরিশাল অঞ্চলে কোনো লোডশেডিং হয়নি বলে বিপিডিবির তথ্যে উঠে এসেছে।
রাজধানীতে বিদ্যুৎ বিভ্রাট নিয়ে গ্রাহকদের এখন সেলফোনে বার্তা পাঠাচ্ছে ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (ডিপিডিসি)। সার্বক্ষণিক বিদ্যুৎ না থাকায় দুঃখ প্রকাশ করে ওই বার্তায় বলা হচ্ছে, গ্যাসস্বল্পতার কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় ডিপিডিসি চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ পাচ্ছে না। বর্তমানে নগরীতে যে বিদ্যুৎ বিভ্রাট ঘটছে, তা অনিচ্ছাকৃত।
গ্যাস সংকটের বিষয়টি জানিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি পোস্ট দিয়েছেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে তিনি লিখেছেন, গ্যাসস্বল্পতার কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। এতে অনেক জায়গায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বিঘ্নিত হচ্ছে। গ্যাস সরবরাহ স্বাভাবিক হলে বিদ্যুৎ উৎপাদনও পুনরায় স্বাভাবিক হবে। যুদ্ধের প্রভাবে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানির উচ্চমূল্য ও সরবরাহ অন্যান্য দেশের মতো আমাদেরও সমস্যায় ফেলেছে। এ পরিস্থিতিতে আপনাদের সাময়িক অসুবিধার জন্য আন্তরিক দুঃখ প্রকাশ করছি।
জ্বালানি তেল ও গ্যাসের দাম বেড়ে যাওয়ায় বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ নিয়ন্ত্রণে রাত ১০টার মধ্যে দোকানপাট বন্ধের সিদ্ধান্ত দিয়েছে সরকার। এর পরও পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে হিমশিম খাচ্ছে বিদ্যুৎ বিভাগ। এ বিষয়ে জানতে বিদ্যুৎ বিভাগসংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে শীর্ষ স্থানীয় গণমাধ্যমকে বলেন, দেশে স্থানীয় গ্যাস সরবরাহ দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন হয় মোট চাহিদার অর্ধেকেরও কম। এখন যদি বিদ্যুতের চাহিদা পূরণে এলএনজি ও জ্বালানি তেল আমদানি বাড়াতে হয়, তাহলে বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ অন্তত তিন-চার গুণ বাড়বে। বর্তমানে বিদ্যুৎ খাতে ৯-১০ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিচ্ছে সরকার। এ অবস্থা চলতে থাকলে এ খাতে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে হবে।
দেশে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর বড় অংশ রয়েছে গ্যাস বিতরণ কোম্পানি তিতাসের আওতায়। সংস্থাটির সব শ্রেণীর গ্রাহকের জন্য দৈনিক ২২০-২৩০ কোটি ঘনফুট গ্যাসের প্রয়োজন। যদিও সরবরাহ হচ্ছে ১৭০-১৮০ কোটি ঘনফুটের মতো। ঘাটতি গ্যাসের জন্য সংস্থাটিকে প্রতিনিয়ত বিদ্যুৎ খাতে রেশনিং করতে হচ্ছে।
গ্যাস সরবরাহ ব্যবস্থাপনা ঠিক রাখতে সম্প্রতি জ্বালানি বিভাগ একটি বৈঠক করেছে। ওই বৈঠকের কার্যপত্র থেকে জানা যায়, বিশ্ববাজারে এলএনজির দাম বেড়ে যাওয়ায় জ্বালানি বিভাগ এখন আর স্পট মার্কেট থেকে পণ্যটি আমদানি করবে না। ঘাটতি পূরণ হবে মূলত স্থানীয় উৎপাদন ও এলএনজির দীর্ঘমেয়াদি সরবরাহ থেকে।
বৈঠকে চলতি মাস থেকে আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত স্থানীয় উৎস ও এলএনজির দীর্ঘমেয়াদি সরবরাহ নিয়ে পরিকল্পনা করা হয়। এ পরিকল্পনা অনুযায়ী, চলতি মাস থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত গ্যাসের জাতীয় গ্রিডে দৈনিক সরবরাহ হবে ২৭০ কোটি ঘনফুটের কিছু বেশি (স্পট থেকে কেনা এলএনজি বাদে)। এর মধ্যে স্থানীয় উৎস থেকে সরবরাহ আসবে ২৩০ কোটি ঘনফুট। দীর্ঘমেয়াদি এলএনজি চুক্তির আওতায় সরবরাহ হবে গড়ে ৪৬ কোটি ঘনফুট। মোট সরবরাহকৃত গ্যাসের মধ্যে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো পাবে দৈনিক ৯০ কোটি ঘনফুট। বাকি গ্যাস যাবে শিল্প, আবাসিক, সিএনজিসহ অন্যান্য খাতে।
জ্বালানি বাজারে দাম কমলে বিদু্যুতের সরবরাহ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসবে বলে জানিয়েছেন খাতের নীতিনির্ধারকরা। বিদ্যুৎ খাতের নীতি ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক প্রকৌশলী মোহাম্মদ হোসাইন শীর্ষ স্থানীয় গণমাধ্যমকে বলেন, বৈশ্বিক জ্বালানির ঊর্ধ্বগতিতে বহু দেশ গ্যাস-বিদ্যুতের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহে হিমশিম খাচ্ছে। এ পরিস্থিতির মধ্যে আমরাও রয়েছি। উন্নত দেশগুলোও এখন সাশ্রয়ী মূল্যে বিদ্যুৎ দিতে রেশনিং করছে। জাপান পরিকল্পিতভাবে দিনে ২ ঘণ্টা লোডশেডিংয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। জ্বালানি বাজার নিম্নমুখী হলে পরিস্থিতিও স্বাভাবিক হয়ে আসবে।
দেশের গ্যাস ও বিদ্যুৎ খাতে চলমান এ সংকট সামাল দিতে গ্যাস-বিদ্যুতের অপ্রয়োজনীয় ব্যবহার কমানোর পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। একই সঙ্গে বিদ্যুৎ বিভ্রাট নিয়ে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি কমাতে বিষয়টি নিয়ে আগেই জানিয়ে দেয়ারও আহ্বান জানিয়েছেন তারা।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ম. তামিম এ বিষয়ে শীর্ষ স্থানীয় গণমাধ্যমকে বলেন, বিদ্যুৎ বিভ্রাট হচ্ছে জ্বালানি খরচ কমাতে গিয়ে। এ সংকট মোকাবেলা করার জন্য বিদ্যুৎ ও গ্যাসের অপ্রয়োজনীয় ব্যবহার কমাতে হবে। একই সঙ্গে যেসব এলাকায় বিদ্যুৎ বিভ্রাট হবে, সেসব এলাকায় একদিন আগেই ঘোষণা দিয়ে গ্রাহককে জানাতে হবে। তাহলে সাধারণ মানুষও সে অনুযায়ী প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে পারবে।