সবজি না কি সবজির রস? উপকারের বেশি কোনটায়!

সুষম খাবারের হিসেব মেলাতে রোজ আড়াই–তিন কাপ সবজি খাওয়ার কথা। কিন্তু কম মানুষই তা করে উঠতে পারেন। কারণ টাটকা সবজি কিনে, কেটে–বেছে, রান্না করা যেমন সময়সাপেক্ষ ব্যাপার, এ সব মুখে রোচেও না অনেকের। ফলে স্বাস্থ্যরক্ষার তাগিদে তাঁদের অনেকেই আজকাল সবজির রস খাওয়া ধরেছেন। স্ট্যানফোর্ড মেডিসিন ক্যানসার ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীদেরও সায় আছে তাতে। তাঁরা বলছেন, এক কাপ গাজরের রস খাওয়া আর ৫ কাপ কুঁচোনো কাঁচা গাজর খাওয়া পুষ্টির হিসেবে সমতূল্য। এতে পটাশিয়াম, ফোলেট, ভিটামিন এ এবং সি আছে ভরপুর। আছে উপকারি ফাইটোকেমিক্যালও।

শুধু গাজর বলে নয়, অধিকাংশ সবজির রসেই এ সমস্ত নানা উপকার আছে। তার পাশাপাশি এদের ক্যালোরি খুব কম, চর্বি নেই বললেই চলে। অতএব ওজন ও রক্তচাপ কম রাখার পাশাপাশি হার্ট ভাল রাখতেও এর ভূমিকা আছে।

চনমনে করে তোলার ব্যাপারেও তারা অনবদ্য। প্রবল কাজের চাপে যখন নাওয়া–খাওয়ার সময় পাচ্ছেন না, একগ্লাস টাটকা সবজির রস খেয়ে নিলে, চট করে এনার্জি পেয়ে যাবেন। ভাবছেন, তা হলে রান্না করা ছেড়ে কাঁচা সবজির রসই খাবেন, বা বানানোর সময় না পেলে কিনে নেবেন, আর সুস্বাস্থ্য চলে আসবে হাতের মুঠোয়?

না, অত সোজা নয়। রস ঘরে বানান কি বাজার থেকে কিনুন, তাতে ভাল–র পাশাপাশি আছে খারাপ দিকও। কাজেই হিসেব–নিকেশ করে না খেলে লাভের বদলে ক্ষতির আশঙ্কাই বেশি।

নিয়ম মেনে টাটকা রস বানিয়ে, সঙ্গে সঙ্গে খেলে কী উপকার পাওয়া যায়, তা আগেই বলা হয়েছে। প্যাকেটের রসে এত গুণ নেই। কারণ সে রস পাস্তুরাইজ করে জীবাণুমুক্ত করার সময় অনেক উপকারি উপাদানই নষ্ট হয়ে যায়। তার উপর স্বাদ বাড়ানোর জন্য কিছু রসে মেশানো হয় গাঢ় ফলের রস। ফলে ‘নো অ্যাডেড সুগার’ লেখা থাকলেও তাতে ফ্রুকটোজ তথা সুগার বেশ বেশি থাকে, যা ডায়াবিটিক ও মোটা মানুষদের জন্য মোটেই ঠিক নয়।

আবার তাতে মেশানো হয় প্রিজারভেটিভ। ঠিক মানের জিনিস ঠিক মাত্রায় মেশালে বিরাট ক্ষতি নেই। তবে আমাদের দেশে অনেক সময়ই সে সব নিয়ম মানা হয় না। ফলে ত্বকের নানা রকম সমস্যা হতে পারে। বহু রসে মেশানো হয় কৃত্রিম রং ও গন্ধ, তা থেকেও অ্যালার্জি হতে পারে।

তা হলে কী করবেন? নিজে হাতে রস করে খাবেন? সেটাও নিরাপদ নয়। সতর্ক না থাকলে সবজিতে মিশে থাকা মাটি, জীবাণু, কৃমি, কীটনাশক থেকে বিপদ হতে পারে। আর সবজি তাজা দেখানোর জন্য যদি বিষাক্ত রঙে তাকে ডোবানো হয়, সতর্ক হয়েও খুব লাভ নেই। কপার সালফেট, রোডামিন অক্সাইড, ম্যালাকাইট গ্রিন, কার্বাইড ইত্যাদি বিষাক্ত রাসায়নিকের প্রভাবে ডিমেনসিয়া, অ্যালঝাইমার্স এমনকি ক্যান্সারের মতো অসুখও হতে পারে। খারাপ হতে পারে লিভার ও কিডনি।

ব্যাপারটা আরও জটিল হয় যদি রং করা সবজিকে পেট্রোলিয়াম তেল দিয়ে ঘষে চকচকে করা হয়। তখন যতই জল দিয়ে ধোওয়ার চেষ্টা করা হোক না কেন, তেলের পরত ভেদ করে জল বিষাক্ত রং পর্যন্ত পৌঁছোতে পারে না।

আবার এই তেলের কারণে পেটের গোলমাল যেমন হয়, ফুসফুসেরও ক্ষতি হতে পারে। সম্ভাব্য ক্ষেত্রে খোসা ছাড়িয়ে ভাল করে ধুয়ে রান্না করে খেলেও অনেক সময় এর হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যায় না। কাঁচা খেলে তো কথাই নেই। কাজেই, এই সব সবজি থেকে যত দূরে থাকা যায় তত ভাল।

খুব বড় মাপের সবজি নিয়মিত খেলে হরমোনের গোলমাল হতে পারে। হতে পারে বন্ধ্যাত্ব। এর মূলে আছে অক্সিটোসিন নামের হরমোন, যা ইনজেকশন হিসেবে দিয়ে রাতারাতি সবজিকে বিরাট আকারের করে তোলেন অসাধু ব্যবসায়ীরা।

হৃদরোগ বা কিডনির সমস্যা থাকলে, ডাক্তার যদি লো পটাশিয়াম ডায়েট খেতে বলেন, সবুজ শাক, আরুগুলা, বেসিল (তুলসি), বিট শাক, চাইনিজ বাঁধাকপি, ব্রকোলি, সেলারি, পালং ইত্যাদির রস খাবেন না। হাইপোথাইয়েডিজম থাকলেও এক ব্যাপার। এ রোগের ওষুধ, থাইরক্সিন খাওয়ার পর পরই এ সব রস খেলে ওষুধের কার্যকারিতা কমে রোগের প্রকোপ বেড়ে যেতে পারে।

কাঁচা সবজির রস খেলে পেটে ও মাথায় কৃমি হতে পারে। গরম পানিতে ধুয়ে নিলেও সে আশঙ্কা নির্মূল হয় না। পটাশিয়াম পারম্যাঙ্গানেটের খুব লঘু দ্রবণে মিনিট ১৫ ডুবিয়ে রেখে কলের জলে বেশ ভাল করে ধুয়ে ব্যবহার করতে পারেন। তা ছাড়া রসে ছিবড়ে থাকে না বলে কোষ্ঠকাঠিন্য, গ্যাস–পেটভার, হজমের গোলমালও হতে পারে। সে বিপদ এড়াতে রসের বদলে মিক্সিতে সবজি পিশে স্মুদি বানিয়ে খান।

সবজির রস বানানোর নিয়ম

► খুব তাজা–চকচকে বা স্বাভাবিকের চেয়ে বড় মাপের সবজি না কেনাই উচিত।

► কলের পানিতে রগড়ে ধুয়ে নিন। মাটি থাকলে ব্রাশ দিয়ে ঘষুন। এ বার বড় গামলার পানিতে সিকি কাপ সাদা ভিনিগার ও সিকি চামচ সামুদ্রিক লবণ মিশিয়ে তাতে ডুবিয়ে রাখুন। ভেগি ওয়াশও ব্যবহার করতে পারেন। মিনিট দশেক পর এই পানি ফেলে দু’-তিন বার ধুয়ে নিন। মোটামুটি ৮০ শতাংশ কীটনাশকের হাত থেকে রক্ষা পাবেন।

► জীবাণুর হাত থেকে বাঁচতে পচা, দাগধরা অংশ কেটে ফেলে দিন।

► খোসা ভাল করে ছাড়িয়ে রস বানান।

► রস বানিয়ে সঙ্গে সঙ্গে খেয়ে নিন। জুসারও ধুয়ে রাখবেন। নাহলে  সেখানে জীবাণুর বাড়বৃদ্ধি হবে। পরের বার রস বানানোর সময় তা রসে সংক্রামিত হয়ে অসুস্থ করে তুলবে।

Scroll to Top