প্রতিবারের মতো এ বছরও ২৫ মে পালিত হচ্ছে বিশ্ব থাইরয়েড দিবস। এবারের প্রতিপাদ্য বিষয় হলো—‘থাইরয়েড সমস্যাও অসংক্রামক রোগ’। থাইরয়েড বিষয়ে জনসচেতনতার নিদারুণ ঘাটতি রয়েছে। ধারণা করা হয়, বাংলাদেশে চার-পাঁচ কোটি মানুষ থাইরয়েড সমস্যায় আক্রান্ত।
বিশ্বে প্রায় ৮০ কোটি মানুষ এর শিকার।
থাইরয়েডজনিত সমস্যায় আপনার করণীয়থাইরয়েড গ্রন্থি একটি অতি প্রয়োজনীয় অন্তঃক্ষরা (এন্ডোক্রাইন) গ্ল্যান্ড, যা গলার সামনের অংশে অবস্থিত। এটি মানব শরীরের প্রধান বিপাকীয় হরমোন তৈরিকারী গ্ল্যান্ড। থাইরয়েড থেকে নিঃসৃত প্রধান কার্যকরী হরমোনগুলো তৈরি করতে সাহায্য করে টিএসএইচ নামক আরেকটি হরমোন, যা মস্তিষ্কের ভেতর পিটুইটারি নামের গ্ল্যান্ড থেকে নিঃসৃত হয়।
থাইরয়েড হরমোনের অন্যতম কাজ হচ্ছে শরীরের বিপাকীয় হার বা বেসাল মেটাবলিক রেট বাড়ানো। থাইরয়েড হরমোনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে স্নায়ুকে পরিপক্ব করা। গর্ভাবস্থায় থাইরয়েড হরমোনের স্বল্পতায় গর্ভের বাচ্চা বোকা হয় অথবা বুদ্ধিদীপ্ত হয় না। যেসব উদ্দীপনায় বিপাকক্রিয়া বেড়ে যায়, যেমন—যৌবনপ্রাপ্তি, গর্ভাবস্থা, শারীরবৃত্তীয় কোনো চাপ ইত্যাদি কারণে থাইরয়েড গ্ল্যান্ডের আকার বা কার্যকারিতায় পরিবর্তন হতে পারে।
থাইরয়েড গ্রন্থি থেকে মূলত দুই ধরনের সমস্যা দেখা যায়, গঠনগত ও কার্যগত। এরা বিভিন্ন উপায়ে প্রকাশ পেতে পারে।
► গঠনগত সমস্যায় থাইরয়েড গ্রন্থি ফুলে যায়, যেটিকে গয়টার বলা হয়; যার আবার রয়েছে নানা প্রকারভেদ। এ ছাড়া থাইরয়েড গ্ল্যান্ডের গোটা বা নোডিউল এবং থাইরয়েড গ্ল্যান্ডের ক্যান্সার হতে পারে।
► কার্যগত সমস্যা দুই রকমের হয়ে থাকে, তা হলো থাইরয়েড গ্ল্যান্ডের অতিরিক্ত কার্যকারিতা বা হাইপারথাইরয়েডিজম ও থাইরয়েড গ্ল্যান্ডের কার্যকারিতা হ্রাস বা হাইপোথাইরয়েডিজম।
এ ছাড়া থাইরয়েড গ্ল্যান্ডের প্রদাহ বা থাইরয়েডাইটিস হতে পারে।
থাইরয়েড গ্ল্যান্ডের অতিরিক্ত কার্যকারিতা বা হাইপারথাইরয়েডিজম।
হাইপারথাইরয়েডিজম রোগে থাইরয়েড গ্ল্যান্ড বেশি মাত্রায় সক্রিয় হয়ে পড়ে। থাইরয়েড গ্ল্যান্ডের অতিরিক্ত কার্যকারিতার ফলে—
► অনেক গরম লাগা, হাত-পা ঘামা।
► পরিপাকতন্ত্রের সমস্যা, খাওয়ার রুচি স্বাভাবিক বা বেড়ে যাওয়ার পরও ওজন কমে যাওয়া, ঘন ঘন পায়খানা হওয়া।
► হার্ট ও ফুসফুসীয় সমস্যা : বুক ধড়ফড়, হৃদস্পন্দন বেড়ে যাওয়া, হার্ট ফেইলিওর, অ্যানজাইনা বা বুক ব্যথা।
► স্নায়ু ও মাংসপেশির সমস্যা : অবসন্নতা বা নার্ভাসনেস, মেজাজ খিটখিটে হয়ে যাওয়া, উত্তেজনা, আবেগপ্রবণতা, সাইকোসিস বা মানসিক বিষাদগ্রস্ততা, হাত-পা কাঁপা, মাংসপেশি ও চক্ষুপেশির দুর্বলতা ইত্যাদি হতে পারে।
► এ ছাড়া হাড়ের ক্ষয় বা ওস্টিওপোরোসিস, মাসিকের সমস্যা, বন্ধ্যাত্ব পর্যন্ত হতে পারে।
হাইপারথাইরয়েডিজমের কারণ
► গ্রেভস ডিজিজ : এক ধরনের অটোইমিউন রোগ, যাতে থাইরয়েড গ্ল্যান্ডের পাশাপাশি চোখ কোটর থেকে বেরিয়ে আসে।
► মাল্টিনোডিউলার গয়টার।
► থাইরয়েড গ্ল্যান্ডের প্রদাহ বা থাইরয়েডাইটিস।
► থাইরয়েড গ্ল্যান্ড ছাড়া অন্য কোনো উৎসর কারণে থাইরয়েড হরমোনের আধিক্য।
► ক্যান্সার ও অন্যান্য।
চিকিৎসা
হাইপারথাইরয়েডিজমের চিকিৎসা হচ্ছে অ্যান্টিথাইরয়েড ওষুধ, যেটি থাইরয়েড গ্রন্থির কার্যকারিতাকে কমিয়ে দেবে। ওষুধ ব্যতিরেকে কখনো কখনো সার্জারি করা প্রয়োজন হতে পারে। যখন অ্যান্টিথাইরয়েড ওষুধ ব্যবহার করা হয়, এটি বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেড় থেকে দুই বছর ব্যবহার করা হয়। তারপর এই ওষুধ বন্ধ করে দিতে হবে। রোগী যদি স্বাভাবিক থাকে, খুব ভালো কথা। তবে যদি আবারও রোগ ফিরে আসে, তখন সাধারণত রেডিও আয়োডিন দিয়ে গ্ল্যান্ড নষ্ট করে দিতে হয়।
থাইরয়েড গ্ল্যান্ডের কার্যকারিতা হ্রাস বা হাইপোথাইরয়েডিজম
যেসব অঞ্চলে আয়োডিনের অভাব রয়েছে, সেখানে আয়োডিনের অভাবজনিত কারণে হাইপোথাইরয়েডিজম দেখা যায়। এ ছাড়া অটোইমিউন হাইপোথাইরয়েডিজম থাইরয়েড গ্ল্যান্ডের বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি সক্রিয় হলে গ্ল্যান্ড নষ্ট হয়ে যায় এবং থাইরয়েড গ্ল্যান্ড কাজ করে না। চিকিৎসাজনিত কারণেও এই অসুখ হতে পারে। অস্ত্রোপচারের কারণে থাইরয়েড গ্ল্যান্ড বাদ দিতে হলে বা অন্য কারণেও থাইরয়েড নষ্ট হয়ে গেলে এ সমস্যা হতে পারে। হাইপারথাইরয়েডিজমের ওষুধের ডোজ বেশি হলে তা থেকে হাইপোথাইরয়েডিজম হতে পারে। নবজাতক শিশুদের মধ্যে থাইরয়েড গ্ল্যান্ড তৈরি বা কার্যকর না হলে কনজেনিটাল হাইপোথাইরয়েডিজম দেখা যায়।
হাইপোথাইরয়েডিজমের লক্ষণগুলো
► অবসাদগ্রস্ত হওয়া, সঙ্গে অলসতা, ঘুম ঘুম ভাব।
► ত্বক খসখসে হয়ে যায়।
► শরীর অল্প ফুলে যায়।
► ক্ষুধামান্দ্য শুরু হয়।
► চুল পড়তে শুরু করে।
► ওজন অল্প বেড়ে যায়, পাঁচ-ছয় কিলো বেড়ে যেতে পারে।
► স্মৃতিশক্তি কমে যায়।
► শীত শীত ভাব দেখা যায়।
► কোষ্ঠকাঠিন্য শুরু হয়।
► মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়।
► ব্লাড প্রেসার বাড়তে পারে।
► মাসিকের সমস্যা হতে পারে।
► বন্ধ্যাত্বের সমস্যা হতে পারে।
► গর্ভধারণকালে গর্ভপাত হতে পারে।
থাইরয়েড ক্যান্সার
থাইরয়েড গ্রন্থির কোনো অংশ টিউমারের মতো ফুলে উঠলে বলা হয় ‘থাইরয়েড নোডিউল’। এসব থাইরয়েড নোডিউলের ১ শতাংশ থেকে থাইরয়েড ক্যান্সার হতে পারে। থাইরয়েড গ্রন্থির কোনো অংশের কোষসংখ্যা অনিয়ন্ত্রিতভাবে বৃদ্ধি পেলে সেটিকে থাইরয়েড ক্যান্সার বলে। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে থাইরয়েড গ্রন্থি বা এটির অংশবিশেষ ফুলে ওঠা মানেই কিন্তু ক্যান্সার নয়।
থাইরয়েড ক্যান্সারের লক্ষণগুলো
► গলার সম্মুখভাগে ফুলে ওঠা। ফোলা অংশটি বেশ শক্ত হয়।
► এক বা একাধিক টিউমার হতে পারে। উভয় পাশে টিউমার হতে পারে, আশপাশের লিংক নোডগুলো ফুলে উঠতে পারে।
► ওজন কমে যায়। খাওয়ার রুচি কমে যেতে পারে।
► গলার স্বর পরিবর্তন হতে পারে। গলার স্বর মোটা বা ফ্যাসফ্যাসে হতে পারে।
► তবে থাইরয়েড নোডিউল বা ক্যান্সার ছাড়াও গলার সামনে ফুলে উঠতে পারে।
► শ্বাসনালির ওপর চাপ সৃষ্টির ফলে শ্বাসকষ্ট হতে পারে।
খেয়াল করুন
নিকট বংশে থাইরয়েড ক্যান্সারের ইতিহাস থাকলে ক্যান্সার স্ক্রিনিংয়ের জন্য অবশ্যই এন্ডোক্রাইনোলজিস্ট বা হরমোন বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হবে। থাইরয়েড ক্যান্সার এমন একটি রোগ, যা সময়মতো চিকিৎসা করলে ৯৫ শতাংশ ক্ষেত্রেই সম্পূর্ণ আরোগ্য সম্ভব। তবে অবশ্যই সময়মতো চিকিৎসা করাতে হবে। গলার সামনে ফুলে উঠলে যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি একজন এন্ডোক্রাইনোলজিস্ট বা হরমোন বিশেষজ্ঞকে দেখানো উচিত। তিনি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখবেন এটি কোন ধরনের রোগ।
বিশেষভাবে জানা প্রয়োজন
► বাচ্চাদের ক্ষেত্রে হরমোনটি শারীরিক ও মানসিক বিকাশে বিশেষ ভূমিকা রাখে।
► বড়দের ক্ষেত্রে প্রজননে অক্ষমতা, মহিলাদের মাসিকের সমস্যা, পেটের বাচ্চা নষ্ট হওয়াসহ নানা সমস্যা হতে পারে।
► থাইরয়েড ক্যান্সার এমন একটি রোগ, যা সময়মতো চিকিৎসা করালে ৯৫ শতাংশ ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ আরোগ্য সম্ভব।
► গর্ভবতী অবস্থায় মায়ের হাইপোথাইরয়েডিজমের কারণে বাচ্চা বোকা ও বুদ্ধিহীন হতে পারে।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক
এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগ