meditation1

তরুণ প্রজন্মের ওপর মেডিটেশনের ইতিবাচক প্রভাব

তরুণ প্রজন্ম আশা-শঙ্কার দোলাচলে জীবনযাপন করছে। তারা জীবনের তাৎপর্য উপলব্ধি করতে অক্ষম। তারা প্রযুক্তির খপ্পরে পড়ে ঘুমাতে যেতে যেতে দেখে রাত শেষ। আর ঘুম থেকে উঠে দেখে দিনশেষ। ক্রমশ তারা লক্ষ্য থেকে দূরের মানুষ হয়ে পড়ছে। সবচেয়ে মূল্যবান বিনিয়োগ-মনোযোগ। এ মনোযোগ বিক্ষিপ্ততার শিকার তারা। ভোগ্যপণ্য, প্রযুক্তিপণ্যের আগ্রাসনে তরুণরা বিভ্রান্ত। মনোদৈহিক সমস্যাগ্রস্ত তরুণদের মুক্তির পথ-দিশা হিসেবে মেডিটেশন কী কী ইতিবাচক প্রভাব ফেলে তা নিয়ে কথকতা।

তরুণ শিক্ষার্থীরা নানাবিধ প্রতিযোগিতা, পরীক্ষা, জীবনযাপনের বৈপরীত্যপূর্ণ পরিবেশে স্নায়ুচাপে থাকে। তাদের দেহ-মনের যত্নায়নে, মনোদৈহিক সুস্থতা নিশ্চিতে মেডিটেশনের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। একজন ধ্যানী তরুণের মস্তিস্ক অপ্রয়োজনীয় জিনিসে আসক্তি হারায়। তার মস্তিস্ক ইতিবাচক সুনির্দিষ্ট বিষয়ে নিমগ্ন হয়। চিত্তকে বিষয়ের সঙ্গে একাত্ম করে। মস্তিস্কের ক্ষমতাকে নিখুঁতভাবে প্রয়োগ করে। মেডিটেশন বুদ্ধিমত্তা, স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধি এবং মনোযোগকে দ্বিগুণ করে। অবসন্নতা, ক্লান্তি দূর করে দেহে এন্টিবডির পরিমাণ বৃদ্ধি করে।

তরুণ প্রজন্ম লাইফস্টাইলের কারণে বাজে অভ্যাসের বৃত্তে ঘুরপাক খায়। সুস্থ জীবনাচার, আত্মনিয়ন্ত্রিত মানবিক সত্তা রূপায়নে তাদের জীবনধারায় ইতিবাচক অনুষঙ্গই হচ্ছে মেডিটেশন। এর অভ্যস্ততায় ও অনুশীলনে বেঁচে থাকার অর্থ বোধোদয় হয়। তাদের মাইন্ড-ব্রেনকে এর ফলে রি-টিউনিং করা সম্ভব হয়। মস্তিস্কে যা ঘটে, বাইরে তা ঘটে। মেডিটেশন এক প্রকার ব্রেনের ব্যায়াম।

এর অনুশীলনে ব্রেনের কর্মকাঠামো বদলে যায়। এটি নেতিবাচক আবেগ পরিহার করে মুহূর্তকে অনুভব, উপভোগ সম্ভব করে। শারীরিক সংবেদন বিষয়ে সচেতন করে। ব্রেনের গ্রে-ম্যাটার বাড়ে-এতে মনোযোগ বৃদ্ধি পায়। এর চর্চায় স্মৃতিশক্তির আশ্রয়ে হিপোক্যাম্পাস বিস্তৃত হয়। নিয়মিত যারা মেডিটেশন করেন তাদের শরীরে এনজাইমের পরিমাণ বাড়ে, যা দেহ কোষে টেলোমেয়ারের আকার বৃদ্ধি করে, এতে বিভাজিত কোষ অপরিবর্তিত থেকে বার্ধক্য প্রক্রিয়াকে ধীরগতি করে।

তরুণরা বহুবিধ স্ট্রেসের ধকলে বিভ্রান্ত। ধ্যান স্ট্রেসমুক্তিতে সহায়ক। নিয়মিত ধ্যান চর্চাকারীদের মস্তিস্কের এমিগডালাতে গঠনগত পরিবর্তন হয়। ব্রেনের এ অংশ ভয় ও অন্যান্য নেতিবাচক আবেগ নিয়ন্ত্রণ করে। ধ্যানে স্ট্রেস হরমোন কর্টিসোল নিঃসরণ কমে। ব্রেনে সেরোটনিন নিঃসরণ করে ইন্দ্রিয়ানুভূতিতে সুখকর-আনন্দ স্ফূর্তি বৃদ্ধি করে।

তরুণদের মধ্যে স্বপ্নহীনতা ও আশাহীনতা তাদের আত্মহত্যাপ্রবণ করে। মেডিটেশন জীবনকে অর্থপূর্ণ করে, তরুণদের স্বপ্নবান করে এবং তাদের জীবনের পথনকশা তৈরি করে। শিক্ষাঙ্গনে তরুণরা মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় চিকিৎসাসেবা পায় না। তারা সোশ্যাল ফোবিয়ায় আক্রান্ত। ক্লিনিক্যাল ডিপ্রেশন হিসেবে বিষণ্নতা, দুঃখ বা সুখ ছাপিয়ে দুঃখবোধ, হতাশা, শূন্যতা, আগ্রহহীনতা, দৈনন্দিন কর্মক্ষমতায় মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।

তরুণদের অ্যাংজাইটি ডিসঅর্ডার রোধে মেডিটেশন চর্চা সহায়ক। অ্যাংজাইটি ডিসঅর্ডারে অনিয়ন্ত্রিত অতিরিক্ত উদ্বেগ, ভয় ও আশঙ্কা, অস্থিরতা, অনিদ্রা উপসর্গ ব্যক্তিকে স্ট্রেস অনুভূতি থেকে পৃথক এক সত্তায় উপনীত করে। ফলে ব্যক্তির আবেগ ও ভাবনাচিন্তা এমনভাবে প্রভাবিত হয় যে, ব্যক্তির যৌক্তিক আচরণ বদলে, অন্যদের জীবন থেকে নিজেকে সরিয়ে নেওয়ার প্রবণতা জোরালো হয়।

মেডিটেশন তরুণদের, সর্বোপরি মানুষের মনোদৈহিক ও ব্রেনের কর্মকাঠামো, গঠনগত পরিবর্তন ছাড়াও সামাজিক জীবনকে প্রভাবিত করে। তরুণদের-সামাজিক জীবন নেতিবাচকতায় ভরপুর হয়ে উঠছে। তারা লাইফস্টাইল ডিজিজের সহজ শিকারে পরিণত। ফ্যাশন, ব্র্যান্ড, মাদক ও প্রযুক্তি পণ্যের সহজলভ্যতা সমাজের একটি অংশের জীবনযাপন অনিয়ন্ত্রিত শঙ্কাকুল করে তুলছে।

তারা এটাকে মনে করছে স্বাধীনতা— জীবনের অর্থপূর্ণতা। কিন্তু একটা সময়ে ভুলটুকু উপলব্ধির পরিবেশ সৃষ্টি হলেও ততক্ষণে ক্ষতি যা হওয়ার হয়ে যায়। প্রযুক্তির দাসত্বের ফলে তাদের জীবন থেকে স্বাস্থ্যকর ঘুম উধাও হয়ে যায়। তাদের সামাজিক জীবন অপূর্ণ। ভার্চুয়াল সর্ম্পকের কৃত্রিম আবহে তাদের পরিবার ও সমাজের কাছে তাদের বন্ধন মৃতপ্রায়।

সম্পর্কগুলোর শেকড় দুর্বল। আগের চেয়ে তরুণ প্রজন্ম বন্ধুহীন, নিঃসঙ্গ এবং কাছের মানুষের হাতে বেশি করে বুলিংয়ের শিকার। নির্লিপ্ততা, অমনোযোগ ও উদাসীনতা সমাজে মজ্জাগত হয়ে পড়ছে। সোশ্যাল মিডিয়া সমাজের বড় একটি অংশকে আন-সোশ্যাল করে তুলছে। একলা মানুষ- আসলে টুকরা মানুষ। মেডিটেশন একা নয়-একসাথে থাকার মন্ত্র শেখায় এবং সুখী পারিবারিক ও সামাজিক জীবনের ভিত রচনা করে। সমষ্টিগত জীবন হচ্ছে সুখের আকর এবং এটি স্বাস্থ্যকর সামাজিক পণ্য বটে।

আসলে কিছু না করেই ‘ভাল্লাগে না’ প্রজন্মের মনোদৈহিক সুস্থ জীবনাচার ও জীবনের অর্থোপলব্ধির জন্য গুরুত্ব লিখে শেষ করা যাবে না। এর চর্চা হতে পারে তাদের আত্মিক ও জৈবিক জীবনধারার সঞ্জীবনী মন্ত্র। নিজে ভালো থাকার এবং অপরকে ভালো থাকার দাওয়া। বর্তমান সময়ে দেশে দেশে সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে বেশি করে বিকল্প চিকিৎসা কিংবা চিকিৎসার পরিপূরক হিসেবে মেডিটেশনের প্রভাব- সে পথরেখাই নির্দেশ করছে।

Scroll to Top