প্রতিদিনের আহারের একটি বিরাট অংশ ভূমিকা রাখে দেহের স্বাভাবিক বিপাকে। পরিমিত পরিমাণে খাবার গ্রহণে বজায় থাকে দেহের প্রয়োজনীয় পুষ্টির যোগান। তবে বয়সের ওপর ভিত্তি করে এই খাদ্য শরীরের কাঠামোর ওপর ভিন্ন রকম প্রভাব ফেলে। এ ক্ষেত্রে সব সময় দেহকে সুনির্দিষ্ট গড়নে ধরে রাখতে খাদ্য গ্রহণে কম বেশি করা হয়। আর এখানেই দরকার পড়ে ক্যালোরির হিসাব-নিকাশের; তথা ডায়েটের। কিন্তু দিনের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ বিরতিহীন ভাবে আহার থেকে বিরত থাকা অধিক স্বাস্থ্যসম্মত। চলুন, বিজ্ঞানের আলোকে জেনে নেওয়া যাক, কেন রোজা ডায়েট অপেক্ষা বেশি উপকারী।
কেন রোজা রাখা ডায়েট করা থেকে অধিক স্বাস্থ্যসম্মত
বেশি ক্যালোরি খরচ ও অধিক মেদ কমায়
দেহে খাদ্য প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে রক্তে গ্লুকোজ বেড়ে যায়। ফলে বিপাকসহ দেহের অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন কার্যকলাপে চিনির ভূমিকা বাড়ে। এটি শরীরকে হৃষ্ট-পুষ্ট করে বটে, কিন্তু শরীর বঞ্চিত থেকে যায় শক্তি তৈরি থেকে। ঘণ্টা খানেক পর পর আহারেও এটি অব্যাহত থাকে তবে ধীর গতিতে। কিন্তু ১৩ ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে খাদ্য গ্রহণ থেকে বিরত থাকা সম্পূর্ণ ভিন্ন ব্যাপার। এ সময় শরীর যথেষ্ট পরিমাণে চর্বি পোড়াতে শুরু করে এবং কিটোন তৈরি করে, যা জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
বিরতিহীন উপবাস শুরু করার কয়েক দিনের মধ্যে এই প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যায়। এর জন্য প্রতি ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ৩ বেলা আহারকে ৮ ঘণ্টা দূরত্বে দুই বেলা আহার দিয়ে প্রতিস্থাপন করার প্রয়োজন হবে। এতে করে ডায়েটের চেয়েও তুলনামূলক কম সময়ে মেদ কমে আসাটা দৃশ্যমান হবে।
ক্যালোরির হিসাব রাখার প্রয়োজন পড়ে না
বিরতিহীন উপবাস প্রথাগত ক্যালোরি গণনার ক্লান্তি এবং সময় থেকে মুক্তি দেয়। এর থেকে কাঙ্ক্ষিত গড়নের অবয়ব দেখার জন্য দিন গোণাটা একই সঙ্গে সহজতর এবং প্রত্যাশার ব্যাঞ্জক।
শুধু তাই নয়, অক্ষরে অক্ষরে ডায়েট মেনে চলতে যেয়ে ব্যয়বহুল খাবার কেনার ধকল সামলাতে হয়। অন্যদিকে রোজার ক্ষেত্রে খাবারের ধরন নয়; খাবারটা খাওয়া মূখ্য। যারা ইতোমধ্যে সামষ্টিকভাবে একটি সীমাবদ্ধ ক্যালোরি সংখ্যা পূরণের লক্ষ্যে অগ্রসর হচ্ছেন, তাদের জন্য এটি একটি কার্যকর বিকল্প।
রোজা দীর্ঘ মেয়াদে বয়সের পরিবর্তনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ
বয়স ৪০ পেরোনোর পর শরীরে ইনসুলিনের কার্যকর ব্যবহারে তারতম্য দেখা দেয়। তাই স্বাভাবিকভাবেই ২৫ বছর বয়সের ডায়েট এবং চল্লিশোর্ধ বয়সের ডায়েট এক রাখার উপায় নেই। দীর্ঘ ১৫ বছরে দেহে খাদ্য কেন্দ্রিক সমূহ পরিবর্তন সাধিত হয়। সেক্ষেত্রে ৪০ বছরের বেশি শরীরে ২৫ বছর বয়সের কাছাকাছি দৈহিক অবস্থা পেতে দরকার সূক্ষ্ম হিসাব-নিকাশ। সেখানে রোজা যে কোনো বয়সের জন্যই উপযোগী।
বিশেষ করে ৪০ বছরের বেশি বয়সী মহিলাদের রোজা রাখা উচিত, কারণ এটি বর্ধিত ইনসুলিন প্রতিরোধে সহায়তা করবে। ৪০-এর পরে উপবাস হরমোনের পরিবর্তনে সাহায্য করতে পারে। একই সঙ্গে ওজন কমানোর ক্ষেত্রেও এটি মোক্ষম হাতিয়ার।
ডায়েট করার চেয়ে রোজা রাখা সহজ
খাদ্যের ধরনের ভিত্তিতে বিভিন্ন খাদ্যের ব্যাপারে বিভিন্ন বয়সের মানুষের মানসিক অবস্থা থাকে বিভিন্ন রকম। কৈশোরের প্রিয় খাবারটি সুস্বাস্থ্যের তাগিদে যৌবনে বিসর্জন দেওয়া যেতেই পারে। কিন্তু ২৪-২৫ বছর বয়সে বহু কষ্টে আয়ত্ত্বে আনা অপ্রিয় অথচ স্বাস্থ্যকর খাবারটি ৪০ বছর পর্যন্ত টেনে নিয়ে যাওয়াটা দুষ্কর। ক্যালোরির হিসাবের জটিলতা বাদ দিলেও খাদ্য তালিকাটি সময়ের সঙ্গে কঠিন বা বিরক্তিকর প্রতীয়মান হয়।
রোজার বিষয়টি এমন নয়। কেননা এখানে সুস্পষ্ট খাদ্য তালিকার বদলে রয়েছে খাদ্যাভ্যাস। অবশ্য দীর্ঘক্ষণ উপোসের কারণে ক্ষুধার কষ্ট এখানে একটি বড় চ্যালেঞ্জ। তবে এটি ভিন্ন বয়সে দেহের উপর খাবারের প্রতিক্রিয়া অপেক্ষা উত্তম। তাছাড়া সারাদিনে দু-এক বার আহারের চেয়ে ঘণ্টাখানেক পর পর খাওয়া-দাওয়াতে শারীরিক বিড়ম্বনা আশঙ্কা বেশি থাকে।
এর বাইরেও রোজা অভ্যাসে পরিণত হলে কিটোনের মাত্রা বাড়তে থাকায় ক্ষুধা কমতে থাকে। ধীরে ধীরে এক সময় এটি ভরপেটের গ্যাস্ট্রিকসহ নানা সমস্যা থেকে দুশ্চিন্তামুক্ত রাখে এবং ভালো লাগা অনুভূতি দেয়।
একটি স্বাস্থ্যকর ওজন বজায় রাখার মূলমন্ত্র ক্যালোরি নিয়ন্ত্রণ- এমন বিশ্বাস দীর্ঘকাল ধরে চলে আসছে। এর পুঙ্খানুপুঙ্খ যাচাই না করেই স্বাস্থ্য সচেতন প্রত্যেকেই এর পেছনে অনেক শক্তি ও সময় খরচ করেন। কিন্তু বিজ্ঞান এর পাশাপাশি আরও একটি বিষয়কে যুক্ত করে। একটি সুস্থ শরীর ও মন উভয়ের জন্য রক্তে শর্করার মাত্রা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ।
বার বার কম ক্যালোরির খাবার গ্রহণের ফলে অবশ্যই চর্বি হ্রাস এবং বিপাকীয় উন্নতি ঘটে। তবে এটি দীর্ঘ মেয়াদে কাঙ্ক্ষিত ফলাফল দিতে পারে না।
মানবদেহ কোনো একদিকে ঘাটতি পেলে সময়ের সঙ্গে প্রয়োজন অনুযায়ী তার ভারসাম্য করে নিতে পারে। যখন দীর্ঘ সময়ের জন্য সীমাবদ্ধ ক্যালোরির খাবার খাওয়া হয়, তখন ক্ষুধা-তৃষ্ণা বৃদ্ধি পায়।
এ অবস্থায় মস্তিষ্ক নিয়মিত ক্যালোরি গণনার প্রবণতা হারায়। কিন্তু অন্যদিকে শরীরের ওজন কমানোর শক্তিশালী তাগিদটা হতাশার দিকে ধাবিত করে। এতে করে স্ট্রেস হরমোন ও কর্টিসলের নিঃসরণ এবং রোগ-প্রতিরোধ ব্যবস্থার পরিবর্তন হয়।
হরমোনের ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য পেশীতে ভরের ভারসাম্যতা প্রয়োজন, যেটি বিপাকীয় সুস্বাস্থ্যের জন্যও দরকারি। কিন্তু দীর্ঘ পরিসরে ডায়েটে চর্বিহীন পেশীর ভর হ্রাস পেতে পারে। এমনকি এতে পুষ্টির ঘাটতিরও আশঙ্কা থাকে।
এছাড়া গভীর ভাবে খেয়াল করতে দেখা যায়, ক্যালোরি গণনা করাটা এক রকম মানসিক প্রশান্তি ছাড়া আর কিছুই নয়। বিশেষ করে দীর্ঘ সময়ের জন্য চিন্তা করলে এটি মানসিক অসুবিধাও বটে। কারণ এটি প্রায়ই নিজের প্রতি অসন্তোষ, সমাজের অন্য সবার থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেওয়া, এবং খাবারের প্রতি রীতিমত ভীত সন্ত্রস্ত করে তোলে। চূড়ান্ত পর্যায়ে মানুষকে এটি দ্বিধাদ্বন্দ্বের ভেতর দিয়ে পরিচালিত করে।
অন্যদিকে রোজা স্বাস্থ্যকর ওজনের মাত্রা এবং সাধারণ সুস্থতা পরিচালনার একটি দারুণ উপায়। এটি জীবাণু প্রতিরোধ করে স্বাস্থ্যকর হজমের মাধ্যমে অন্ত্রের সামগ্রিক সুস্থতা দান করে। পরোক্ষ ভাবে এটি পূর্ণাঙ্গ বিশ্রাম ও আরামদায়ক ঘুমের জন্যও উপকারী।
শেষাংশ
এই বৈজ্ঞানিক কারণগুলো রোজা রাখাকে ডায়েট করা অপেক্ষা বেশি গুরুত্ব দেয়। মূলত শুধুমাত্র কৈশোর আর যৌবনই নয়; জীবনের প্রতিটি পর্যায়েই সুস্থ শরীর কাম্য। তাই খাবার নিয়ে অঙ্ক কষার ঝামেলা এড়াতে রোজার প্রতি মনোনিবেশ করা যেতে পারে।
নিদেনপক্ষে, একক ভাবে ক্যালোরি গণনার প্রতি গুরুত্বারোপ না করে রক্তে শর্করার ভারসাম্যের ব্যাপারেও সতর্ক থাকা জরুরি। তবে বিরামহীন আহার থেকে বিরত থাকার পর রোজা ভাঙার পর খাদ্য গ্রহণ যেন মাত্রাতিরিক্ত না হয়ে যায়। রোজার স্বাস্থ্য সম্মত ফলাফল পেতে হলে এখানেও দিতে হবে পরিমিত বোধের পরিচয়।