দেশের দুর্নীতিবাজ রাঘববোয়ালরা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার পর তাদের বিরুদ্ধে দেশত্যাগের নিষেধাজ্ঞা জারির ঘটনায় আরেকবার যথার্থতা প্রমাণিত হচ্ছে। যদিও অনেকে মনে করেন, দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত ওইসব প্রভাবশালীকে ‘সেইফ এক্সিট’ বা নিরাপদে প্রস্থানের সুযোগ দেওয়ার পরই এসব নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়।
ছেলের ছাগলকাণ্ডে আলোচিত জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সদস্য মো. মতিউর রহমান, স্ত্রী লায়লা কানিজ ও ছেলে আহমদ তৌফিকুর রহমানের বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন আদালত। এর আগে তিনি দেশ ত্যাগ করেছেন বলে জানা গেছে।
সোমবার ঢাকা মহানগরের জ্যেষ্ঠ বিশেষ জজ মোহাম্মদ আসসামছ জগলুল হোসেন এই আদেশ দেন।
এদিকে আদালতের নিষেধাজ্ঞার আগেই মতিউর রহমান অতিগোপনে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সীমান্তপথ দিয়ে অবৈধভাবে ভারতের আগরতলায় প্রবেশ করেছেন বলে পরিবারের ঘনিষ্ঠ সূত্রে জানা গেছে। আর তার আগেই দ্বিতীয় স্ত্রী শাম্মী আখতার শিভলী, ছেলে মুশফিকুর রহমান ইফাত ও ইরফান পাড়ি জমিয়েছে মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে। এ অবস্থায় অনুসন্ধান কাজ এগিয়ে নিতে মতিউর ও তার পরিবারের সদস্যদের সম্পর্কে তথ্য-উপাত্ত চেয়ে বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ), জাতীয় রাজস্ব রোর্ড (এনবিআর) ও বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এক্সচেঞ্জ কমিশনসহ (বিএসইসি) বেশ কয়েকটি সংস্থায় চিঠি দিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। একই সঙ্গে তাদের বিদেশযাত্রা ঠেকাতে পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের (এসবি) ইমিগ্রেশন শাখায় চিঠি পাঠানো হয়েছে।
অন্যদিকে সোমবার সোনালী ব্যাংকের পরিচালকের পদ থেকেও মতিউরকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। তার জায়গায় নিয়োগ দেওয়া হয়েছে নতুন পরিচালক। এর আগে রোববার এনবিআরের কাস্টমস এক্সসাইজ ও ভ্যাট অ্যাপিলেট ট্রাইব্যুনালের প্রেসিডেন্ট পদ থেকে তাকে সরিয়ে দেওয়া হয়। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগে সংযুক্ত করা হয়েছে তাকে। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে উল্লিখিত তথ্য পাওয়া গেছে।
দুর্নীতি দমন কমিশনের আইনজীবী মীর আহমেদ আলী বলেন, জাতীয় এনবিআর সদস্য মো. মতিউর রহমানের বিরুদ্ধে দুর্নীতির মাধ্যমে বিপুল সম্পদ অর্জনের অভিযোগ পাওয়া গেছে। হুন্ডির মাধ্যমে বিদেশে বিপুল অঙ্কের অর্থ পাচারের অভিযোগও আছে। এসব অভিযোগ অনুসন্ধান করছে দুদকের তিন সদস্যের টিম। এ অবস্থায় মতিউর রহমান ও তার পরিবারের সদস্যরা বিদেশে পালিয়ে যেতে পারেন। এজন্য তাদের বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা চেয়ে আদালতে আবেদন করেছে দুদক। আদালত সেই আবেদন মঞ্জুর করেছেন।
দুদক সূত্র জানায়, মতিউর রহমানসহ পরিবারের তিন সদস্যের বিদেশযাত্রা ঠেকাতে এসবির ইমিগ্রেশন শাখায় চিঠি দিয়েছে দুদক। এই পরিবারের নামে থাকা বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের তথ্য চেয়ে বিএফআইইউকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। এছাড়া তাদের নামে দেশের কোন কোন এলাকায় জায়গাজমি রয়েছে সেসব দলিলসংক্রান্ত বিষয়ে তথ্য-উপাত্ত চেয়ে নিবন্ধন অধিদপ্তরের মহাপরিদর্শকের কাছে চিঠি পাঠিয়েছেন অনুসন্ধান দলের প্রধান। বিএসইসি চেয়ারম্যানকে পাঠানো চিঠিতে যেসব কোম্পানিতে মতিউর রহমান ও তার পরিবারের সদস্যদের নামে বিনিয়োগ আছে সেসব তথ্য জানাতে বলা হয়েছে।
জানা গেছে, গণমাধ্যমে খবর প্রকাশের পর থেকেই আত্মগোপনে চলে গেছেন মতিউর ও তার দুই পরিবারের সদস্যরা। ঈদের দুই দিন পর থেকে মতিউরের সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে না। বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা, কাকরাইল ও ধানমন্ডির বাসায় গিয়েও তার দুই পরিবারের কোনো সদস্যকে পাওয়া যায়নি। ঈদের পর অফিস খুললেও তিনি যোগদান করেননি। তিনি রোববার ব্রাহ্মণবাড়িয়া সীমান্ত পথে অবৈধভাবে ভারত পাড়ি জমান বলে জানা গেছে। এর আগেই দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী শাম্মী আখতার ও তার দুই ছেলে ঈদের দুই দিন পরই কুয়ালালামপুরের উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করেন। তার প্রথম স্ত্রী লায়লা কানিজ ও ছেলে তৌফিকুর রহমানেরও কোনো হদিস নেই। তবে এ ঘরের মেয়ে ফারহানা রহমান ইপ্সিতা আগে থেকেই কানাডায় আছেন। এ অবস্থায় দুদকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে মতিউর ও তার প্রথম পক্ষের স্ত্রী ও ছেলের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দিলেন আদালত।
অনুসন্ধানে মতিউর রহমানের একটি পাসপোর্ট নম্বর পাওয়া গেছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ওই পাসপোর্ট ব্যবহার করে তিনি সবশেষ ২০২৩ সালের ৭ জুলাই কানাডা থেকে দেশে ফেরেন। এরপর ওই পাসপোর্ট ব্যবহার করে তিনি দেশের বাইরে যাননি।
আখাউড়া সীমান্ত দিয়ে অবৈধভাবে ভারতে যাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা পুলিশ সুপার মো. শাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘ব্রাহ্মণবাড়িয়া স্থলবন্দর দিয়ে মতিউরের ভারতে যাওয়ার কোনো তথ্য নেই ইমিগ্রেশনে। আর অবৈধভাবে তার ভারতে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই।’
জানা গেছে, ১১তম বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ১৯৯৩ সালের ১ এপ্রিল ট্রেড ক্যাডারের কর্মকর্তা হিসাবে চাকরিতে যোগ দেন মতিউর রহমান। এক পর্যায়ে ট্রেড ক্যাডার একীভূত করা হলে মতিউর অ্যাডমিন ক্যাডারে না গিয়ে কৌশলে যোগ দেন কাস্টমস ক্যাডারে। এর আগে ১৯৯০-১৯৯৩ সাল পর্যন্ত পল্লী কর্মসংস্থান ফাউন্ডেশনে (পিকেএসএফ) চাকরি করেন তিনি। বরিশালের মুলাদী উপজেলার বাহাদুরপুর গ্রামের আব্দুল হাকিম হাওলাদারের ছেলে মতিউর কাস্টমসে যোগ দিয়েই অর্থ-সম্পদের লোভে বেপরোয়া হয়ে ওঠেন বলে অভিযোগ আছে।
একাধিক সূত্রে জানা গেছে, ২০০০ সালের দিকে সেগুনবাগিচায় কাস্টমস বন্ড অফিসে যোগ দেন মতিউর। সেখানে কর্মরত অবস্থায় বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগে তাকে বদলি করা হয় টেকনাফে। বদলির ছয় মাসের মধ্যে অবৈধ প্রভাব কাজে লাগিয়ে ঢাকার শুল্ক ও গোয়েন্দা বিভাগে পোস্টিং বাগিয়ে নেন। দীর্ঘদিন এখানে দায়িত্ব পালন করে ২০০৬ সালের শেষদিকে তিনি বদলি হন চট্টগ্রাম বন্দর হাউজে। তখন থেকেই টাকার মেশিনে পরিণত হন মতিউর।
সোনালী ব্যাংক থেকেও অপসারিত : সোমবার অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ পৃথক দুই চিঠিতে মতিউরকে অপসারণ ও নতুন পরিচালক নিয়োগের এ আদেশ দিয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব ড. মোহাম্মদ আবু ইউসুফকে তিন বছরের জন্য সোনালী ব্যাংকের পরিচালক হিসাবে নিয়োগ দেওয়া হয়।
সোনালী ব্যাংকের চেয়ারম্যান জিয়াউল হাসান সিদ্দিকীর কাছে দেওয়া চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব ড. মোহাম্মদ আবু ইউসুফকে যোগ দেওয়ার তারিখ থেকে তিন বছর মেয়াদে সোনালী ব্যাংক পিএলসির পরিচালনা পর্ষদে পরিচালক হিসাবে নিয়োগ দিতে ব্যাংক কোম্পানি আইন, ১৯৯১-এর বিধান অনুযায়ী বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন গ্রহণসহ প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণে নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো।
এর আগে ড. মতিউর রহমানকে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকের পরিচালক পদ থেকে অপসারণ করে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। গত রোববার তাকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) থেকেও সরিয়ে অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগে সংযুক্ত করা হয়। সরকারি প্রজ্ঞাপনে জানানো হয়, বিসিএস (শুল্ক ও আবগারি) ক্যাডারের কর্মকর্তা মতিউর রহমানকে তার বর্তমান পদ থেকে সরিয়ে অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগে সংযুক্ত করা হয়েছে। তবে কেন এ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, প্রজ্ঞাপনে তা উল্লেখ করা হয়নি। বলা হয়েছে, ‘জনস্বার্থে জারিকৃত এই আদেশ অবিলম্বে কার্যকর হবে।’