মোহাম্মদ ওমর ফারুক
রাত দিন কষ্টের শেষ নেই। দাঙ্গা-হাঙ্গামা তো আছেই। পুলিশের প্রতিটি সময় কাটে নানান ঝুঁকিতে। জীবন মৃত্যুর মাঝে কাজ করতে হয় তাদের। এই যখন অবস্থা ,তখন পুলিশের ঝুঁকির ভাতা ধরা হয়েছে ২৯০ টাকা। তা্ও আবার কোনো বরাদ্দ নয়।সেটি পুলিশ বাহিনীতে বেতনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে এ ধরনের কোনো ভাতার ব্যবস্থা নেই। প্রতি বছর থোক বরাদ্দের ভিত্তিতে কনস্টেবল থেকে পরিদর্শক পদমর্যাদার পুলিশ কর্মকর্তাদের মাসিক ৪৩০ টাকা করে ঝুঁকিভাতা দেওয়া হয়। বরাদ্দ না থাকলে আরও কমে যায় টাকার পরিমাণ। গত দেড় বছর ধরে মাস ধরে বিনা ঘোষণায় ১৪০ টাকা কমিয়ে এখন ঝুঁকিভাতা দেওয়া হচ্ছে ২৯০ টাকা। র্যাবের সব সদস্যকে মূল বেতনের ৭০ শতাংশ ঝুঁকিভাতা দেওয়া হয়। সার্বক্ষণিক কর্মরত পুলিশ সদস্যদের মূল বেতনের ৩০ শতাংশ ঝুঁকিভাতা প্রদানের নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়া হলেও তা থেকে বাদ পড়ছেন ইন্সপেক্টর পদমর্যাদার কর্মকর্তারা। পুলিশ ইন্সপেক্টরদের পদমর্যাদা দ্বিতীয় শ্রেণীর ক্যাডার থেকে প্রথম শ্রেণীতে উন্নীত করার অজুহাতে বন্ধ করা হয়েছে তাদের ঝুঁকিভাতা। কিন্তু ইন্সপেক্টরদের ঝুঁকি নিয়ে দায়িত্ব পালন বন্ধ হয়নি মোটেও। ইন্সপেক্টর পদমর্যাদা প্রথম শ্রেণীতে উন্নীত করাটা রীতিমতো গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাদের পোশাক ভাতা দেওয়াও বন্ধ হয়ে গেছে। এই নিয়ে পুলিশের মধ্যে রয়েছে চাপা ক্ষোভ। নাম প্রকাশ না করে কয়েকজন ইন্সপেক্টর পদমর্যাদার কর্মকর্তা বলেন, সারাক্ষণ নানান ঝুঁকিতে কাজ করতে হয়। কিন্তু আমাদের যে ভাতা দেয়া হয় সেটা হাস্যকর।
এদিকে আবাসন ও যানবাহন সংকট কিছুতেই পিছু ছাড়ছে না। ভাড়া করা ভবন ও অন্যের জমিতে চলছে অধিকাংশ থানা, ফাঁড়ি, বক্স, তদন্ত কেন্দ্রের কার্যক্রম। সেসব স্থাপনায় স্থানাভাবে খুবই ঠাসাঠাসি করে বাস করতে হয় পুলিশ সদস্যদের, চালাতে হয় দাপ্তরিক কর্মকাণ্ড। ছোট ছোট কক্ষকে বানানো হয়েছে অস্ত্রাগার, হাজতখানা ও কার্যালয়। কার্যালয়ের চেয়ার টেবিল ভাঙাচোরা। সারা দেশে এ ধরনের সাড়ে চার শতাধিক পুলিশ ফাঁড়ি ও ক্যাম্প অরক্ষিত হয়ে আছে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রায় আট হাজার পুলিশ সদস্যের আবাসস্থল রাজারবাগ পুলিশ লাইন্স। সেখানে কোনো পুলিশ সদস্যের জন্য নির্দিষ্ট বিছানা নেই। এক বিছানাতেই পালা করে একাধিক পুলিশ সদস্য থাকতে বাধ্য হন। একজন ঘুম থেকে উঠে বিছানা ছেড়ে বাথরুমে গেলেও ফিরে এসে আর বিশ্রামের সুযোগ পান না। ততক্ষণে অপেক্ষমাণ অন্য কোনো পুলিশ সদস্য সেই বিছানায় শুয়ে পড়েন। ছারপোকা আর মশার কামড় তাদের নিত্যসঙ্গী, দিনের বেলায়ও ব্যারাকের রুমে রুমে চলে ইঁদুরের ছোটাছুটি। খাবারের সমস্যা আরও প্রকট। রাজারবাগ লাইন্সে খাবার খেলেও বিল, না খেলেও বিল দিতে হয়।
নামপ্রকাশ না করে লেটেস্ট বিডি নিউজকে একজন কনস্টেবল বলেন \’আমি পুলিশ- প্রজাতন্ত্রের বেতনে জনগণের সেবক। আমার হাত, পা, মুখ বাঁধা-নানা অত্যাচার-নিপীড়ন সহ্য করেও আমার মুখ খুলতে মানা। আমি শ্রম আইনের কথা বলতে পারি না, বলি না ওভারটাইমের কথা। বেতন-ভাতা বৃদ্ধি, নিশ্চিত আবাসন, নূ্যনতম বেঁচে থাকার সুযোগ-সুবিধার কোনো কিছু আমি চাইতে পারি না।
সরকারি দায়িত্ব পালন করতেও নিজের টাকায় কিনতে হয় মোটরসাইকেল ও জ্বালানি। থানায় আটককৃতদের খাওয়াতে হয় নিজের টাকায়। সোর্সকে টাকা দিতে হয় নিজের পকেট থেকে। অধিকাংশ মামলার বাদী-সাক্ষীরা গরিব বলে আদালতে সাক্ষ্য দেওয়ার ক্ষেত্রে তাদের চরম অনীহা। তাদের যাতায়াত ভাড়া দিয়ে আদালতে হাজির করার দায়িত্বও পালন করতে হয় পুলিশকেই। লাশ পরিবহনের বিলটাও পরিশোধ করতে বাধ্য হতে হয়। অথচ এসব খাতে সরকারি বরাদ্দ আছে, বিল প্রস্তুত করে মাসে মাসে তাগিদ দিলে বছর শেষে কিছু পাওয়া যায়। এতসব ঝক্কিতে খাজনার চেয়ে বাজনার দাম বেশি হয় বলে নিজের পকেট থেকেই যাবতীয় ব্যয় মেটাতে বাধ্য হন দারোগারা।
অধিকাংশ পুলিশ সদস্যকে ১২ থেকে ১৬ ঘণ্টা পর্যন্ত ডিউটি করতে হয়। তাদের অবকাশ যাপনের কোনো ব্যবস্থা নেই। একটানা কাজ করতে গিয়ে অনেকের জীবনীশক্তি ক্ষয়ে যায়, রোগবালাই হয়ে ওঠে নিত্যসঙ্গী। সরকারি অন্যান্য সার্ভিসের কর্মচারীরা যখন ছুটিতে পরিবার-পরিজন নিয়ে আনন্দ করেন তখনো পুলিশকে রাস্তায় দাঁড়িয়েই দায়িত্ব পালন করতে হয়। হরতালের সময় পুরো অফিসপাড়ায় যখন ছুটির আমেজ, তখন রায়ট গিয়ার পরে পুলিশকে থাকতে হয় মিছিলের সঙ্গে সঙ্গে। বোমা-গুলির শব্দে সবাই যখন জান-মাল রক্ষায় পালাতে ব্যস্ত, তখনও পুলিশকে ছুটে যেতে হয় বোমা-গুলির চরম ঝুঁকির স্থানে।
তবে এসব নিয়ে পুলিশ সদর দপ্তরের কেউ কথা বলতে রাজি হননি।