মোহাম্মদ ওমর ফারুক
হাত বাড়ালেই মিলে ইয়াবা। গ্রামে-গঞ্জে, পাড়া-মহল্লায় এখন ইয়াবা বেচাকেনা হয়। আর এসব ঘটনায় প্রতিনিয়ত হচ্ছে মামলা। পুলিশ সদর দপ্তর জানিয়েছে,সারাদেশে প্রতিমাসে গড়ে ৬ হাজার মাদক সংক্রান্ত মামলা হয়। এ হিসাবে প্রতিঘণ্টায় গড়ে মামলা হচ্ছে ১১টি। কিন্তু মাদকের মামলায় সাজা হয়েছে এমন সংখ্যা খুবই কম। সঠিক তথ্য প্রমাণসহ নানান কারনে এসব মামলার বিচার করা যায় না।
জানা গেছে,এসব মামলা প্রমানের জন্য উদ্ধারকৃত মাদকদ্রব্যের রাসায়নিক পরীক্ষা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অথচ হাজার হাজার মামলার আলামত পরীক্ষার জন্য দেশে রাসায়নিক পরীক্ষাগার আছে মাত্র একটি। প্রতি মাসে গড়ে বিভিন্ন মাদকের মামলায় প্রায় ৬ হাজার মাদকের নমুনা রাসায়নিক পরীক্ষার জন্য আসে কেন্দ্রীয় রাসায়নিক পরীক্ষাগারে। সে হিসাবে দিনে ২০০টি এবং ঘণ্টায় ২৫টি মাদকের রাসায়নিক পরীক্ষা করা হচ্ছে। আর এর বিপরীতে কেমিস্ট আছেন মাত্র ৫জন। লোকবলের অভাবে গলদঘর্ম হতে হচ্ছে কেমিস্টদের। অথচ মাদক মামলায় গ্রেফতারকৃতদেরর সাজা হওয়া না হওয়া নির্ভর করছে এই পরীক্ষার রিপোর্টের উপর। এ প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় রাসায়নিক পরীক্ষাগারের প্রধান পরীক্ষক ড. দুলাল কৃষ্ণ সাহা লেটেস্ট বিডি নিউজকে বলেন, আমরা সর্বোচ্চ কম সময়ের মধ্যে রিপোর্ট দেয়ার চেষ্টা করি। গত বছরও ৬৭ হাজার ৭শ ১৩টি রিপোর্ট দেয়া হয়েছে, যার সবগুলোই পজিটিভ। তিনি বলেন, জনবল সঙ্কট আছে এটা সত্যি।
রাজধানীর গেন্ডারিয়ায় ২০০০ সালে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কেন্দ্রীয় রাসায়নিক পরীক্ষাগারটি নির্মিত হয়। এই ১৭ বছরে মাদকের বিস্তার ঘটেছে কয়েক গুণ। বেড়েছে মাদকের মামলার সংখ্যা, কিন্তু বাড়েনি মাদক পরীক্ষার ল্যাব, প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি, জনবল। সময় মতো রিপোর্ট দিতে না পারায় মাদকের মামলার দীর্ঘসূত্রিতা বেড়েই চলেছে। যার সুযোগ নিচ্ছে মাদক ব্যবসায়ী ও মাদকসেবীরা।
রাজধানীর কদমতলী, শ্যামপুর, যাত্রাবাড়ী ও মতিঝিল থানা এলাকার কয়েকজন মাদক ব্যবসায়ীর সাথে কথা বলে জানা গেছে, ২/৩ বছর আগে মাদকসহ ধরা পড়ে মামলা হয়েছে এমন বেশ কয়েকজন মাদক ব্যবসায়ী এখনও চুটিয়ে ব্যবসা করে যাচ্ছে। কারও কারও বিরুদ্ধে কয়েক বছরের বেশ কয়েকটি মামলা হয়েছে। অথচ সবগুলো মামলাই বিচারাধীন। জামিনে বেরিয়ে চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ীরা দিব্যি আগের মতোই ব্যবসা করে যাচ্ছে। স্থানীয় বাসিন্দারাও এ নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। স্থানীয় সূত্র জানায়, কদমতলী থানার ধোলাইপাড়ের মাদক ব্যবসায়ী চায়না বাবুল মাদকসহ ধরা পড়েছিল ২ বছর আগে। সেই ঘটনায় মামলাও হয়েছিল। ৬ মাস আগেও বাবুল আবার মাদকসহ গ্রেফতার হয়। তাতেও পৃথক মামলা হয়েছে। কিন্তু চায়না বাবুল আগের মতোই মাদক ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। ধোলাইপাড়ের আরেক মাদক ব্যবসায়ী ফারুক ও তার ভাই রাসেলের বিরুদ্ধে মাদক আইনে মামলা হয়েছিল ৪ বছর আগে। সে মামলা এখনও চলমান থাকলেও ফারুক-রাসেল থেমে নেই। যাত্রাবাড়ীর মাদক ব্যবসায়ী রতন ও রুবেল প্রায় ৩ বছর আগে নকল ইয়াবা তৈরীর যান্ত্রাংশসহ গ্রেফতার হয়েছিল। জামিনে বেরিয়ে এসে এখনও তারা আগের মতোই চুটিয়ে ব্যবসা করছে। কদমতলীর আরেক মাদক ব্যবসায়ী রিপনের বিরুদ্ধে ৩ বছর আগে মামলা হয়েছিল। মামলা নিষ্পত্তি না হওয়ায় এখনও সে আগের মতোই বেপরোয়া। মাদকাসক্তদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রতিদিন নতুন নতুন বিক্রেতার সৃষ্টি হলেও পুরাতন বিক্রেতাদের উপর তারা সহজেই আস্থা রাখতে পারে। পুরাতন ব্যবসায়ীরা বার বার মামলার আসামী হওয়ায় তাদের ব্যাপক পরিচিতি আছে। এতে করে সাধারন মানুষ তাদেরকে ভয় পায়। শুধু তাই নয়, পুলিশি ঝামেলা থেকেও তারা নিজেদের এবং ক্রেতাদের মুক্ত রাখতে পারে। সাথে স্থানীয় প্রভাবশালীদের আশির্বাদতো আছেই।
জানা গেছে, সারাদেশে মাদকের ভয়াল বিস্তারের মধ্যে এখন চলছে ইয়াবার ভয়াবহ আগ্রাসন। ইয়াবার আগ্রাসনের কাছে প্রশাসনও অসহায়। নদী ও সড়ক পথ হয়ে ইয়াবার চালান পৌঁছে যাচ্ছে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে। এর বিস্তৃত নেটওয়ার্কের কাছে সহজেই পরাজিত হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। আকার ছোট বলে হাতে হাতে এটি ছড়িয়ে পড়ছে পাড়া-মহল্লা, অলিতে-গলিতে। মিয়ানমার থেকে প্রতিদিনই আসছে ইয়াবার বড় বড় চালান। মাঝে মধ্যে আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর অভিযানে ইয়াবার চালান ধরাও পড়ছে। তবে অভিযোগ রয়েছে, যে পরিমাণ ইয়াবা ধরা পড়ছে তার অন্তত দশগুণ নিরাপদে পাচার হয়ে যাচ্ছে। একটি বেসরকারী সংস্থার হিসাব মতে, প্রতিদিন রাজধানীতে ১২ থেকে ১৫ লাখ পিস ইয়াবা বেচাকেনা হয়। মাদকের স্রোতের মধ্যে আবার ঢুকে গেছে নকল ইয়াবা। মাদকসেবীরা ইয়াবার নামে যা ব্যবহার করছে এর বড় অংশ নকল। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় নকল ইয়াবা তৈরির কারখানারও সন্ধান পাওয়া গেছে। তবে বিভিন্ন সময় রাসায়নিক পরীক্ষাতে উদ্ধার করা বেশিরভাগ ইয়াবায় এর মূল উপাদান পাওয়া যায়নি।
জানা গেছে, ২০১৪ সালে সারাদেশে শুধু র্যাবের হাতে ধরা পড়ে সাড়ে চার হাজার ইয়াবা ব্যবসায়ী। ২০১৫ সালে এ সংখ্যা ছিল সাড়ে ছয় হাজার। এরপরের বছরগুলোতে পর্যায়ক্রমে এ সংখ্যা বাড়তেই থাকে। এদের মধ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যও আছে। কিন্তু এসব গ্রেফতারের ঘটনায় দায়েরকৃত মামলার খুব একটা অগ্রগতি হয় নি। বরং সেগুলো ঝুলে আছে। বড় বড় চালান উদ্ধারের মামলার আসামীও জামিনে বেরিয়ে এসে আবার পুরনো ব্যবসা নেমে পড়ছে। ডিএমপির উপ-কমিশনার (মিডিয়া) মাসুদুর রহমান লেটেস্ট বিডি নিউজকে বলেন, শুধু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপর নির্ভর করে মাদকের প্রসার ঠেকানো যাবে না। এজন্য সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। তিনি বলেন, মাদকের বিরুদ্ধে পুলিশের অভিযান অব্যাহত আছে। মাদকের প্রসার ও বেচাকেনা ঠেকাতে সামাজিকভাবে প্রতিরোধ গড়ে তোলার উপর গুরুত্বারোপ করে তিনি বলেন, পুলিশ সে লক্ষ্যেও কাজ করছে।