দুর্নীতির মামলায় ১০ বছরের সাজাপ্রাপ্ত আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য (এমপি) হাজী সেলিমকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে নেওয়া হয়েছে। আর আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী, তাকে কারাগারে প্রথম শ্রেণির মর্যাদা প্রদান ও কারাগারের তত্ত্বাবধানে দেশের উন্নতমানের হাসপাতালে ‘বেটার ট্রিটমেন্ট’ দিতে বলা হয়েছে।
আজ রোববার (২২ মে) সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান রাতে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের জেলার মাহবুবুল আলম। তিনি বলেন,তাকে বহন করা পুলিশের গাড়িটি সন্ধ্যা ৬টার দিকে কারাগারে পৌঁছে ।
জেলকোড অনুযায়ী ডিভিশন-১ দেওয়া কিংবা উন্নতমানের চিকিৎসার প্রয়োজনীয়তা থাকলে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেন আদালত। সে অনুযায়ীই হাজী সেলিমকে ডিভিশন-১ এ পাঠানো হয়েছে বলেও জানান তিনি।
মহানগর দায়রা জজ আদালতে জেলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়েই আদালতে আত্মসমর্পণ করেন তিনি। এর আগে সকালে হাজী সেলিম অসুস্থ বিবেচনায় যে কোনো শর্তে জামিন এবং কারাগারে প্রথম শ্রেণির মর্যাদা চেয়ে আদালতে আবেদন করেন তার আইনজীবী।
তবে জামিন শুনানি শেষে আদালত তার আবেদন নাকচ করে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। এসময় একদিনের জন্য হলেও তাকে জেলে যেতে হবে বলে মন্তব্য করেন আদালত।
রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজল বলেন, দুদকের পক্ষ থেকে তার জামিনের বিরোধিতা করা হয়। বলা হয়, এ আইনে তাকে কোনোভাবে বেল দেয়া যাবে না। সুতরাং আদালত তার জামিনের আবেদন নামঞ্জুর করেছেন।
বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৭ এর বিচারক শহিদুল ইসলামের আদালত তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন বলেও জানান তিনি।
হাজী সেলিমের আইনজীবী প্রাণ নাথ জানান, হাজী সেলিম আদালতে উপস্থিত হবার পর এ আবেদনের শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। এছাড়া উন্নত চিকিৎসা এবং কারাগারে ডিভিশন চেয়ে আদালতে আবেদন করা হয়েছিল। সকাল সাড়ে ১০টার দিকে আদালতে জামিনের আবেদন করে আত্মসমর্পণ করেন তিনি। চেম্বার জজ আদালতে বেল পিটিশন করা হবে।
আরও পড়ুন: হাজী সেলিমের মামলার আদ্যোপান্ত
গত ১০ ফেব্রুয়ারি এ মামলায় হাজী সেলিমের ১০ বছরের কারাদণ্ড বহাল রেখে হাইকোর্টের দেয়া পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়। রায়ের অনুলিপি পাওয়ার ৩০ দিনের মধ্যে তাকে ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৭-এ আত্মসমর্পণ করতে বলা হয়।
এ মামলায় ১৩ বছর আগে বিচারিক আদালতের রায়ের পর তাকে মাসখানেক কারাগারে থাকতে হয়েছিল। পরে রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করে জামিনে বের হন তিনি। মাঝের এ সময়ে তিনি দু’বার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
হাজী সেলিম ও তার স্ত্রী গুলশান আরার বিরুদ্ধে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন এবং সম্পদের তথ্য গোপনের অভিযোগে ২০০৭ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
বিচারিক আদালত ২০০৮ সালের ২৭ এপ্রিল রায় দেন। রায়ে হাজী সেলিমের ১৩ বছরের কারাদণ্ড হয়। জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের দায়ে তাকে ১০ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়। পাশাপাশি তাকে ১০ লাখ টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও ১ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়। আর সম্পদের তথ্য গোপনের দায়ে তাকে ৩ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়। উভয় দণ্ড একসঙ্গে চলবে বলে রায়ে উল্লেখ করা হয়।
অবৈধ সম্পদ অর্জনে হাজী সেলিমকে সহযোগিতা করার দায়ে তার স্ত্রী গুলশান আরাকে ৩ বছরের কারাদণ্ড, ১ লাখ টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও ৬ মাসের কারাদণ্ড দেয়া হয়। একই সঙ্গে এই দম্পতির অবৈধভাবে অর্জিত প্রায় ২৭ কোটি টাকার সম্পদ রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত করার আদেশ দেয়া হয়।
বিচারিক আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে ২০০৯ সালে হাজী সেলিম এবং ২০১৩ সালে তার স্ত্রী আলাদা আপিল করেন।
হাজী সেলিমের আপিলের ওপর শুনানি শেষে ২০১১ সালের ২ জানুয়ারি তার সাজা বাতিল করে রায় দেন হাইকোর্ট। এই রায়ের বিরুদ্ধে দুদক আপিল বিভাগে আবেদন করে।
দুদকের আপিলের শুনানি নিয়ে ২০১৫ সালের ১২ জানুয়ারি হাইকোর্টের দেয়া রায় বাতিল করেন আপিল বিভাগ। সেই সঙ্গে হাইকোর্টে হাজী সেলিমের আপিলের ওপর আবার শুনানি করতে বলা হয়।
হাজী সেলিমের স্ত্রী গুলশান আরা ২০২০ সালের ২৯ নভেম্বর মারা যান। গত বছরের ৩১ জানুয়ারি হাজী সেলিমের আপিলের ওপর হাইকোর্টে শুনানি শুরু হয়। সঙ্গে তার স্ত্রীর করা আপিলটিও হাইকোর্টে শুনানির জন্য ওঠে। হাজী সেলিম দম্পতির করা আলাদা আপিলের ওপর শুনানি শেষে গত বছরের ৯ মার্চ হাইকোর্ট রায় ঘোষণা করেন।
জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের দায়ে হাজী সেলিমকে বিচারিক আদালতের দেয়া ১০ বছরের সাজা বহাল রাখেন হাইকোর্ট। তবে সম্পদের তথ্য গোপনের জন্য বিচারিক আদালতের দেওয়া তিন বছরের কারাদণ্ড থেকে তাকে খালাস দেয়া হয়। হাজী সেলিমের স্ত্রী গুলশান আরা মারা যাওয়ায় তার আপিলটি বাতিল (অ্যাবেট) করা হয়।
হাজী সেলিম সম্প্রতি কঠোর গোপনীয়তায় দেশ ছেড়েছিলেন। তার এই দেশত্যাগ নিয়ে নানা মহলে সমালোচনা হয়। দণ্ড নিয়ে তাকে দেশত্যাগে যারা সহযোগিতা করেছিলেন, তাদের শাস্তির দাবি ওঠে। পরে তিনি দেশে ফেরেন।