তিন বছরে সাইবার মামলা বেড়েছে ২শ গুন

মোহাম্মদ ওমর ফারুক
দিনে দিনে বেড়েই চলেছে সাইবার অপরাধ। অঙ্কের হিসাবে তিন বছরে এই মামলা বেড়েছে প্রায় ২০০ গুণ। আর এসব মামলার প্রায় সবই করা হচ্ছে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইনের বিতর্কিত ৫৭ ধারায়। ধারাটি অজামিনযোগ্য।

বাংলাদেশের একমাত্র সাইবার ট্রাইব্যুনালের সূত্রে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তিনটি মামলা নিয়ে ট্রাইব্যুনালের কাজ শুরু হয়। কিন্তু পরের বছর ট্রাইব্যুনালে আসে ৩২টি। ২০১৫ সালে বিচারের জন্য আসে ১৫২টি মামলা। আর চলতি বছরের ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিচারের জন্য মামলা এসেছে ১৫৬টি। এর বাইরে তদন্ত পর্যায়ে আছে ২৫০টি মামলা। অর্থাৎ বিচারাধীন ও তদন্তাধীন মিলে মোট মামলা ৫৯৩টি।
সাইবার ট্রাইব্যুনালের সরকারি কৌঁসুলি নজরুল ইসলাম বলেন, তিন বছরে সাইবার অপরাধের মামলা বেড়েছে প্রায় ১৯৬ গুণ। আর মামলাগুলোর অধিকাংশই (৯৪ শতাংশ) করা হয়েছে ৫৭ ধারায়।

সাইবার ট্রাইব্যুনালে নিষ্পত্তি হওয়া মামলার হিসাব পর্যালোচনা করে দেখা যাচ্ছে, আদালতে অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় ৬৬ শতাংশ মামলারই সব আসামি খালাস পেয়েছেন। তার মানে, মাত্র ৩৪ শতাংশ মামলা প্রমাণিত হয়েছে। এর আগে তদন্ত পর্যায়েই মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে ১৩ শতাংশ মামলা। পুলিশ সেগুলোর বিষয়ে আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুরু থেকেই আইনটির ৫৭ ধারা নিয়ে উদ্বেগ করা হচ্ছিল। আইনটির অপব্যবহারের মাধ্যমে লোকজনকে হয়রানির আশঙ্কাও করা হচ্ছিল। সাইবার ট্রাইব্যুনালের তথ্য-উপাত্ত এখন সেই আশঙ্কাকে সত্য করে তুলেছে। পুরো আইনটিই এখন ৫৭ ধারাকেন্দ্রিক হয়ে পড়ছে। সরকারের আইনমন্ত্রী তাঁদের উদ্বেগের সঙ্গে সহমত পোষণ করে ৫৭ ধারা বাতিল বা সংশোধনের বিষয়ে বিভিন্ন সময়ে আশ্বাসও দিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর সেই আশ্বাস আর পূরণ করা হয়নি।

তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারায় বলা আছে, ‘কোনো ব্যক্তি যদি ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়েবসাইটে বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন, যা মিথ্যা ও অশ্লীল বা সংশ্লিষ্ট অবস্থা বিবেচনায় কেউ পড়লে, দেখলে বা শুনলে নীতিভ্রষ্ট বা অসৎ হতে উদ্বুদ্ধ হতে পারেন অথবা যার মানহানি ঘটে, আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটে বা ঘটার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়, রাষ্ট্র ও ব্যক্তির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয় বা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে বা করতে পারে বা এ ধরনের তথ্যাদির মাধ্যমে কোনো ব্যক্তি বা সংগঠনের বিরুদ্ধে উসকানি দেয়া হয়, তা হবে একটি অপরাধ।’

আইনজীবী শাহদীন মালিক মনে করেন, আইনের এই ধারা এত ঢালাও যে, যেকোনো মন্তব্যের জন্যই যে কেউ হয়রানির শিকার হতে পারেন। তিনি বলেন, একদিকে মামলা বেড়ে যাচ্ছে, অন্যদিকে অভিযোগের সত্যতা না পেয়ে আসামিরা অব্যাহতি পাচ্ছেন। এ পরিস্থিতি ৫৭ ধারা বাতিলের দাবির যৌক্তিকতা প্রমাণ করে। আইন অনুযায়ী, ৫৭ ধারার অপরাধ প্রমাণিত হলে ১৪ বছর কারাদন্ড এবং ১ কোটি টাকা অর্থদন্ডে দন্ডিত করতে পারবেন ট্রাইব্যুনাল।

দেখা যায়, ফেসবুকে নারীদের নিয়ে আপত্তিকর ছবি ও অশ্লীল ভিডিও দেওয়ার অপরাধে সবচেয়ে বেশি মামলা হয়েছে ৫৭ ধারায়। ধর্ম অবমাননা এবং গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের নিয়ে ওয়েবসাইট ও ফেসবুকে আপত্তিকর মন্তব্য প্রচারের অভিযোগেও মামলা হচ্ছে এই ধারায়। এ ছাড়া অনলাইনে মানহানিকর সংবাদ প্রচারের অভিযোগে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধেও ৫৭ ধারায় মামলা করা হয়েছে। এ ধরনের কয়েকটি মামলার ক্ষেত্রে অভিযোগের সত্যতা না পেয়ে পুলিশ আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়েছে। হ্যাকিং ও অনলাইনে প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগেও এই আইনের ৫৫ ও ৫৬ ধারায় মামলা হয়েছে।

সাইবার ট্রাইব্যুনালের মামলা পর্যালোচনায় দেখা যায়, তদন্তে ঘটনার সত্যতা না পেয়ে গত তিন বছরে ৪৬টি মামলায় পুলিশ আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। এর মধ্যে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে করা ১০টি মামলার ৪টি রয়েছে। ২০০৬ সালে প্রণীত এই আইনের ৫৭ ধারার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে তিন আইনজীবী হাইকোর্টে রিট করেন। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়ার করা রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে গত বছরের ১ সেপ্টেম্বর হাইকোর্ট ৫৭ ধারা কেন সংবিধান পরিপন্থী ঘোষণা করা হবে না, জানতে চেয়ে রুল জারি করেন।
জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, সারা দেশে ৫৭ ধারায় জ্যামিতিক হারে মামলা বাড়ছে। বহু মানুষ হয়রানির শিকার হয়ে জেল খাটছে। বেশির ভাগ মামলা মানহানির অভিযোগে করা হচ্ছে। ৫৭ ধারায় যে মিথ্যা মামলা হচ্ছে, তার প্রমাণ পুলিশের চূড়ান্ত প্রতিবেদন। কিছু কিছু ক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার জন্য এই ধারার অপপ্রয়োগ হচ্ছে। তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপন করে জানতে চাইলে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহম্মেদ বলেন, সাইবার অপরাধ বাড়ায় মামলা বাড়ছে। তবে কোথাও শতভাগ মামলা প্রমাণিত হওয়ার নজির নেই। আর ৫৭ ধারা থাকবে কি থাকবে না, তা জানা যাবে সাইবার অপরাধ প্রতিরোধ করার জন্য ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন করার পর। প্রস্তাবিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৬ আইন যাচাই-বাছাইয়ের (ভেটিং) জন্য আইন মন্ত্রণালয়ে আছে।

Scroll to Top