মা-ছেলে হত্যা মামলাঃ কোরআনের উদ্ধৃতি দিয়ে যা বললেন আদালত

কাকরাইলে মা-ছেলে হত্যা মামলায় তিন আসামিকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন ঢাকার একটি আদালত। রায়ের পর্যবেক্ষণে বিচারক পবিত্র কোরআনের উদ্ধৃতি দিয়ে স্ত্রী-সন্তানকে হত্যায় স্বামীর নির্মমতার ভূমিকার ব্যাখ্যা দিয়েছেন।

রায়ে আদালত বলেন, মহান আল্লাহ আমাদের যেসকল নিয়ামত দান করেছেন তার মধ্যে সুসন্তান অন্যতম শ্রেষ্ঠ নিয়ামত। সন্তানের আশা ভরসার শেষ আশ্রয়স্থল হলো তার পিতা। আর স্ত্রী হলেন সহধর্মিনী, অর্ধাঙ্গীনী ও সন্তানের জননী। সেকারণে প্রত্যেক স্ত্রী তার স্বামীর কাছে সম্মানের পাত্রী। স্বামীর নিকট স্ত্রীর রয়েছে বহুমাত্রিক অধিকার। স্বামী ও স্ত্রী একে অন্যের সহায়ক ও পরিপূরক। মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআন শরীফে স্বামী-স্ত্রী সম্পর্কে বলেন, ‘তারা তোমাদের আবরণ এবং তোমরা তাদের আবরণ’’। (সূরা: ২ বাকারা, আয়াত ১৮৭)।

পর্যবেক্ষণে আরও বলা হয়, এই মামলায় হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী বা মাস্টারমাইন্ড হলো আসামি আ. করিম, যিনি নিহত শামসুন্নাহারের স্বামী ও সাজ্জাদুল করিম শাওনের পিতা। অথচ আসামি আ. করিম নিজের অসৎ উদ্দেশ্যের ও হীন স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য আসামি শারমিন আক্তার মুক্তা ও আসামি মো. আল আমিন জনির সঙ্গে পূর্ব পরিকল্পনা করে আসামি মো. আল আমিন জনিকে দিয়ে নিজ স্ত্রী ও সন্তানকে নৃঃশংসভাবে হত্যা করিয়েছে। সে কারণে সকল আসামিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া উচিত মর্মে এই আদালত মনে করেন।

এই নির্মম হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে কোরআনের উদ্ধৃতি দিয়ে রায়ে বলা হয়, ইসলাম শান্তি ও সত্যের ধর্ম। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআন শরীফের সূরা মায়িদাহ এর ৩২ নম্বর আয়াতে উল্লেখ রয়েছে ‘যে কেউ কোনো ব্যক্তিকে হত্যা করে অন্য কোনো প্রাণের বিনিময় ব্যতীত কিংবা পৃথিবীতে কোনো ফ্যাসাদ সৃষ্টির অপরাধ ছাড়া, সে যেন সকল মানুষকে হত্যা করল। ’

এই অবস্থায় আদালত মনে করেন, মৃত্যুদণ্ডই এই আসামিদের উপযুক্ত ও একমাত্র শাস্তি হওয়া উচিত। সেহেতু এই আদালত সকল আসামিদের দণ্ডবিধি ১৮৬০ এর ৩০২ ধারা ও ৩৪ ধারায় মৃত্যুদণ্ড প্রদানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন। এছাড়া আসামিদের প্রত্যেককে ২০ হাজার টাকা করে জরিমান করা হলো।

আদালত রায়ে দুই আসামি শারমিন আক্তার মুক্তা ও তার ভাই আল আমিন জনির ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির বিষয় উল্লেখ করে বলেন, শামসুন্নাহারকে রান্না ঘরে আটক করে তারপর ছুরি নিয়ে মারতে গেলে তার ছেলে শাওন তা দেখে ফেলে ও বাঁধা দেওয়া হয়। এই খুনের পরিকল্পনা করেন তিনজন মিলেই। আর বাস্তবায়ন করেন মুক্তার ভাই জনি, তিনি একাই ছুরি মেরে হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করেন। শাওনের রক্ত মাখা ক্যাপ ও ফুল শার্ট উদ্ধার করা হয় পাশের নির্মাণাধীন বিল্ডিংয়ের ছাদ থেকে।

আসামিপক্ষ মামলার বিচারকালে যুক্তি তুলে ধরে বলেন, অনেক আগেই শামসুন্নাহারের সঙ্গে আসামি আব্দুল করিমের তালাক হয়ে যায়। তাই তাদের দাম্পত্যের বিষয়টি নিষ্পত্তি হয়ে যায়। তাই আসামি করিমসহ অন্যরা শামসুন্নাহর ও তার ছেলেকে হত্যাও করেনি হত্যার পরিকল্পনাও করেনি। ঘটনাস্থলে সে উপস্থিতও ছিল না।

কিন্তু আদালত রায়ে বলেন, সাক্ষ্যপ্রমাণে এসেছে যে আব্দুল করিম হত্যাকাণ্ডের মাস্টার মাইন্ড। তাই বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় উচ্চ আদালতের রেফারেন্স দিয়ে আদালত বলেছেন, পরিকল্পনাকারী হিসেবে তার ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকাটা জরুরি নয়। দণ্ডবিধির ৩৪ ধারা অনুযায়ী হত্যার পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে সাধারণ অভিপ্রায় থাকাটাই সর্বোচ্চ দণ্ড দেওয়ার জন্য যথেষ্ট।

এই রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছে নিহতের স্বজন ও রাষ্ট্রপক্ষ। নিহত শামসুন্নাহারের ছোট ভাই ও মামলার বাদী আশরাফ আলী বলেন, আমি এই রায়ে সন্তুষ্ট। আশা করছি উচ্চ আদালতেও এই রায় বহাল থাকবে এবং দ্রুত তাদের দণ্ড কার্যকরে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

রাষ্ট্রপক্ষের অন্যতম আইনজীবী সালাউদ্দিন হাওলাদার জানান, হত্যাকারী জনিকে ওই বাড়িতে শামসুন্নাহারের স্বামী আব্দুল করিম পাঠিয়েছিল। তাই সে হত্যাকাণ্ডের মাস্টারমাইন্ড। আব্দুল করিমসহ তিন আসামিরই মৃত্যুদণ্ড হওয়ায় রায়ে আমরা সন্তুষ্ট।

অপরদিকে দণ্ডপ্রাপ্তদের দাবি, তারা ন্যায়বিচার পাননি। এই রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করবেন তারা।

এর আগে রোববার (১৭ জানুয়ারি) দুপুরে ঢাকার তৃতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ রবিউল আলম মামলার তিন আসামিকে মৃত্যুদণ্ড দেন। দণ্ডপ্রাপ্ত তিন আসামি হলেন- নিহত শামসুন্নাহারের স্বামী আব্দুল করিম, তার তৃতীয় স্ত্রী শারমিন মুক্তা এবং শ্যালক জনি।

গত ১০ জানুয়ারি এই মামলায় রাষ্ট্র ও আসামিপক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষ হয়। সেদিনই আদালত রায়ের জন্য ১৭ জানুয়ারি দিন ধার্য করেন।

ঘটনার বিবরণী থেকে জানা যায়, ২০১৭ সালের ১ নভেম্বর কাকরাইলের পাইওনিয়র গলির ৭৯/১ নম্বর বাসার গৃহকর্তা আবদুল করিমের প্রথম স্ত্রী শামসুন্নাহার করিম (৪৬) ও তার ছেলে শাওনকে (১৯) হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। ঘটনার পরদিন রাতে নিহত শামসুন্নাহারের ভাই আশরাফ আলী বাদী হয়ে রমনা থানায় মামলা দায়ের করেন। মামলায় আব্দুল করিম, করিমের দ্বিতীয় স্ত্রী শারমিন মুক্তা, মুক্তার ভাই জনিসহ অজ্ঞাত কয়েকজনকে আসামি করা হয়।

ঘটনার পর জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক শামসুন্নাহার করিমের স্বামী আবদুল করিম ও করিমের দ্বিতীয় স্ত্রী মডেল শারমিন মুক্তাকে এই মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়। ঘটনার দুদিন পর গোপালগঞ্জ থেকে আরেক আসামি জনিকে গ্রেফতার করে র‌্যাব-৩। এই মামলায় আসামিদের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে মুক্তা ও জনি আদালতে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন।

২০১৮ সালের ১৬ জুলাই এই তিন আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা রমনা থানার পরিদর্শক (নিরস্ত্র) মো. আলী হোসেন। অভিযোগপত্র দাখিলের পর মামলাটি বদলি হয়ে এই আদালতে আসে। ২০১৯ সালের ৩১ জানুয়ারি তিনজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন আদালত।

গত ১ নভেম্বর মামলাটির সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়। রাষ্ট্রপক্ষে মোট ২২ সাক্ষীর মধ্যে ১৭ জন আদালতে সাক্ষ্য দেন। এরপর আসামিদের পরীক্ষা ও উভয় পক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে মামলার বিচার কাজ শেষ হয়।

Scroll to Top