মানবতাবিরোধী অপরাধী জাতীয় পার্টির সাবেক নেতা ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী সৈয়দ মোহাম্মদ কায়সার তার মৃত্যুদণ্ডের রায় পুর্নবিবেচনা (রিভিউ) চেয়ে আবেদন করবেন।
আপিল বিভাগের দেওয়া রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশের পর বৃহস্পতিবার (২২) এমন তথ্য জানিয়েছেন তার আইনজীবী ব্যারিস্টার তানভীর আহমেদ আল আমীন।
প্রকাশের পর এ রায় আপিল বিভাগ থেকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে পাঠানো হয়। বৃহস্পতিবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল মৃত্যুপরোয়ানা জারি করেন।
ব্যারিস্টার তানভীর আহমেদ আল আমীন জানান, রায়ের সত্যায়িত অনুলিপির জন্য আবেদন করা হয়েছে। অনুলিপি পেলে ১৫ দিনের মধ্যে রিভিউ আবেদন করা হবে।
চলতি বছরের ১৪ জানুয়ারি প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে চার বিচারপতির আপিল বেঞ্চ সৈয়দ কায়সারের আপিল আংশিক মঞ্জুর করে রায় দেন।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে তার মোট ১৪টি চার্জে দণ্ড হয়েছিল। এর মধ্যে সাতটিতে মৃত্যুদণ্ড, চারটিতে আমৃত্যু কারাদণ্ড। বাকি তিনটিতে ১০ বছর,৭ ও ৩ বছর দণ্ড হয়েছিল।
মৃত্যুদণ্ডের সাতটির মধ্যে আপিল বিভাগ তিনটির মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখেছেন (সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে)। তিনটিতে দণ্ড কমিয়ে যাবজ্জীবন করা হয় (এর মধ্যে একটি সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে)। বাকি একটিতে খালাস দিয়েছেন।
আমৃত্যু দণ্ডের চারটির মধ্যে আপিল বিভাগ তিনটি বহাল রেখে একটিতে খালাস দিয়েছেন। বাকি তিনটির মধ্যে পাঁচ বছর এবং ১০ বছরের দণ্ড থেকে খালাস দিয়ে ৭ বছরের দণ্ড বহাল রেখেছেন।
আদালতে কায়সারের পক্ষে আইনজীবী ছিলেন এসএম শাহজাহান। সঙ্গে ছিলেন ব্যারিস্টার তানভীর আহমেদ আলীন। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন তৎকালীন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। সঙ্গে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল বিশ্বজিৎ দেবনাথ ও একেএম আমিন উদ্দিন মানিক।
রায় ঘোষণার পর ১৪ জানুয়ারি অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেছিলেন, ধর্ষণে সহায়তা করার জন্য এই প্রথম একটি মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হলো। এর ভিকটিম মাজেদা নিজে কোর্টে (ট্রাইব্যুনালে) এসে সাক্ষী দিয়েছেন। তার মেয়েও (যুদ্ধশিশু) সাক্ষী দিয়েছেন।
গত বছরের ৩ ডিসেম্বর রায়ের জন্য ১৪ জানুয়ারি দিন ধার্য করেছিলেন। এর আগে গত বছরের ১০ জুলাই এ আপিলের ওপর শুনানি শুরু হয়।
২০১৪ সালের ২৩ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে নিজের নামে ‘কায়সার বাহিনী’ গঠন করে যুদ্ধাপরাধ সংঘটনকারী হবিগঞ্জ মহকুমার রাজাকার কমান্ডার ও শান্তি কমিটির সদস্য সৈয়দ মোহাম্মদ কায়সারকে সর্বোচ্চ সাজাসহ ২২ বছরের কারাদণ্ডাদেশ দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২।
একাত্তরে ১৫২ জনকে হত্যা-গণহত্যা, দুই নারীকে ধর্ষণ, পাঁচজনকে আটক, অপহরণ, নির্যাতন ও মুক্তিপণ আদায় এবং দুই শতাধিক বাড়ি-ঘরে অগ্নিসংযোগ, লুণ্ঠন ও ষড়যন্ত্রের ১৬টি মানবতাবিরোধী অপরাধের মধ্যে ১৪টিই প্রমাণিত হয়েছে তার বিরুদ্ধে।
যুদ্ধাপরাধীদের মধ্যে প্রথমবারের মতো অন্য অপরাধের পাশাপাশি ধর্ষণে সহযোগিতার দায়ে ফাঁসির আদেশ পান কায়সার। সাঁওতাল নারী হীরামনি ও অপর নারী মাজেদাকে ধর্ষণের অপরাধ দু’টি প্রমাণিত হয় রায়ে। ওই দুই বীরাঙ্গনা নারী ও ধর্ষণের ফলে বীরাঙ্গনা মায়ের গর্ভে জন্ম নেওয়া যুদ্ধশিশু শামসুন্নাহার প্রথমবারের মতো ট্রাইব্যুনালে এসে সাক্ষ্যও দেন কায়সারের বিরুদ্ধে।
কায়সারের বিরুদ্ধে ৪৮৪ পৃষ্ঠার ট্রাইব্যুনালের রায়ে উল্লেখ করা হয়েছে, একাত্তরে সৈয়দ কায়সার প্রথমে হবিগঞ্জ মহকুমার রাজাকার কমান্ডার ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তিনি ৫/৭শ স্বাধীনতাবিরোধী লোক নিয়ে পাকিস্তানি সেনাদের সহযোগিতা করতে নিজের নামে ‘কায়সার বাহিনী’ গঠন করেন। তিনি নিজে ওই বাহিনীর প্রধান ছিলেন। ‘কায়সার বাহিনী’ নামাঙ্কিত এ বাহিনীর নিজস্ব ইউনিফর্মও ছিল।
কায়সার এ বাহিনীর মাধ্যমে হবিগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়াসহ বৃহত্তর কুমিল্লায় হত্যা, গণহত্যা, মুক্তিযোদ্ধা হত্যা, ধর্ষণ, হামলা, নির্যাতন, লুটপাট, অগ্নিসংযোগসহ ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালান। তিনি পাকিস্তানি সেনাদের পথ দেখিয়ে বিভিন্ন গ্রামে নিয়ে স্বাধীনতার পক্ষের লোক এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর আক্রমণ চালান।
রায়ের পর্যবেক্ষণে কায়সার বাহিনীকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সহযোগী বাহিনী বা অক্সিলারি ফোর্স না বললেও ট্রাইব্যুনাল বলেন, এ বাহিনী ও সৈয়দ কায়সার ভিকটিম ও অপরাধ সংঘটনস্থল এলাকাগুলোর মানুষের কাছে ঘৃণিত হয়ে থাকবেন।
ট্রাইব্যুনালে এসে সাক্ষ্য দেওয়ায় যুদ্ধশিশু শামসুন্নাহারকে সাহসিকতার জন্য এবং সব নির্যাতিত নারী ও বীরাঙ্গনাদের স্যালুট জানান ট্রাইব্যুনাল।
২০১৫ সালের ১৯ জানুয়ারি নিজেকে নির্দোষ দাবি করে ফাঁসির সাজা বাতিল ও বেকসুর খালাসের আর্জি জানিয়ে আপিল করেন (নম্বর: ০৪/২০১৫) কায়সার।