বহুল আলোচিত বরগুনার রিফাত শরীফ হত্যা মামলায় ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত ছয় আসামিকে বরগুনা জেলা কারাগারের কনডেম সেলে রাখা হয়েছে। তবে মিন্নিসহ ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত ছয় আসামির সবাই মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছেন। বরগুনা জেল সুপার মো. আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘কারাবিধি অনুযায়ী ছয় বন্দিকেই কনডেম সেলে থালা, বাটি ও কম্বল দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া প্রতি আসামিকে কারাগারের পক্ষ থেকে দুই সেট পোশাক দেওয়া হয়েছে। এ পোশাক তারা পরিধান করবেন। এবং নিয়মিত আসামিরা যে খাবার গ্রহণ করেন, সেটা তাদের দেওয়া হচ্ছে।’
জেল সুপার মো. আনোয়ার হোসেন এ বিষয়ে আরও বলেন, ‘মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের কারাগারের যে বিশেষ কক্ষে রাখা হয়, সেটাকে কনডেম সেল বলে। আর কনডেম সেলের বন্দিরা কখনো সেলের বাইরে বের হতে পারেন না। কনডেম সেলের বন্দিরা মাসে একবার তাঁদের স্বজনদের সঙ্গে দেখা করতে পারেন।’ তিনি আরও বলেন, ‘এ ছাড়া সপ্তাহে একবার তাঁরা ফোনে স্বজনদের সঙ্গে একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত কথা বলতে পারেন। সে হিসেবে আজ সকালে মিন্নি তাঁর মা-বাবার সঙ্গে ফোনে পাঁচ মিনিট কথা বলেছেন।’
মিন্নির বাবা মোজাম্মেল হোসেন কিশোর এ বিষয়ে বলেন, ‘মিন্নির সঙ্গে সকালে আমি ও তাঁর মা কথা বলেছি। আমার মেয়েটা খুবই বিধ্বস্ত। আমরা এই রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল করব।’
বরগুনা জেল সুপার আনোয়ার হোসেন জানান, বরগুনার কারাগারে নারী বন্দিদের মধ্যে মিন্নিই একমাত্র কনডেম সেলের আসামি। তাকে নারী ওয়ার্ডের কনডেম সেলে রাখা হয়েছে। তা ছাড়া রিফাত হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ডাদেশ পাওয়া অপর পাঁচ পুরুষ আসামিকেও কনডেম সেলে রাখা হয়েছে। এই পাঁচ পুরুষ বন্দি ছাড়া বরগুনার কারাগারের কনডেম সেলে আর কোনো পুরুষ বন্দি নেই বলে উল্লেখ করেন জেল সুপার আনোয়ার হোসেন।
এর আগে বুধবার ৩০ সেপ্টেম্বর দুপুরে বরগুনার জেলা ও দায়রা জজ মো. আছাদুজ্জামান চাঞ্চল্যকর এ হত্যা মামলার রায় দেন। এসময় আদালতে মিন্নিসহ সব আসামি উপস্থিত ছিলেন। রায়ের পরেই পৃথকভাবে আদালত থেকে দণ্ডপ্রাপ্তদের কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়।
উল্লেখ্য, ২০১৯ সালের ২৬ জুন সকাল সাড়ে ১০টার দিকে বরগুনা সরকারি কলেজ রোডের ক্যালিক্স একাডেমির সামনে স্ত্রী মিন্নির সামনে রিফাত শরীফকে কুপিয়ে জখম করে নয়ন বন্ড ও রিফাত ফরাজীর সহযোগীরা। গুরুতর আহত অবস্থায় রিফাতকে উদ্ধার করে বরগুনা জেনারেল হাসপাতালে নেওয়া হয়। তাকে বরিশাল শেরে-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে উন্নত চিকিৎসার জন্য ভর্তি করা হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রিফাত মারা যান। এরপর রিফাতের বাবা দুলাল শরীফ বাদী হয়ে সাব্বির আহম্মেদ ওরফে নয়ন বন্ডকে প্রধান আসামি করে ১২ জনের নাম উল্লেখ এবং আরও পাঁচ/ছয়জন অজ্ঞাতপরিচয়ের বিরুদ্ধে বরগুনা থানায় হত্যা মামলা করেন। এ মামলায় প্রথমে মিন্নিকে প্রধান সাক্ষী করেছিলেন নিহত রিফাতের বাবা।
প্রাথমিক অবস্থায় পুলিশ বিষয়টি আমলে না নিলেও ফেসবুকে এ হত্যাকাণ্ডের ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পর নড়েচড়ে বসে বরগুনার পুলিশ প্রশাসন। দেশব্যাপী ওঠে সমালোচনার ঝড়। এরপর চেকপোস্টে কড়া নিরাপত্তা ও তল্লাশিতে একে একে ধরা পড়েন অভিযুক্তরা। হত্যাকাণ্ডের ২০ দিন পর গত বছরের ১৬ জুলাই মিন্নিকে তার বাবার বাসা থেকে বরগুনা পুলিশলাইন্সে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। পরে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে এ হত্যায় তার সংশ্লিষ্টতা রয়েছে বলে মনে হওয়ায় ওইদিন রাতেই মিন্নিকে গ্রেপ্তার দেখায় পুলিশ। পরে গত বছরের ১৭ জুলাই মিন্নিকে বরগুনার সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হাজির করে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সাতদিনের রিমান্ড আবেদন করে পুলিশ। পরে শুনানি শেষে আদালত মিন্নির পাঁচদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। পরে গত বছরের ২০ জুলাই পাঁচদিনের রিমান্ডের তৃতীয় দিন একই আদালতে রিফাত হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন মিন্নি। এরপর তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন বিচারক মোহাম্মদ সিরাজুল ইসলাম গাজী। এরপর ৪৯ দিন কারাভোগের পর গত বছরের ৩ সেপ্টেম্বর গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা না বলার শর্তে উচ্চ আদালতের নির্দেশে বরগুনার কারাগার থেকে জামিনে মুক্ত হন মিন্নি। জামিনের পর থেকে বাবা মোজাম্মেল হোসেন কিশোরের জিম্মায় বাড়িতে ছিলেন তিনি।