বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত খুনি রাশেদ চৌধুরীর রাজনৈতিক আশ্রয় লাভের প্রায় ১৫ বছরের মাথায় তাঁর মামলাটি সচল করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন মার্কিন অ্যাটর্নি জেনারেল উইলিয়াম বার। ঠিক কী উদ্দেশ্যে তিনি এ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তা স্পষ্ট নয়। তবে গত ১৭ জুন উইলিয়াম বার এক চিঠিতে এ এম রাশেদ চৌধুরীর আদ্যক্ষর ‘এ-এম-আর-সি’ সংক্রান্ত নথি পাঠাতে ইমিগ্রেশন আপিল বোর্ডকে নির্দেশনা দিয়েছেন। মার্কিন সাময়িকী পলিটিকোর গত শুক্রবারের এক প্রতিবেদনে এ তথ্য দেওয়া হয়েছে।
মার্কিন অ্যাটর্নি জেনারেল মামলাটি সচল করার পর রাশেদ চৌধুরীর আবেদন প্রত্যাখ্যাত হলে যুক্তরাষ্ট্র তাঁকে বহিষ্কার করতে পারে। এ পরিস্থিতিতে রাশেদ চৌধুরীকে ফিরিয়ে এনে মৃত্যুদণ্ডাদেশ কার্যকর করাটা বাংলাদেশের জন্য সহজ হবে।
মার্কিন অ্যাটর্নি জেনারেলের এ উদ্যোগে বেশ উদ্বিগ্ন রাশেদ চৌধুরীর আইনজীবীরা। মরিসন অ্যান্ড ফোয়েরস্টার্রসের সান ফ্রান্সিসকো দপ্তরের অন্য আইনজীবীদের সঙ্গে রাশেদ চৌধুরীর মামলাটি পরিচালনা করেন মার্ক ভ্যান ডার হউট। তাঁর মতে, মার্কিন অ্যাটর্নি জেনারেল এরই মধ্যে তাঁর মক্কেলের আশ্রয় লাভের বিষয়ে দেওয়া আগের রায় বাতিলের সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন। তা না হলে মামলাটি পুনরুজ্জীবিত করার কোনো কারণ নেই।
মার্ক ভ্যান ডার হউট পলিটিকোকে বলেছেন, ‘ট্রাম্প প্রশাসন যে এখানে বাংলাদেশের পক্ষে কাজ করছে, এটা স্পষ্ট। প্রশ্ন হচ্ছে কেন তারা এ কাজটা করছে?’
প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, বছরের পর বছর ধরে চেষ্টার পর কোনো ফল না এলেও ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর ইতিবাচক বার্তা পেতে থাকে বাংলাদেশ। গত বছরের নভেম্বরে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন জানান, রাশেদ চৌধুরীর বিষয়টি পর্যালোচনার জন্য মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা অ্যালিস ওয়েলস তাঁকে তথ্য-উপাত্ত পাঠাতে বলেছেন। কাজেই রাশেদ চৌধুরীর ভাগ্যে কী ঘটতে যাচ্ছে, সেটা এখন মার্কিন অ্যাটর্নি জেনারেল উইলিয়াম বারের ওপর নির্ভর করছে।
এ নিয়ে জানতে চাইলে পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেন গতকাল সকালে বলেন, ‘মার্কিন অ্যাটর্নি জেনারেলের এ পদক্ষেপ অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। আমরা দীর্ঘদিন ধরে মার্কিন প্রশাসনের নানা স্তরে বিষয়টি নিয়ে অনুরোধ জানিয়ে আসছিলাম। এখন বিষয়টি কোন দিকে যায়, সেটা আমাদের দেখতে হবে।’
ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং ওয়াশিংটনে বাংলাদেশ দূতাবাসে অতীতে আর এখন কাজ করছেন এমন কয়েকজন কূটনীতিক গতকাল এই প্রতিবেদককে বলেন, ২০০৯ সাল থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি দপ্তরের পাশাপাশি রাজনৈতিক মহলে বাংলাদেশ বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। চিঠিপত্র চালাচালিও চলছে। সেই সঙ্গে আইনি পদক্ষেপও নেওয়া হয়েছে। দীর্ঘ এক দশকের বেশি সময়জুড়ে কূটনৈতিক আর আইনি পদক্ষেপের ফলে শেষ পর্যন্ত মার্কিন প্রশাসন বিষয়টি নিয়ে পদক্ষেপ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা এই প্রতিবেদককে জানান, মার্কিন অ্যাটর্নি জেনারেল গত মাসে রাশেদ চৌধুরীর ব্যাপারে পদক্ষেপ নেওয়ার পর বিষয়টি ওয়াশিংটনে বাংলাদেশ দূতাবাসের মাধ্যমে জেনেছিলেন।
রাশেদ চৌধুরীর বিষয়ে মার্কিন অ্যাটর্নি জেনারেলের সিদ্ধান্তের বিষয়ে জানতে চাইলে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত আকরামুল কাদের গতকাল অস্ট্রেলিয়া থেকে বলেন, ‘রাশেদ চৌধুরীর রাজনৈতিক আশ্রয় লাভের মামলাটি পর্যালোচনার জন্য আমরা ধারাবারিকভাবেই মার্কিন কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ জানিয়ে গেছি। এ জন্য আমরা মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর, আইন মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা এবং অ্যাটর্নি জেনারেলের সঙ্গে আলোচনা করেছি।
সংশ্লিষ্ট মার্কিন দপ্তরগুলোতে আমরা বিভিন্ন সময় চিঠি দিয়ে অনুরোধ করেছি। পাশাপাশি মার্কিন কংগ্রেসের বিভিন্ন সদস্যের সঙ্গে আলোচনা করে এ বিষয় তাদের সমর্থন আদায়ের চেষ্টা চালিয়েছিলাম। পরে আমরা আইনি পরামর্শক সংস্থা হিসেবে নিয়োগ করে বিষয়টি আইনিভাবে মোকাবিলার উদ্যোগ নিই। বাংলাদেশ শুরু থেকেই বলে এসেছে, রাশেদ চৌধুরীর যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ অবৈধভাবে হয়েছিল। আর তিনি যে মিথ্যা ভাষ্য দিয়ে রাজনৈতিক আশ্রয় পেয়েছেন, তা নথিপত্র পর্যালোচনা করে মামলাটি পুরুজ্জীবিত করলেই বের হয়ে আসবে। কাজেই মার্কিন অ্যাটর্নি জেনারেল উইলিয়াম বার যে মামলাটি পুনরুজ্জীবিত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, এটা বাংলাদেশের জন্য আশার খবর।’
বঙ্গবন্ধুর স্বঘোষিত অন্য খুনিদের মতো রাশেদ চৌধুরীও পঁচাত্তরের পর থেকে পরের দুই দশক বাংলাদেশি কূটনীতিক হিসেবে বিভিন্ন মিশনে দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে জয়লাভ করে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দায়িত্ব নেওয়ার এক বছরের মাথায় ১৯৯৭ সালে জাতীয় সংসদে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল করা হয়।
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার সময়টাতে অর্থাৎ ১৯৯৬ সালে ব্রাজিলে বাংলাদেশের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স ছিলেন রাশেদ চৌধুরী। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এলে তাঁকে ঢাকায় ফেরার নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্তু দেশে ফিরলেই শাস্তি অবধারিত আঁচ করতে পেরে রাশেদ চৌধুরী স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে ভিজিটর ভিসায় যুক্তরাষ্ট্রে পালিয়ে যান। যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছার দুই মাসের মাথায় তিনি রাজনৈতিক আশ্রয়ের জন্য আবেদন করেন। দীর্ঘ এক দশকের প্রক্রিয়া শেষে ২০০৬ সালে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক আশ্রয়ের অনুমতি পান।
যুক্তরাষ্ট্রের হোমল্যান্ড সিকিউরিটি বিভাগ ওই আদেশের বিরোধিতা করে বলেছিল, অভ্যুত্থানে অংশ নেওয়ায় তিনি আশ্রয় পেতে পারেন না। কিন্তু তখন ইমিগ্রেশন আদালত ওই যুক্তি খারিজ করে রাশেদ চৌধুরীর পক্ষে রায় দিয়েছিলেন। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার কনকর্ড সিটির হাকলবেরি ড্রাইভে থাকেন রাশেদ চৌধুরী।
পলিটিকোর মতে, রাশেদ চৌধুরী যুক্তরাষ্ট্রের সন্ত্রাসবিরোধী আইন ভেঙেছেন কি না, সেই প্রশ্নের সুরাহা হয়নি। তবে উইলিয়াম বারের সিদ্ধান্তটি গুরুতর অপরাধ করে রাশেদ চৌধুরীর যুক্তরাষ্ট্রে আশ্রয় নেওয়ার বিরুদ্ধে এক কঠোর বার্তা। রাজনৈতিক আশ্রয় পাওয়ার এক দশক পরও যে মামলা পুনরুজ্জীবিত হতে পারে, এ ক্ষেত্রে উইলিয়াম বারের পদক্ষেপ নতুন নজির সৃষ্টি করেছে। মার্কিন অ্যাটর্নি জেনারেলের এ পদক্ষেপের ফলে শুরুতে রাজনৈতিক আশ্রয় বাতিল হতে পারে রাশেদ চৌধুরীর। এরপর তাঁকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বহিষ্কার করা হতে পারে।