ডা. সজল আশফাক
গর্ভাবস্থায় খাবারদাবারের বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ সময়ে পুষ্টিকর খাবার গ্রহণের ব্যাপারে যেমন আগ্রহী হতে হয়, ঠিক তেমনি সতর্কতাও অবলম্বন করতে হয়। এক সময়ে ধারণা করা হতো, গর্ভাবস্থায় শাকসবজি, ফলমূল, শস্যদানা জাতীয় খাবার গ্রহণের কোনো বাধা নেই। কিন্তু উৎকৃষ্ট পুষ্টিমান গুণ সম্পন্ন এসব খাবার গর্ভাবস্থায় রান্না না করে খাওয়ার কারণে গর্ভপাত হতে পারে বলে জানা গেছে।
গর্ভপাতকারী এসব শাকসবজি, ফলমূল ও শস্যদানার তালিকায় রয়েছে পেঁপে, আনারস, চিনাবাদাম, কাজুবাদামসহ, সবরকমের বাদাম-পেস্তা, গাজর, বিট, বাঁধাকপি, ধনেপাতা, পুদিনাপাতা, আলু, শাকালু, রাঙা আলু, ছোলা ইত্যাদি। উল্লিখিত খাদ্যগুলো রান্না না করে খেলে সেগুলো গর্ভপাত ঘটাতে পারে। কারণ, এই খাদ্যগুলোতে রয়েছে এমন কিছু উপাদান, যা ভ্রুণশিশুর জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। যেহেতু ভ্রুণ শিশু মায়ের রক্তের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় পুষ্টি চাহিদা পূরণ করে থাকে, তাই মায়ের শরীরের ক্রমাগত ঢুকতে থাকলে ভ্রুণের ক্ষতি হতে পারে। আর এই ক্ষতি পরিণামে গর্ভপাতকেই আমন্ত্রণ জানায়।
উল্লিখত খাবারগুলো কেন গর্ভপাত ঘটায়, সে প্রসঙ্গে যতটুকু ব্যাখ্যা পাওয়া যায়, তাতে দেখা যাচ্ছে-
- পেঁপে ও আনারসের মধ্যে রয়েছে প্রোটিন ভেঙ্গে ফেলার বা হজম করে ফেলার মতো এক ধরনের এনজাইম। অর্থাৎ এক ধরনের প্রোটিওলাইটিক এনজাইম। এই এনজাইম প্লাসেন্টা বা গর্ভফুলরে ক্ষতি করতে পারে। বাদাম – পেস্তা জাতীয় খাবারে রয়েছে সায়ানো গ্লাইকোসাইড নামের রাসায়নিক যৌগ। এটি শরীরে এক ধরনের বিষক্রিয়া সৃষ্টিকারী ‘হাইড্রোসায়ানিক অ্যাসিড’ তৈরি করতে পারে। হাইড্রোসায়ানিক অ্যাসিড শ্বাসতন্ত্রের প্যারালাইসসি ঘটাতে পারে।
- ছোলায় রয়েছে বিষক্রিয়া সৃষ্টিকারী যৌগ লেকটিন বা হেমএগ্লুটিনিন। এটি গর্ভফুলের সেলমেমব্রেন বা কোষ আবরণীকে নষ্ট করে দিতে পারে। এতে গর্ভফুলের মধ্য দিয়ে ফিলট্রেশন, ট্রান্কপোর্টেশন, ডিফিউশন প্রক্রিয়ায় গর্ভস্থ ভ্রুণ শিশুর জন্য মায়ের শরীর থেকে খাদ্য সরবরাহ বিঘ্নিত হয়। এতে ভ্রুণ শিশুর মৃত্যু এবং গর্ভফুলের ক্ষতি হয়ে গর্ভপাতের আশঙ্কা থাকে।
- বিট, গাজর ইত্যাদিতে থাকে ফাইটোইস্ট্রোজেন জাতীয় পদার্থ। এগুলোর মধ্যে আবার থাকে আইসোপ্ল্যাভোনয়েড জাতীয় রাসায়নিক পদার্থ। এটি জরায়ুর সঙ্গে ভ্রুণের সংযোগ স্থাপনে বাধা দেয়। এর একপর্যায়ে গর্ভপাত ঘটে।
- আলু, শাকালু, রাঙা আলুতে থাকে সোলানিন। এটি অ্যাকালয়েড জাতীয় পদার্থ মানবদেহের স্নায়ুতে কোলিনইস্টারেজ এনজাইমের ইনহিবিটর বা বাধাদানকারী হিসেবে কাজ করে থাকে। এতে গর্ভবতী মা তথা ভ্রুণ শিশুর স্নায়ু- চাঞ্চল্য বেড়ে গিয়ে স্বাভাবিক স্নায়বিক প্রতিক্রিয়া বিঘ্নিত করে।
তবে একটি কথা হচ্ছে, এসব খাবার রান্না না করা অবস্থায় খেলেই বিপত্তি হতে পারে। রান্না করে বা সিদ্ধ করে খেলে খাদ্যের এসব বিষক্রিয়া নষ্ট হয়ে যায়। এতে রান্না করা অবস্থায় এগুলো কোনো অসুবিধা হওয়ার কথা নয় বা কোনো সমস্যা সৃষ্টি করে না। যদিও আনারস, গাজর ও বাদাম ছাড়া এসব খাদ্যের কোনোটিই রান্না না করে অর্থাৎ সিদ্ধ করেই খাওয়া উচিত।
তারপরও কিছু কথা রয়েছে। এসব খাদ্যের বিষক্রিয়া সবার ওপর সমানভাবে কার্যকর না-ও হতে পারে। দেখা গেল, কোনো এক নারী গর্ভাবস্থায় প্রচুর আনারস খেল, তার কিছুই হলো না। হ্যাঁ, এমনটিও হতে পারে। এসব খাদ্যের বিষক্রিয়ায় কে কতটুকু ঝুঁকিপূর্ণ, সেটি ব্যক্তিবিশেষের বংশগতি অর্থাৎ জেনেটিক বিষয়ের ওপর অনেকটাই নির্ভরশীল। দেখা গেছে, এসব বিষক্রিয়া সৃষ্টিকারী যৌগ তীব্রভাবে চড়াও হবে আর কাকে মৃদুভাবে আক্রমণ করবে সেটি বলা কিন্তু সহজ নয়। আগে থেকেই এ সম্পর্কে মন্তব্য করা কঠিনই বলা যায়, অন্তত আমাদের দেশে সে ধরনের কোনো পরীক্ষা নিরীক্ষার ব্যবস্থা নেই। কাজেই এই অবস্থায় ঝুঁকি না নিয়ে গর্ভাবস্থার দিনগুলোতে এই খাদ্যগুলো রান্না না করে খাওয়া থেকে বিরত থাকাই হচ্ছে জটিলতা কমানোর একমাত্র উপায়। সুতরাং গর্ভাবস্থায় রান্না না করে সবজি খাওয়া ভালো- এমন ধারণা এখন ভুল প্রমাণিত হয়েছে। খাবার থেকেও গর্ভপাত হতে পারে। এ বিষয়টিকে গর্ভাবস্থায় মনে রাখা প্রয়োজন।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, হলিফ্যামিলি রেডক্রিসেন্ট মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল
বাংলাদেশ সময়: ১৩৪৮ ঘণ্টা, ২৬ আগস্ট ২০১৭
লেটেস্টবিডিনিউজ.কম/এসডিএম