দেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। এখন প্রতিদিনই বৃষ্টিপাত হচ্ছে কোথাও না কোথাও । বাসা-বাড়ির আঙিনায় কিংবা আনাচে-কানাচে জমে থাকা পানিতে এখন এডিস মশার লার্ভা জন্ম হয়। চলতি বছর হাসপাতালে ভিড় বাড়ছে ডেঙ্গু রোগীর। ইতোমধ্যে ডেঙ্গু সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে। আগামী নভেম্বর পর্যন্ত ডেঙ্গুর আগ্রাসী রূপ থাকবে বলে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা আশঙ্কা করছেন।
সরকারি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, এডিস মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গুজ্বরে মৃত্যু ও আক্রান্তের সংখ্যা ইতোমধ্যেই ছাড়িয়ে গেছে অতীতের সব রেকর্ড। রোগীদের সামাল দিতে গিয়ে অন্য রোগীদের চিকিৎসা সেবা ব্যাহত হচ্ছে। অন্য রোগে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা সেবা ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছে। এই অবস্থায় সামনের দিনগুলোতে ডেঙ্গু রোগী বৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হবে। ডেঙ্গু চিহ্নিত শত্রু, তারপরও তা দমন করা যাচ্ছে না।
এডিস মশা নির্মূল করতে চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন সিটি করপোরেশনসহ সংশ্লিষ্টরা।
গত ২৩ বছরেও পুরনো রোগটি নির্মূল করা সম্ভব হয়নি। উল্টো এটি আরও শক্তিশালী হচ্ছে। ফলে শহুরে ডেঙ্গু এখন গ্রামেও সমান দাপট বিস্তার করেছে; কিন্তু ডেঙ্গু মোকাবিলায় কীটতত্ত্বভিত্তিক স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি কোনো পরিকল্পনা গড়ে ওঠেনি।
পরিসংখ্যান বলছে, চলতি মাসের সেপ্টেম্বরের ১৬ দিনেই ডেঙ্গুতে ২১১ জনের মৃত্যু হয়েছে। মোট আক্রান্ত হয়েছেন ৪০ হাজার ৭৫৪ জন। চলতি বছরে মোট মৃত্যু ৮০৪ জন। গতকাল শনিবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ডেঙ্গুবিষয়ক প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে গত ২৪ ঘণ্টায় ১৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। তাদের মধ্যে ৯ জনই ঢাকার বাইরের। এ সময় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ২ হাজার ৫৯৮ জন। তাদের মধ্যে ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে ৮৮১ জন এবং ঢাকার বাইরের হাসপাতালগুলোয় ১ হাজার ৭১৭ নতুন রোগী ভর্তি হয়েছেন। চলতি বছর ডেঙ্গু নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১ লাখ ৬৪ হাজার ৫৬২ জন। তাদের মধ্যে ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে ৭২ হাজার ৩৮৪ ও ঢাকার বাইরে ৯২ হাজার ১৭৮ জন রয়েছেন। মারা যাওয়া রোগীদের মধ্যে ঢাকার ৫৫২ এবং ঢাকা সিটির বাইরের ২৫২ জন। চলতি বছরের ৩১ আগস্ট পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন মোট এক লাখ ২৩ হাজার ৮০৮ জন। এর মধ্যে ঢাকা সিটিতে ৫৮ হাজার ২১ ও সারাদেশে ৬৫ হাজার ৭৮৭ জন। এ সময় ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মোট ৫৯৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে ঢাকাতে ৪৩৮ ও সারাদেশে ১৫৫ জন।
স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের ফাঁকা বুলি: দেশের কোথাও কোনো নির্মাণাধীন ভবনে ডেঙ্গু ভাইরাস বহনকারী এডিস মশার শূককীট বা লার্ভা পাওয়া গেলে প্রথমে ভবনমালিককে সতর্ক করা হবে। দ্বিতীয়বার পাওয়া গেলে জরিমানা করা হবে। প্রয়োজনে বন্ধ করে দেয়া হবে নির্মাণকাজ। সচিবালয়ে স্থানীয় সরকারমন্ত্রী তাজুল ইসলামের সভাপতিত্বে গত ১৯ জুলাই অনুষ্ঠিত সারা দেশে মশাবাহিত রোগ প্রতিরোধে এক আন্তঃমন্ত্রণালয় এক সভায় এ সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু দেশের কোনো জেলা ও পৌরসভা পর্যায়ে সিদ্ধান্তটি বাস্তবায়ন হয়েছে বলে খবর পাওয়া যায়নি। মন্ত্রণালয় সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের বিষয়টি তদারকি করেনি। নির্মাণকাজ বন্ধ করে দেয়ার মতো শক্ত অবস্থান দেখা যায়নি। তদারকি যেমন হচ্ছে না, তেমনি অর্থ বরাদ্দও সামান্য। স্থানীয় সরকার বিভাগ ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ডেঙ্গু মোকাবিলা, পরিচ্ছন্নতা ও প্রচার খাতে (স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব ব্যয়ের বাইরে) ৪০ কোটি টাকা বরাদ্দ রেখেছে। পৌরসভাগুলোকে সেখান থেকে শ্রেণিভেদে প্রায় ১ লাখ ২৬ হাজার থেকে ১ লাখ ৮০ টাকার বরাদ্দ ছাড় করা হয়েছে গত ১৬ আগস্ট। এর আগে সিটি করপোরেশনগুলোকে দেয়া হয়েছে মোট ১০ কোটি টাকা।
বিশেষজ্ঞরা ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা বলছেন, এই বরাদ্দ একেবারেই কম। দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়া ডেঙ্গু প্রতিরোধে এডিস মশা মারার দায়িত্ব স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের স্থানীয় সরকার বিভাগের অধীন সিটি করপোরেশন, জেলা প্রশাসন, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদের। মশা মারার কার্যক্রম তদারকির কাজটি স্থানীয় সরকার বিভাগের।
কিন্তু খোঁজ নিয়ে জানা যায়, স্থানীয় সরকার বিভাগের কাজ বৈঠক করা ও নির্দেশনা দেয়ার মধ্যে সীমিত। কিন্তু বৈঠকে নেয়া সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হচ্ছে কি না, নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ হচ্ছে কি না, তা তদারকি করা হচ্ছে না।
মাঠপর্যায়ে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, আসলে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হচ্ছে না। এতে মশাও নিয়ন্ত্রণে আসছে না। ফলে দেশের সব কটি জেলায় ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়েছে। নিয়মিত মানুষ মারা যাচ্ছেন। সরকারি হিসাবে এ বছর ডেঙ্গুতে এ পর্যন্ত মারা গেছেন ৮০৪ জন। চলতি মাসের প্রথম ১৬ দিনে প্রতিদিন গড়ে মারা গেছেন ১৩ জনের বেশি মানুষ।
বাবা-মায়েরা শিশুসন্তানকে হারাচ্ছেন, সন্তানেরা মা-বাবাকে হারাচ্ছে- স্বজন হারিয়েছে বহু মানুষ।
স্থানীয় সরকার বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মলয় চৌধুরী গণমাধ্যমকে বলেন, ডেঙ্গু প্রতিরোধে সিটি করপোরেশন যেসব কাজ করে, প্রতিদিন সেসব তথ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। তাদের দেয়া তথ্যের ওপর নির্ভর করতে হয়। মাঝেমধ্যে আমাদের কর্মকর্তারা সিটি করপোরেশনে পরিদর্শনে যান। তবে জনবলের অভাবে সবখানে যাওয়া সম্ভব নয়। ঢাকার বাইরে মশক নিয়ন্ত্রণ জরুরি হয়ে উঠেছে এই কারণে যে মৌসুমের শুরুর দিকে ঢাকায় ডেঙ্গু রোগী বেশি ছিল। এখন ঢাকার বাইরে অনেক রোগী দেখা যাচ্ছে। কিন্তু সেখানে কার্যক্রম একেবারেই কম। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করা স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের পক্ষে সম্ভব নয়। তাদের মূল কাজ রাস্তাঘাট ও সেতু নির্মাণ। বিশেষজ্ঞরা জানান, গত কয়েক বছর ধরে অব্যাহতভাবে ডেঙ্গুর সংক্রমণ ঘটলেও প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ না করায় ডেঙ্গু ভয়াবহ হয়ে উঠেছে। ইতিপূর্বে ডেঙ্গু রাজধানীকেন্দ্রিক ছিল। কিন্তু বর্তমানে তা সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে। গত কয়েক বছরের তুলনায় এবার ডেঙ্গু রোগীদের অবস্থা খুব দ্রুত অবনতি হচ্ছে ও মারা যাচ্ছে।
সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) সাবেক পরিচালক অধ্যাপক মাহমুদুর রহমান বলেন, ডেঙ্গু যে ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে, তা নিয়ন্ত্রণে বাড়তি কোনো উদ্যোগ চোখে পড়ছে না। অনেক কিছুই প্রকৃতির ওপর ছেড়ে দেয়া হয়েছে। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো মশা নিয়ন্ত্রণ। সেখানে কার্যকর উদ্যোগ দেখছি না। তবে, জনস্বাস্থ্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, অক্টোবর পর্যন্ত ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব থাকবে। হয়তো ডেঙ্গু অনেক বেশি বাড়বে না, আবার কমবেও না।