দেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণের শুরুতে মরণব্যাধি করোনায় আক্রান্ত হয়ে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়া রোগীর চিকিৎসায় আইসিইউ সংকট দেখা দিলেও এখন তা অনেকটাই কেটে গেছে। অনুসন্ধানে দেখা গেছে কোভিড সেবায় উৎসর্গকৃত বেশ কিছু হাসপাতালে আইসিইউ শয্যা ফাঁকা পড়ে আছে। অথচ নন-কোভিড হাসপাতালে গুরুতর অসুস্থ রোগীর চিকিৎসায় আইসিইউ সংকট এখন প্রকট হওয়ায় বিপাকে গুরুতর অসুস্থরা।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, সারাদেশের সরকারি হাসপাতালে ৫২ হাজার ৮০৭টি ও নিবন্ধনভুক্ত বেসরকারি হাসপাতাল ৯০ হাজার ৫৮৭টি সহ রোগীদের চিকিৎসায় মোট ১ লাখ ৪৩ হাজার ৩৯৪টি শয্যা রয়েছে। তবে এই শয্যার বিপরীতে সারাদেশের হাসপাতালে আইসিইউ বেড আছে মাত্র ১ হাজার ১৬৯টি। এর মধ্যে সরকারি হাসপাতালে আইসিইউ শয্যা ৪৩২টি এবং বাকিগুলো বেসরকারি হাসপাতালে। এমন পরিস্থিতিতে রোগীর সংখ্যা অনুপাতে অপ্রতুল আইসিইউ\’র চিকিৎসা ব্যয় উচ্চমূল্য হওয়ায় দরিদ্র রোগীরা এই খরচ বহন করতে গিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়ছেন। এদেশে বৰ্তমানে মানুষের মোট স্বাস্থ্য ব্যয়ের প্রায় ৭০ ভাগ পকেট থেকে খরচ করতে হচ্ছে। যা কয়েক বছর আগেও ছিল ৬৩ ভাগ। চিকিৎসা ব্যয় বেশি হওয়ায় শতকরা ৪ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন আইসিইউ সেবার মতো উচ্চমূল্যের ব্যয় মেটাতে গিয়েই মূলত নিঃস্ব হচ্ছেন সাধারণ রোগীরা।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে গুরুতর করোনা আক্রান্তদের চিকিৎসায় শুরুর দিকে আইসিইউ সংকট হলেও সরকারের স্বাস্থ্যবিভাগ তা অনেকটাই কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় ২৫ আগস্ট মঙ্গলবার পর্যন্ত স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অ্যান্ড অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম সূত্র জানায়, করোনা আক্রান্তদের চিকিৎসা দিতে ঢাকা মহানগরীর ১১টি সরকারি, একটি স্বায়ত্তশাসিত ও ৯টি বেসরকারি হাসপাতালসহ ২১টি করোনা সেবায় উৎসর্গকৃত চিকিৎসা কেন্দ্রে ৬ হাজার ৬২৫টি সাধারণ শয্যার বিপরীতে ৩১০টি আইসিইউ শয্যা রয়েছে। এছাড়া চট্টগ্রাম মহানগরীতে সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে ৯টি করোনা হাসপাতালে ৩৯টি আইসিইউ শয্যা রয়েছে। এর বাইরে সারাদেশের অন্যান্য হাসপাতালে করোনা আক্রান্তদের চিকিৎসায় মোট ৫৪৮টি আইসিইউ শয্যা রয়েছে। তবে ২৫ আগস্ট ঢাকায় ১০৫টি, চট্টগ্রামে ১৬টি, অন্যান্য চিকিৎসাকেন্দ্র ৯৯টিসহ করোনার জন্য প্রস্তুতকৃত সারা দেশে ২২০টি আইসিইউ শয্যা রোগী শূন্য ছিল। চিকিৎসা বিশেষজ্ঞদের মতে, সাধারণত মুমূর্ষু রোগীদের চিকিৎসার ক্ষেত্রে আইসিইউ সেবার প্রয়োজন পড়ে। যেখানে বিশেষ ধরনের শয্যা, কৃত্রিম শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য ভেন্টিলেটর, টিউব, পাম্প, হার্টরেইট, বস্নাড প্রেসারসহ অন্যান্য শারীরিক পরিস্থিতির তাৎক্ষণিক চিত্র দেখার জন্য মনিটরসহ নানা অত্যাধুনিক মেডিকেল সরঞ্জাম ও আইসিইউ পরিচালনা করতে দক্ষ জনবল ও তাদের প্রত্যেকের বিশেষ সুরক্ষা পোশাকের প্রয়োজন হয়। কিছু সংখ্যক সরকারি হাসপাতালে এই চিকিৎসা ব্যবস্থা থাকলেও প্রয়োজনীয় সহায়ক সরঞ্জাম ও তা পরিচালনায় বিশেষজ্ঞ জনবল সংকটে কোন রকমে চলছে। অন্যদিকে বেসরকারিতে আইসিইউ\’র সেবার ব্যয় আকাশচুম্বী হওয়ায় সাধারণ রোগীদের নাগালের বাইরে থাকছে। বেসরকারি হাসপাতালগুলোর আইসিইউ কেন্দ্রে প্রতিদিন গড়ে ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকার মতো ব্যয় করতে হয়। এই পরিমাণ অর্থ যোগান দেয়া সাধারণ মানুষের পক্ষে ভীষণ কষ্টকর। ফলে দেশের সব জেলা হাসপাতালে জরুরিভিত্তিতে প্রায় ৫০০টি আইসিইউ ইউনিট স্থাপন করার আশ্বাস দেন। চলতি বছরের ২রা জুন একনেক সভায় করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে রোগীদের জন্য আইসিইউ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠায় এ প্রসঙ্গে আলোচনা হয় এবং স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী দেশের প্রত্যেকটি জেলা হাসপাতালে আইসিইউ ইউনিট স্থাপনের নির্দেশ দেন। কিন্তু এতসব আশ্বাসের পরও রোগীদের চাহিদা অনুযায়ী আইসিইউ বেড স্থাপনে কোনো অগ্রগতি দৃশ্যমান নয়।
একাধিক জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অভিযোগ করেন, বছরের শুরুতে এক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের জনসংখ্যার অনুপাতে আইসিইউ বেডের সংখ্যা দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের চেয়ে কম। গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী প্রতিবেশী দেশ নেপালে প্রতি এক লাখ মানুষের জন আইসিইউ আছে ২ দশমিক ৮টি, ভারত ও শ্রীলংকায় ২ দশমিক ৩টি, পাকিস্তানে ১ দশমিক ৫টি, মিয়ানমারে ১ দশমিক ১টি। সেখানে বাংলাদেশে আছে মাত্র দশমিক ৭টি। অর্থাৎ বাংলাদেশে প্রতি এক লাখ মানুষের জন্য একটি আইসিইউও নেই। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ডক্টর সেফটি ফাউন্ডেশনের একজন চিকিৎসক বলেন, সম্প্রতি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীরা বিভিন্ন হাসপাতালে গিয়েও সেবা থেকে বঞ্চিত হন। অনেক মুমূর্ষূ রোগী তাৎক্ষণিক ভাবে আইসিইউ সেবার প্রয়োজন হলেও বেড সংকটে মৃত্যুর কাছে হার মানতে হয়। কোভিড আক্রান্তদের সেবাপ্রাপ্তি কিছুটা সহজ হলেও অন্য মুর্মূষু রোগীর জন্য সুরক্ষায় সব জেলা হাসপাতালগুলোতে নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্র স্থাপন ঘোষণার বাস্তবায়ন হচ্ছে না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ পূর্ব এশীয় অঞ্চলের সাবেক উপদেষ্টা ডা. মোজাহেরুল হক বলেন, সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী প্রতিটি জেলায় আইসিইউ বেড তৈরির যে নির্দেশনা দিয়েছেন এটি সঠিক সিদ্ধান্ত। তবে হাসপাতালগুলোতে প্রতি এক লাখ লোকের অনুপাতে অন্তত ২টি বেড করা দরকার। এজন্য সরকারের উচিত হবে সরকারি বেসরকারি চিকিৎসা কেন্দ্রে শয্যা সংখ্যা হিসাব করে আইসিইউ ও এনআইসিইউ সেবা চালু করা। এর সঙ্গে অন্যান্য আনুষঙ্গিক সরঞ্জাম নিশ্চিতসহ তা পরিচালনার জন্য প্রশিক্ষিত নার্স ও ক্রিটিক্যাল কেয়ার স্পেশালিস্ট চিকিৎসক তৈরি করা।