১০ তলা এই ভবনটির নাম ‘লাক্সারি প্যালেস’। ফরিদপুর শহরের অভিজাত এলাকায় এটি মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে । বাইরে ফিটফাট এই ভবনে সব মিলিয়ে দুই শতাধিক লোকের বাস। বেশির ভাগই কেনা ফ্ল্যাটের বাসিন্দা। অন্যরা ভাড়াটে।
এমন একটি ভবনের নকশাতেই সেপটিক ট্যাংক ও সোকওয়েল (পয়োবর্জ্য বেরিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা) নেই। ভবনটির মলমূত্রসহ বিভিন্ন বর্জ্য যাচ্ছে পৌরসভার নর্দমায়। বিষয়টি জানতে পেরে সোচ্চার হয়েছেন বাসিন্দারা। এরপর থেকে মালিকপক্ষ তাঁদের নাজেহাল করছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
লাক্সারি প্যালেস ফরিদপুর শহরের ঝিলটুলী মহল্লায় অবস্থিত। ফরিদ শাহ সড়কে সাড়ে ৮ শতাংশ জমির ওপর তৈরি এই ভবনের প্রতিটি তলায় চারটি করে মোট ৪০টি ফ্ল্যাট আছে। একটি অফিসের জন্য, ২৭টি ফ্ল্যাট বিক্রি হয়েছে, ১২টিতে মালিকের ভাড়াটেরা থাকেন। ২০০৭ সালে ভবনের নির্মাণকাজ শুরু হয়। ২০০৮ সালের নভেম্বর থেকে বসবাস শুরু হয়।
ভবন নির্মাণকালে সেপটিক ট্যাংক ও সোকওয়েল না রাখার কথা স্বীকার করে মালিক মো. গোলজার আহম্মেদ খান বলেন, ‘পৌরসভা আমাকে যে নকশা পাস করে দিয়েছিল, তাতে সেপটিক ট্যাংক ও সোকওয়েল ছিল না।’ তবে পরে তিনি সেগুলো করে দিয়েছেন বলে দাবি করেন।
পরে কীভাবে সেপটিক ট্যাংক ও সোকওয়েল নির্মাণ করা হয়েছে, তা খতিয়ে দেখতে গিয়ে পাওয়া গেল এক অভিনব পদ্ধতি। সরেজমিনে দেখা যায়, ভবনের নিচতলায় গাড়ি রাখার জায়গার পূর্ব দিকে দুটি পিলারের মধ্যে দেয়াল তুলে ত্রিভুজ আকৃতির ছোট একটি সেপটিক ট্যাংক বানানো হয়েছে। সোকওয়েল করা হয়েছে ভবনের সামনে ফরিদ শাহ সড়কের পাশে পৌরসভার জায়গা ইজারা নিয়ে। ওই সেপটিক ট্যাংক থেকে সোকওয়েলটি আনুমানিক তিন ফুট ওপরে নির্মিত, যা কাজে আসার সুযোগ নেই।
ভবনের বাসিন্দারা বলছেন, বসবাস শুরুর পর পর্যায়ক্রমে তাঁরা জানতে পারেন, এই ভবনে সেপটিক ট্যাংক ও সোকওয়েল নেই। এরপর তাঁরা মালিকের কাছে গিয়ে প্রতিবাদ করেন। এরপর যেনতেনভাবে সেপটিক ট্যাংক ও সোকওয়েল নির্মাণ করা হয়েছে। ভবনের বাসিন্দা এস এ তাহের বলেন, লোকদেখানো এই সেপটিক ট্যাংকে ভবনের দক্ষিণ অংশের কয়েকটি ফ্ল্যাটের সংযোগ দেওয়া গেছে। উত্তর দিকের ফ্ল্যাটগুলোর পয়োবর্জ্যের পাইপ পৌরসভার নর্দমার সঙ্গে সংযুক্ত। সেই পয়োবর্জ্য কুমার নদে গিয়ে পড়ছে। দূষিত হচ্ছে নদের পানি।
প্রতিবাদে সোচ্চার হওয়ায় তাহেরকে নাজেহাল করা হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। ভবনের মালিক গোলজার আহম্মেদ গত ১০ জুলাই তাহেরের বিরুদ্ধে কোতোয়ালি থানায় চাঁদা দাবিসহ বিভিন্ন অভিযোগে সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। ওই দিনই পুলিশ তাহেরকে ধরে থানায় নিয়ে যায়। নয় ঘণ্টা আটকে রাখার পর তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়। এর আগে ‘নিয়ম মেনে চলব, কোনো সমস্যা হলে মালিককে জানাব, ফ্ল্যাট বিক্রিতে কোনো হস্তক্ষেপ করব না’ মর্মে ৫০ টাকার স্ট্যাম্পে তাহেরের স্বাক্ষর আদায় করা হয়। এই অঙ্গীকারনামার কোথাও চাঁদা দাবির কথা নেই।
এ প্রসঙ্গে গোলজার আহম্মেদ বলেন, তাহের নিজে ফ্ল্যাট কেনেননি। কিনেছেন তাঁর স্ত্রী। অথচ তিনি মালিক সমিতির নেতা হতে চাইছেন। এ জন্য নানা ধরনের ঝামেলা করছেন। তাই পুলিশের সাহায্য নেওয়া হয়েছে।
ভবনের বাসিন্দারা বলছেন, ভবনের পয়োনালা সংযোগ নির্মাণে ত্রুটি থাকায় ওই পাইপ ছিদ্র হয়ে মলমূত্র ভবনের নিচে পড়ায় দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। সার্বিক বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে ভবনের ১৬ জন নিবাসী গত ১ জুলাই পৌরসভা কর্তৃপক্ষকে লিখিত অভিযোগ দেন। অনুলিপি দেওয়া হয় গণপূর্ত বিভাগ ও পরিবেশ অধিদপ্তরকেও। আবেদনে ভবনমালিকের বিরুদ্ধে অবিলম্বে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানান তাঁরা।
তবে গোলজার আহম্মেদ বলেন, ক্রেতারা সব শর্ত মেনেই ফ্ল্যাট কিনেছেন। ভবনের পয়োবর্জ্য পৌরসভার নর্দমায় ফেলা হচ্ছে না বলে দাবি করেন তিনি।
ফরিদপুর পৌরসভার মেয়র শেখ মাহতাব আলী বলেন, ‘লাক্সারি প্যালেসের মলমূত্র পৌরসভার নর্দমায় ফেলা হচ্ছে বলে আমি লিখিত অভিযোগ পেয়েছি। এ ব্যাপারে মালিককে একাধিকবার নোটিশ দেওয়া হয়েছে, কিন্তু তিনি কোনো জবাব দেননি।’ সেপটিক ট্যাংক ছাড়াই নকশার অনুমোদন প্রসঙ্গে মেয়র বলেন, নকশা যখন অনুমোদন হয়েছে, তখন তিনি মেয়র ছিলেন না।
অভিযোগ ওঠার পরিপ্রেক্ষিতে লাক্সারি প্যালেস পরিদর্শন করে একটি প্রতিবেদন দেওয়ার দায়িত্ব পেয়েছেন ফরিদপুর গণপূর্ত অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী মানিকলাল দাস। এমন একটি বহুতল ভবনে সেপটিক ট্যাংক ও সোকওয়েল নেই শুনে তিনি রীতিমতো বিস্মিত। মানিকলাল দাস বলেন, এমন একটি বহুতল ভবনের ক্ষেত্রে সেপটিক ট্যাংক ও সোকওয়েল অবশ্যই থাকতে হবে। যেসব বড় নগরীতে পয়োনিষ্কাশনের ব্যবস্থা আছে, সেখানে আলাদা কথা। কিন্তু ফরিদপুরের মতো শহরে বহুতল ভবনের ক্ষেত্রে সেপটিক ট্যাংক ও সোকওয়েলের বিকল্প নেই। তিনি অচিরেই লাক্সারি প্যালেস সরেজমিনে পরিদর্শন করে জেলা প্রশাসকের কাছে প্রতিবেদন জমা দেবেন। সৌজন্যেঃ প্রথম আলো
বাংলাদেশ সময় : ১৩২২ ঘণ্টা, ০৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৭,
লেটেস্টবিডিনিউজ.কম/এ