‘অহেতুক সমালোচনায় মেয়েটি কর্মস্পৃহা হারাবে’

রাজধানী ঢাকার তাপমাত্রা সহনীয় পর্যায়ে রাখতে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র আতিকুল ইসলামের মেয়ে বুশরা আফরিনকে এশিয়ার প্রথম শহর হিসেবে একজন চিফ হিট অফিসার (সিএইচও) হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। গত বুধবার (০৩ মে) আনুষ্ঠানিকভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এ সংক্রান্ত এক অনুষ্ঠানে বুশরার নিয়োগের বিষয়টি জানানো হয়।

তার নিয়োগের এ খবর প্রথমে গণমাধ্যমে প্রকাশিত হলেও পরে মুহূর্তে তা ছড়িয়ে পড়ে বিভিন্ন সামাজিকমাধ্যমে। সেখানে তাকে নিয়ে শুরু হয় বিভিন্ন আলোচনা-সমালোচন। কেউ তুলছেন স্বজনপ্রীতির অভিযোগ আবার কেউ বলছেন ধরেই তিনি চিফ হয়ে গেছেন। কেউ তাকে নিয়ে নানান রকম কুরুচিপূর্ণ মন্তব্যও ছুড়ে দিচ্ছেন।

সামাজিক মাধ্যম ফেসবুক ঘুরে দেখা গেছে, বুশরা আফরিনকে নিয়ে সমালোচনা হলেও অনেকে তার পক্ষেও মতামত তুলে ধরেছেন। তাদের কেউ কেউ সমালোচনা বন্ধ করতে অনুরোধ জানিয়েছেন। বলেছেন এভাবে অহেতুক সমালোচনা করলে মেধাবীদের মেধা দেশের উপকারে কাজে লাগানো সম্ভব হবে না। তারা দেশ ছাড়তে বাধ্য হবেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক মাহমুদুর রহমান লিখেছেন, ‘‘কেউ স্বজনপ্রীতির অভিযোগ তুললে, মহৎ উদ্যোগ ভেস্তে যাবে। আঙ্গুর ক্ষেত দিয়ে হাটার সময় মাথা না চুলকানো আর তরমুজ ক্ষেত দিয়ে হাটার সময় জুতার ফিতা না বাঁধা উত্তম। অহেতুক সমালোচনা ও সন্দেহের জন্ম দেয়ার মতো কোন কাজ না করাই উত্তম। শেষ পযন্ত মেধাবী মেয়েটি সমালোচনার মুখে কর্মস্পৃহা হারিয়ে দেশ ছাড়বে।’’

জুলকারনাইন সায়ের নামে প্রবাসী এক সাংবাদিক লিখেছেন, লক্ষ্য করলাম বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের বিশেষ করে প্রধান বিরোধী দল বিএনপির অনেক নেতা-কর্মীরা ঢাকা উত্তরের মেয়র আতিকুল ইসলামের মেয়ের বিভিন্ন ছবি যা-তা কথা লিখে পোস্ট করছেন। এই কাজটা কেন করছেন?

তিনি লিখেছেন, হিট অফিসার কথাটা নিয়ে ঠাট্টা করছেন বুঝলাম, আমি নিজেও মজার ছলে সত্য একটা ঘটনা লিখেছি। কিন্তু ওই ব্যক্তিটির ছবি নিয়ে নোংরামি কেন করছেন? আপনাদের দলের কোন কর্মী-নেতার মেয়েকে নিয়ে যদি কেউ এমন করতো ভালো লাগতো না নিশ্চই? এসব ফালতু মিনিংলেস কাজ বন্ধ করুন।

বুশরা আফরিন কানাডার কুইন্স ইউনিভার্সিটি থেকে গ্লোবাল ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ ও ঘানার ইনস্টিটিউট অব লোকাল গভর্নমেন্ট স্টাডিজে পড়াশোনা করেছেন। তিনি ঘানার বলগাটাঙ্গায় একটি নারী উন্নয়ন প্রকল্পেও কাজ করেন। পরে বুশরা বাংলাদেশের বৃহত্তম এনজিও ‘শক্তি ফাউন্ডেশনের’ ব্যবস্থাপনা নির্বাহী হিসেবে যোগ দেন। এছাড়া বাংলাদেশের বিশিষ্ট প্রাণী অধিকার সংস্থা অভয়ারণ্যের পলিসি কনসালটেন্ট হিসেবে ডিএনসিসির সাথে কাজ করেন।

বুশরা আফরিনের বেড়ে ওঠা ঢাকাতেই। তিনি বলেছেন, ছেলেবেলায় শুনতেন, পড়াশোনা বা কাজের খোঁজে অনেকেই রাজধানী শহর ছেড়ে বিদেশে পাড়ি জমান। এখনো অনেকে যাচ্ছেন। তাঁদের একাংশের কারণটা ভিন্ন, ঢাকার দাবদাহ থেকে রক্ষা পাওয়া।

গেল মাসে ভয়াবহ তাপপ্রবাহের কবলে পড়ে বাংলাদেশ। কয়েকটি জেলায় তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়ে যায়। ঢাকার তাপমাত্রার পারদ চড়ে সর্বোচ্চ ৪০ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। রাজধানীতে এটা ছিল গত ছয় দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ। বিশ্বব্যাংকের ২০২১ সালের একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশকে প্রায় প্রতিবছরই এমন তাপপ্রবাহের কবলে পড়তে যাচ্ছে।

এমনই এক সংকটের মধ্যে বুধবার বুশরা আফরিন ‘চিফ হিট অফিসার’-এর দায়িত্ব পেয়েছেন। এশিয়ায় প্রথম চিফ হিট অফিসারও তিনি। এর বাইরে যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা অঙ্গরাজ্যের মিয়ামি, সিয়েরা লিওনের ফ্রিটাউন, গ্রিসের এথেন্স, চিলির সান্তিয়াগো, মেক্সিকোর মনট্রে ও অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন শহরে চিফ হিট অফিসার রয়েছেন। বুশরার মতো তাঁরা সবাই নারী।

তার কাজ সম্পর্কে গতকাল বৃহস্পতিবার সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেছেন বুশরা আফরিন। তিনি বলেছেন, ‘‘আমরা হিট মেসেজিং নিয়ে কাজ করবো, সচেতন করবো। কারণ সচেতনতা হলো প্রতিরোধের প্রথম ধাপ। বয়স্ক, শিশু, গর্ভবতী নারী এবং যারা শারীরিকভাবে অসুস্থ, তারা যেন নিরাপদে থাকেন। এগুলো আমাদের এখানে মানুষ জানে না।’’

তবুও যেন থামছে না আলোচনা-সমালোচনা। তার নিয়োগ বিষয়ে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (অতিরিক্ত সচিব) সেলিম রেজা বলেছেন, চিফ হিট অফিসার‘ পদটি ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের নয়, এই পদে উত্তর সিটি কাউকে নিয়োগ দেয়নি। বুশরা আফরিনকে নিয়োগ দিয়েছে বিদেশী একটি প্রতিষ্ঠান; যারা জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলায় কাজ করে।

বুশরা আফরিনকে নিয়ে করা নেতিবাচক ও কুরুচিপূর্ণ চর্চা বন্ধের আহ্বান জানিয়েছেন গণঅধিকার পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক মুহাম্মদ রাশেদ খান। তিনি ফেসবুকে লিখেছেন, মেয়র আতিকুল ইসলামের কন্যা ডিএনসিসির ‘চিফ হিট অফিসার’ হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন। তিনি ঢাকা শহরে তাপমাত্রা কমিয়ে আনতে নেতৃত্ব দেবেন। একবারে চিফ হয়েছেন, এজন্য অনেকে সমালোচনা করছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মাহমুদুর রহমানকে উদ্ধৃত করে রাশেদ লিখেছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষক মন্তব্য করেছেন, কেউ স্বজনপ্রীতির অভিযোগ তুললে মহৎ উদ্যোগ ভেস্তে যাবে।… স্বজনপ্রীতির অভিযোগ এনে সমালোচনা করে এসব মেধাবী মুখদের দেশ ছাড়তে বাধ্য করবেন না। বিদেশে সুখের জীবন ত্যাগ করে গুম-খুন, ভয়ভীতির দেশে তারা আছেন, এটাই আমাদের সৌভাগ্য নয় কি?