জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের পর থেকেই রাজধানীসহ সারা দেশে ব্যাপক হারে লোডশেডিং বেড়েছে। রাজধানীতে কিছুটা কম থাকলেও ঢাকার বাইরের অন্যান্য শহরসহ মফস্বলে দিনে ও রাতে গড়ে ৬-৭ ঘণ্টা লোডশেডিং হওয়ার খবর পাওয়া যাচ্ছে। বিতরণ কোম্পানিগুলোর সঙ্গে কথা বলে জানা গিয়েছে, চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে ব্যাপক তারতম্য তৈরি হওয়ার কারণে এ ধরনের পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে।
বিদ্যুৎ বিভাগ বলছে, গ্রিড বিপর্যয়ের পর অনেক বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন এখনো বন্ধ রয়েছে। এগুলো উৎপাদনে আসতে সপ্তাহ খানেক লেগে যাবে। বিদ্যুৎ উৎপাদন কম হওয়ায় লোডশেডিং পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে। তবে অন্য একটি সূত্রের দাবি, গ্যাসের ঘাটতির কারণে বিদ্যুৎকেন্দ্রে জ্বালানি সরবরাহ কমে গিয়েছে, যার কারণে চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাচ্ছে না। ফলে লোডশেডিং দিতে হচ্ছে।
পাওয়ার গ্রিড কোম্পানির বিদ্যুৎ চাহিদা ও সরবরাহের তথ্য অনুযায়ী, ৭ অক্টোবর দেশে পিক আওয়ারে বিদ্যুতের চাহিদা ছিল ১২ হাজার ৯০০ মেগাওয়াট। বিপরীতে সেদিন উৎপাদন হয় ১১ হাজার ৫৭ মেগাওয়াট। ওইদিন লোডশেডিং করা হয়েছে ১ হাজার ৬৯৮ মেগাওয়াট। মূলত চাহিদার ঘাটতি বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানিগুলো লোডশেডিং দিয়ে সমন্বয় করছে।
বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানিগুলোর কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গিয়েছে, একটি বিতরণ কোম্পানির আওতায় অন্তত ২০০-২৫০ মেগাওয়াট লোডশেডিং করতে হচ্ছে। এটি করতে গিয়ে কখনো কখনো তাদের কয়েক দফায় লোডশেডিং করতে হচ্ছে। দিনের বেলায় লোডশেডিং কম হলেও রাতের বেলায় আরো বেশি হচ্ছে।
জানতে চাইলে ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি লিমিটেডের (ডেসকো) ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী মো. কাওসার আমীর আলী গণমাধ্যমকে বলেন, ডেসকোর আওতায় রুটিন অনুযায়ী ২ ঘণ্টা করে লোডশেডিং করার কথা থাকলেও তা মেনে চলা সম্ভব হচ্ছে না। কারণ ডেসকো এলাকায় যে পরিমাণ বিদ্যুতের চাহিদা তার চেয়ে ২৪০-২৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কম পাওয়া যাচ্ছে। দিনে লোডশেডিং কমানো গেলেও রাতে বেশি দিতে হচ্ছে।
ডেসকো এলাকায় গতকাল অফ পিক আওয়ারে বিদ্যুতের চাহিদা ছিল ৯৫০ মেগাওয়াট, কিন্তু সেখানে তারা পেয়েছে ৭০০ মেগাওয়াটের মতো। ফলে সমন্বয় করতে গিয়ে প্রতিটি ফিডারে ১ ঘণ্টা করে দু-তিনবার লোডশেডিং দিতে হয়েছে।
ঢাকার বিদ্যুৎ বিতরণের আরেক কোম্পানি ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (ডিপিডিসি) লোডশেডিংয়ের চিত্রও অনেকটা একই রকম। এ সংস্থার পক্ষেও শিডিউল মেনে লোডশেডিং করা সম্ভব হচ্ছে না। তবে পিক আওয়ারে লোডশেডিং যথাসম্ভব কমিয়ে রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে।
নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে ডিপিডিসির এক কর্মকর্তা গণমাধ্যমকে বলেন, আমরা পিক আওয়ারে লোডশেডিং কম রাখার চেষ্টা করছি। তবে সরবরাহ কম পাওয়ায় সেটি অনেক ক্ষেত্রে মেনে চলা সম্ভব হচ্ছে না। বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হলেই গ্রাহকদের কাছ থেকে ব্যাপক হারে অভিযোগ আসতে শুরু করে। কিন্তু আমাদেরও লোডশেডিং না দিয়ে উপায় নেই।
রাতে বিদ্যুতের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় ঢাকাসহ সারা দেশে মাত্রাতিরিক্ত লোডশেডিং দেখা দিয়েছে। ফলে ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে শিশু, শিক্ষার্থী, রোগী ও ব্যবসায়ীসহ নানা শ্রেণী-পেশার মানুষকে। তবে লোডশেডিংয়ের মাত্রা সবচেয়ে বেশি বেড়ে গিয়েছে মফস্বল এলাকায়। দেশের দক্ষিণ ও উত্তরের বিভিন্ন জেলার বিদ্যুতের গ্রাহকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গিয়েছে, ব্যাপক হারে লোডশেডিং পাচ্ছেন তারা। দিন-রাত মিলিয়ে অন্তত ৬-৭ ঘণ্টা বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ থাকছে বলে তাদের অভিযোগ।
দেশের উত্তরাঞ্চলীয় জেলা ঠাকুরগাঁওয়ের রানীশংকৈল উপজেলার শামীম রাহমান গণমাধ্যমকে জানান, দিনে ও রাতে ২ ঘণ্টা করে লোডশেডিং দেয়ার কথা থাকলেও এখন কোনো নিয়মনীতি নেই। কয়েক দফায় অন্তত ৬-৭ ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকছে না। দিনে ও রাতের গুরুত্বপূর্ণ সময়গুলোতেই বিদ্যুৎ থাকছে না। বিদ্যুতের স্থানীয় অফিসগুলোয় যোগাযোগ করা হলেও তারা কোনো সন্তোষজনক উত্তর দিতে পারছে না।
একই অবস্থা দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় জেলা যশোরে। সেখানেও ৫-৬ ঘণ্টা বিদ্যুৎ না থাকার খবর পাওয়া যাচ্ছে। বিদ্যুৎ না থাকায় যশোরের ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পমালিকরা নানা ধরনের ভোগান্তির সম্মুখীন হচ্ছেন। সিলেট অঞ্চল থেকেও একই তথ্য পাওয়া গিয়েছে। অর্থাৎ সারা দেশেই বিদ্যুতের ব্যাপক হারে লোডশেডিং শুরু হয়েছে।
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড সিলেট বিভাগীয় কার্যালয়ের প্রধান প্রকৌশলী আব্দুল কাদির গণমাধ্যমকে জানান, গ্রিড লাইনে বিপর্যয়ের পর থেকেই মূলত বিদ্যুতের ঘাটতি বেড়েছে। আগে যেখানে দিনে ঘাটতি ছিল ২০ শতাংশ, এখন তা ৪৫ শতাংশের মতো হয়ে গিয়েছে।
পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশের (পিজিসিবি) কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, গ্রিড বিপর্যয়ের পর বিদ্যুতের চাহিদার পুরোটা এখনো সরবরাহ করা যায়নি। তাই লোডশেডিং বেড়েছে। তবে শিগগিরই পরিস্থিতির উন্নতি হবে।
তবে জ্বালানি বিভাগের এক কর্মকর্তা জানান, দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা কমে যাওয়ার পেছনে মূলত দায়ী জ্বালানি সংকট। বিশ্ববাজারে গ্যাসের দাম বেড়ে যাওয়ায় গ্যাসভিত্তিক অনেক বিদ্যুেন্দ্র বন্ধ রয়েছে। এর বিপরীতে তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো পূর্ণ সক্ষমতায় চালানো হচ্ছে। কয়লা ও ফার্নেস অয়েলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোও চালানো হচ্ছে। তবে সেগুলো চালিয়েও গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের মতো সরবরাহ দেয়া যাচ্ছে না।