গ্যাসের জন্য শিল্পকারখানায় হাহাকার, উৎপাদন কমেছে ৬০ শতাংশ

তৈরি পোশাক খাত থেকে শুরু সব ধরনের শিল্প কারখানায় গ্যাসের জন্য রীতিমতো হাহাকার চলছে। কারখানার উৎপাদন স্বাভাবিক রাখতে যেখানে ১২ থেকে ১৫ পিএসআই গ্যাস দরকার সেখানে পাওয়া যাচ্ছে সর্বোচ্চ ২ পিএসআই গ্যাস। দিন দিন শিল্পে গ্যাস সঙ্কট আরও গভীর হচ্ছে। ফলে দিনের অধিকাংশ সময় বন্ধ রাখতে হচ্ছে কারখানা। এতে উৎপাদন কমে গেছে ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ পর্যন্ত। রফতানি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। কিছু কিছু কারখানা মালিক ডিজেলচালিত মেশিন দিয়ে কারখানার কাজ চালু রাখার চেষ্টা করলেও ডিজেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় গুনতে হচ্ছে লোকসান। ফলে একদিকে শিল্প মালিকরা চরমভাবে আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়ে কারখানা বন্ধ করতে বাধ্য হচ্ছেন, অন্যদিকে কর্মহীন হয়ে পড়ছেন হাজার হাজার শ্রমিক।

বিজিএমইএ, বিকেএমইএ, বিটিএমএসহ বিভিন্ন ব্যবসায়ী সংগঠনের শীর্ষ নেতা এবং শিল্প মালিকদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে। তারা জানান, বিগত কয়েক মাস ধরে শিল্পে গ্যাস সঙ্কট চরম আকার ধারণ করেছে। এ জন্য তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী, বাণিজ্যমন্ত্রী, এমনকি প্রধানমন্ত্রীর দফতর পর্যন্ত কখনো চিঠি দিয়ে কখনো সরাসরি দেখা করে গ্যাস সঙ্কট থেকে প্রতিকার চেয়েছেন শিল্প মালিকরা। তবে আজ অবধি এর কোনো সুরাহা হয়নি, বরং সঙ্কট আরও বেড়েই চলেছে বলে তারা জানিয়েছেন।

এদিকে গ্যাস ভয়াবহ গ্যাস সঙ্কটের কারণে ডিজেলচালিত জেনারেটর দিয়ে দিনের অধিকাংশ সময় কারখানা চালু রাখায় বাড়ছে উৎপাদন ব্যয়। এ জন্য বিজিএমইএর পক্ষ থেকে গত সোমবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বরাবর আবেদন দিয়ে জানানো হয়েছে, শিল্প কারখানায় কম মূল্যে ডিজেল সরবরাহের ব্যবস্থা করতে। বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান স্বাক্ষরিত ওই চিঠিতে বলা হয়েছে, বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমেছে, সে জন্য দেশের বাজারেও দাম সমন্বয় করে যেন কম দামে ডিজেল সরবরাহ করা হয়। ওই চিঠিতে তিনি শিল্পের চলমান নানা সঙ্কটের কথাও তুলে ধরেন।

শিল্প মালিকরা বলছেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে তৈরি পোশাক খাতের বিশ্ববাজার অস্থির। গ্যাস সঙ্কটের কারণে সময়মতো পণ্য জাহাজীকরণ করা যাচ্ছে না। ফলে বৈশ্বিক ক্রেতাদের কাছে ভাবমুর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে। এই অবস্থা চলতে থাকলে ক্রেতাদের আস্থার সঙ্কট তৈরি হওয়াসহ দেশের রফতানিতে বড় ধরনের ধাক্কা লাগবে।

এই অবস্থায় গ্যাস সঙ্কট মোকাবিলায় সরকারকে বিকল্প জ্বালানির উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন এ খাতে উদ্যোক্তারা। তারা বলেন, ‘ফার্নিস অয়েলে আমদানি শুল্ক কমালে গ্যাস সঙ্কট কাটাতে প্রাথমিক বিকল্প হতে পারে। এখনই গ্যাসের বিকল্প জ্বালানির উদ্যোগ নেওয়া না গেলে আগামী নভেম্বর মাস থেকে শ্রমিক মজুরি ও কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন এই খাতের উদ্যোক্তারা।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রফতানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএ সহসভাপতি শহিদুল্লাহ আজিম সময়ের আলোকে বলেন, ‘গ্যাসের চাপ ১ থেকে ২ পিএসআই (পাউন্ড পার স্কয়ার ইন্স) নেমে এসেছে। এই চাপ ১০-১১ থাকলে কারখানা চালানো যায় তবে ১৫ হচ্ছে আদর্শ পিএসআই। বর্তমানে ক্যাপটিভ জেনারেটর চালানো যাচ্ছে না। ফলে উৎপাদন প্রায় তিন ভাগের এক ভাগে নেমে এসেছে।

বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সহ-সভাপতি আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘নারায়ণগঞ্জের কাঁচপুর, সিদ্ধিরগঞ্জ, রূপগঞ্জ অঞ্চলে গ্যাসের সরবরাহ প্রায় ৪-৫ পিএসআইতে নেমে আসে। এ ছাড়া নরসিংদী মাধবদীর একটি লাইন ৪-৫ পিএসআইতে চলে। আরেকটা লাইন রাতে বন্ধ থাকে। এ ছাড়া গাজীপুর অঞ্চলে ১-২ পিএসআই থাকে। কখনো কখনো তা শূন্যে নেমে আসে।’

তিনি বলেন, ‘একদিকে কার্যাদেশ কম, অন্যদিকে ইউটিলিটি সঙ্কট ফলে স্পিনিং মিলগুলোতে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। উইভিং মিলগুলোর মালিক অক্টোবর শেষে কারখানা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হবে। অনেক মালিক ইতোমধ্যে ব্যাংক ঋণের চাপে গা-ঢাকা দিচ্ছেন।’

আইএফএস টেক্সওয়ার লিমিটেড ব্যবস্থাপনা পরিচালক সালাউদ্দিন আহমেদ শামিম বলেন, ‘কার্যাদেশের ঘাটতি, উৎপাদন ব্যাহত, সময়মতো জাহাজীকরণ করতে না পারা এবং যুদ্ধের প্রভাবে তার প্রায় ৫০০ কোটি টাকার বিনিয়োগে হুমকিতে পড়েছে।

ক্রেতা পণ্য স্থগিত এবং না নেওয়ার কারণে ৮০ লাখ ডলারের পণ্য কারখানায় পড়ে আছে এবং দেরিতে উৎপাদন হওয়ায় ৬৬ লাখ ডলারের তৈরি পণ্য রফতানি করতে পারছে না। পাঁচ লাখ ডলারের পণ্য ক্রেতার বিক্রি নেই বলে স্থগিত করে যে পণ্য ওই পণ্য এখনও চট্টগ্রাম বন্দরে আনলোড হয়নি।’

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সাভার শিল্পাঞ্চলে গ্যাস সঙ্কটের কারণে নিটিং, ডায়িং ও টেক্সটাইল কারখানায় উৎপাদন কমে এসেছে অর্ধেকেরও কমে। বিদ্যুৎ সঙ্কটের পর শিল্প খাতে গ্যাসের চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় শতভাগ চাহিদার বিপরীতে সরবরাহ ১০ ভাগ কিংবা শূন্যের কোটায় নেমে এসেছে। ফলে এই খাতে জরুরি ভিত্তিতে জ্বালানির চাহিদা পূরণের দাবি জানিয়েছে শিল্পসংশ্লিষ্টরা। অপরদিকে সঙ্কটের কথা স্বীকার করে আগামী ১ থেকে ২ মাসের মধ্যেই সমস্যা সমাধানের আশ্বাস দিয়েছে তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ।

জানা গেছে, সাভার, আশুলিয়া ও ধামরাই এলাকায় তৈরি পোশাক কারখানাসহ টেক্সটাইল ও ইঞ্জিনিয়ারিং কারখানায় বিদ্যুৎ এবং গ্যাসের চাহিদা পূরণ না হওয়ায় উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে সমহারে। শিল্পসংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, দীর্ঘ ছয় মাস ধরে প্রথমে বিদ্যুৎ সঙ্কট ও পরে জেনারেটরে ব্যবহৃত গ্যাসের সঙ্কট তাদের বিপাকে ফেলেছে। এই অঞ্চলে প্রায় ছয় শতাধিক নিটিং ও ডায়িং এবং চার শতাধিক টেক্সটাইল কারখানায় বিদ্যুতের বিকল্প হিসেবে গ্যাস জেনারেটর পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়।

লোটাস ইঞ্জিনিয়ারিং ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড কারখানার ম্যানেজার (অ্যাডমিন) আমির হোসেন বলেন, ‘ছয় মাস ধরে ঠিক মতো বিদ্যুৎ ও গ্যাসের সরবরাহ না থাকায় শ্রমিক কর্মচারীরা উৎপাদন কাজ করতে না পারায় তাদের মাসিক উপার্জন যেমন কমে এসেছে, তেমনি মালিক পক্ষের প্রতি মাসে ৫০ থেকে ৮০ লাখ টাকা ভর্তুকি দিতে হচ্ছে। তাই অচিরেই এই সমস্যার সমাধান না হলে কারখানাটি বন্ধ হয়ে যাবে। বেকারত্ব বরণ করবে হাজারও শ্রমিক।

সাভার আঞ্চলিক তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির ব্যবস্থাপক (বিপণন) আবু সাদাত মো. সায়েম শিল্পাঞ্চলে গ্যাস সঙ্কটের কথা স্বীকার করে বলেন, ‘একযোগে গ্যাসের ওপর চাপ পড়ায় হাজার হাজার শিল্প কারখানায় সঠিকভাবে গ্যাস সরবরাহ করা সম্ভব হচ্ছে না।’ তবে আগামী ১ থেকে ২ মাসের মধ্যে বিকল্প পদ্ধতির মাধ্যমে এই সমস্যা সমাধান করা হবে বলেও আশ্বস্ত করেন তিনি।

সাভার তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির আওতায় সাভার, আশুলিয়া, ধামরাই ও গাজীপুরের কাশিমপুরে বৈধ আবাসিক গ্যাস গ্রাহকের সংখ্যা প্রায় ৫১ হাজার। শিল্প সংযোগের সংখ্যা রয়েছে এক হাজারেরও অধিক।

নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুরসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গত মাসের শুরু থেকেই গ্যাসের সঙ্কট প্রকট হতে থাকে, যা এখনও কাটেনি। গ্যাসের অভাবে অনেক কারখানা বন্ধ রাখতে হচ্ছে। কখনো কখনো গ্যাসের চাপ বাড়লে শিল্প কারখানা চলে, আবার মাঝে মধ্যে বন্ধ রাখতে হয়।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে গাজীপুরের এক ব্যবসায়ী বলেন, ‘গ্যাসের যে কি ভয়াবহ সঙ্কট, সেটা বুঝিয়ে বলতে পারব না।’ তিনি বলেন, ‘এ অবস্থা বেশিদিন চললে কারখানা পুরোপুরি বন্ধ রাখতে হবে। এখন এলপিজি দিয়ে কারখানা কোনোরকম চালু রাখার চেষ্টা করছি। তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করছি; কিন্তু কোনোভাবেই গ্যাসের চাপ বাড়াতে পারছি না।

নারায়ণগঞ্জের ডায়িং কারখানার এক মালিক বলেন, ‘গ্যাসের অভাবে গত সপ্তাহে প্রায় পাঁচদিন টানা তার কারখানা বন্ধ ছিল। এভাবে বন্ধ থাকতে থাকতে অনেক কারখানা মালিক আর চালু করতে পারেননি। এভাবে শুধু নারায়ণগঞ্জ এলাকায়ই ৩৫ থেকে ৪০টি ছোট-বড় শিল্প কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে।

গ্যাস সঙ্কটের বিষয়ে বিকেএমইএ নির্বাহী সভাপতি মো. হাতেম সময়ের আলোকে বলেন, ‘ক্যানসার আক্রান্ত হলে যেমন মানুষ ধীরে ধীরে মরে যায়, ঠিক তেমনি বাংলাদেশের শিল্প কারখানা ধীরে ধীরে মরে যাচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘গ্যাসের সঙ্কটের কারণে শিল্প কারখানা বন্ধ রাখতে হচ্ছে। অনেক নিট কারখানা বন্ধ হয়ে পড়েছে।’

পেট্রোবাংলার পরিচালক (অপারেশন) মো. কামরুজ্জামান বলেন, ‘গ্যাসের চাহিদা এবং সরবরাহে কিছুটা ঘাটতি আছে। তবে সরকার চেষ্টা করছে সরবরাহ স্বাভাবিক করার। আশা করছি দু-এক মাসের মধ্যে পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হবে। কারণ সামনে শীত পড়লে বিদ্যুৎকেন্দ্রে গ্যাসের সরবরাহ কিছুটা কমিয়ে শিল্পে বাড়ানো হবে।’

দেশের সবচেয়ে বড় গ্যাস বিতরণ কোম্পানি তিতাস গ্যাসের এমডি মো. হারুনুর রশিদ মোল্লা বলেন, ‘স্পট মার্কেটে দাম বেশি থাকায় সেখান থেকে এলএনজি কেনা বন্ধ আছে। ফলে গ্যাসের কিছুটা সঙ্কট চলছে। তবে উচ্চপর্যায় থেকে গ্যাসের সঙ্কট সমাধানের বিষয়ে ভাবা হচ্ছে।’

তিতাস গ্যাস সূত্রে জানা যায়, তাদের বিতরণ এলাকায় প্রায় ১৮০ কোটি ঘনফুট গ্যাসের চাহিদা রয়েছে। বিপরীতে মিলছে ১৬০ কোটি ঘনফুট। ফলে প্রতিদিন প্রায় ২০ কোটি ঘনফুট গ্যাসের ঘাটতি রয়েছে কোম্পানিতে।

বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সভাপতি মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘অনেক শিল্প কারখানা মালিক দেউলিয়া হয়ে যাচ্ছেন, অনেকেই কারখানা বন্ধ করে দিচ্ছেন।’

গ্যাস সঙ্কটের মূল কারণ

দেশে প্রকৃত গ্যাসের চাহিদা কত, তার কোনো সঠিক হিসাব নেই। পেট্রোবাংলা এবং তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি সূত্রে জানা যায়, শিল্প মালিকরা প্রতিদিন গ্যাসের সংযোগ বা কারখানার গ্যাসের লোড বাড়াতে যে পরিমাণ দৌড়ঝাঁপ করেন, তাতে পাঁচ হাজার এমএমসিএফডি গ্যাস সরবরাহ করলেও সেটা ব্যবহার হবে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মোটামুটি চার হাজার এমএমসিএফডি গ্যাস প্রতিদিন সরবরাহ করতে পারলে বিদ্যুৎকেন্দ্র, শিল্প কারখানা বা আবাসিক গ্রাহকরা সন্তুষ্ট থাকবে। কিন্তু প্রতিদিন সরবরাহ হচ্ছে ২৭০০ এমএমসিএফডি। এ বিশাল ঘাটতি মোকাবিলায় সরকার চরম হিমশিম খাচ্ছে।

পেট্রোবাংলার তথ্য বলছে, এখন সারাদিন পেট্রোবাংলা ২৭৮৯ থেকে ২৮০০ এমএমসিএফডি গ্যাসের সরবরাহ করেছে। এর মধ্যে এলএনজি ৪৮১ এমএমসিএফডি। বাকিটা দেশের অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে উত্তোলিত।