১৯৭১ সাল, যুদ্ধ চলছে সারা দেশে। উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠার মধ্যে সাধারণ মানুষ দিন কাটাচ্ছে। ২৫ মার্চের পরপরই পাকিস্তান সেনাবাহিনী পুড়িয়ে দিয়েছে পাকশী রেলবাজার। সেই রেলবাজারে কাশেম মোল্লা দিয়েছিলেন একটি মুদি দোকান।
বাজারটি পুড়ে যাওয়ার পর নিঃস্ব হয়ে কাশেম মোল্লা চলে যান নিজ গ্রাম পাকশীর রূপপুরে। নিজের হাতে লাগান একটি কড়ই গাছ, পাশেই চালু করেন একটি চায়ের দোকান। তার স্ত্রী আনোয়ারা বেগমের ইচ্ছায় কাশেম মোল্লা একটি থ্রি ব্যান্ডের রেডিও কেনেন।
সে সময় পাঁচ গ্রাম খুঁজেও একটি রেডিও পাওয়া যেত না। তিনি রেডিওটি দোকানে নিয়ে যেতেন চায়ের দোকানে ক্রেতাদের ভিড় জমানোর জন্য। দেশের সামগ্রিক অবস্থা নিয়ে খবর প্রচারিত হতো বিবিসি বাংলায়।
রাতে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র এবং বিবিসি, ভয়েস অব আমেরিকা ও কলকাতা বেতারের খবর শোনার জন্য আশপাশের মানুষ ভিড় জমাত তার চায়ের দোকানে। চা খেতে আসা লোকজনদের সম্পর্কে অনেক তথ্য থাকত কাশেম মোল্লার কাছে। গোপনে মুক্তিযোদ্ধাদের দেশীয় দোসর, রাজাকার ও পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী সম্পর্কে তথ্য দিতেন তিনি। ক্রমেই ভিড় বাড়ে তার দোকানে।
মুক্তিযোদ্ধারা খবর শোনার জন্য তার চায়ের দোকানে অবস্থান নিতেন। সে সময় বিবিসিতে মুক্তিযুদ্ধের খবর শুনে উৎসাহিত হয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন গ্রামের অনেকে।
৯ মাস বাংলাদেশে যুদ্ধের ভয়াবহতা আড়ালে রাখতে সম্ভাব্য সব ধরনের চেষ্টাই করেছিল পাকিস্তান সরকার। এর অন্যতম ছিল সংবাদমাধ্যমকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে না দেওয়া। একাত্তরে বিবিসির দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক সংবাদদাতা ছিলেন মার্ক টালি। রেডিওতে কান পেতে সকাল-সন্ধ্যা তার কণ্ঠ শোনার অপেক্ষায় থাকত পুরো দেশ। বাংলাদেশের পক্ষে বিশ্ব জনমত গঠনে তার ভূমিকা ছিল অনন্য। মার্ক টালি ২৫ মার্চের বর্বর হামলা প্রত্যক্ষ করেছিলেন।
পরে তাকে ঢাকা ছেড়ে যেতে হয়। অবশ্য জুনের তৃতীয় সপ্তাহে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা বিদেশি সাংবাদিকদের পূর্ব-পাকিস্তান সফরের ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নিলে বিবিসি তাকে আবার বাংলাদেশে পাঠায়। মার্ক টালি তখন ঢাকায় না এলেও তিনি সীমান্তবর্তী বিভিন্ন শরণার্থী শিবির ও জেলাগুলো ঘুরে বাঙালির দুর্দশা ও যুদ্ধকালীন পরিস্থিতির খবর পাঠাতে থাকেন দিল্লি থেকে। আবার লন্ডনে বসেও তিনি যুদ্ধের বিভিন্ন দিক নিয়ে বিশ্লেষণ হাজির করতেন।
সেই বিবিসি বাংলার রেডিও সম্প্রচার অনুষ্ঠানিকভাবে বন্ধ হতে যাচ্ছে। আরবি, হিন্দি, ফারসি, চীনাসহ মোট ১০টি ভাষার রেডিও সম্প্রচার বন্ধ করে দিচ্ছে বলে জানিয়েছে যুক্তরাজ্যের জাতীয় গণমাধ্যম ব্রিটিশ ব্রডকাস্টিং করপোরেশন। বৃহস্পতিবার বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বিবিসি তার আন্তর্জাতিক পরিষেবার জন্য বছরে ২৮ দশমিক পাঁচ মিলিয়ন পাউন্ড সঞ্চয়ের চেষ্টা করছে। এ জন্য ওয়ার্ল্ড সার্ভিসের ৩৮২টি পদ রহিত করার প্রস্তাব করছে বিবিসি।
এ বছরের মে মাসে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি প্রথমে তাদের এক হাজার কর্মী ছাঁটাই করার ঘোষণা দেয়। ছাঁটাইয়ের কারণ হিসেবে ব্রিটিশ পাবলিক সার্ভিস ব্রডকাস্টার জানায়, আর্থিক সঙ্কট মোকাবিলা এবং প্রথাগত সম্প্রচারমাধ্যম থেকে ডিজিটাল মাধ্যমে রূপান্তরে অগ্রাধিকার দিতে এক হাজার কর্মী ছাঁটাই করা হবে।
এ প্রসঙ্গে বিবিসির মহাপরিচালক টিম ডেভি বিবিসির কর্মীদের সামনে এক বক্তব্যে বলেন, ‘বিবিসি এমন নতুন ও বিশ্বব্যাপী ডিজিটাল মিডিয়া সংস্থায় রূপান্তরিত হবে, যা আগে কখনো দেখা যায়নি। এ রূপান্তর প্রক্রিয়া দ্রুত করতে হবে এবং চারপাশের বাজারের বিশাল পরিবর্তনকে ধারণ করতে হবে। আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে ধাপে ধাপে বেশ কিছু পরিবর্তন আসবে। বিবিসি ওয়ার্ল্ডকে সারা বিশ্বে ২৪ ঘণ্টার একটি নিউজ চ্যানেল হিসেবে গড়ে তোলা হবে। পাঠক যেমন খবর চায়, তেমন খবর পরিবেশন করা হবে।’
তিনিও আরও বলেন, তারা ‘ডিজিটাল ফার্স্ট পাবলিক সার্ভিস মিডিয়া অর্গানাইজেশন’ গঠন করবে। বিশ্বের বিভিন্ন ভাষার পরিষেবাগুলো একটি একক ডিজিটাল ওয়ার্ল্ড সার্ভিসে পরিণত করার ফলে শিশুদের চ্যানেল সিবিবিসি, বিবিসি ফোর ও রেডিও ফোর এক্সট্রা চ্যানেলের প্রথাগত সম্প্রচার বন্ধ হয়ে যাবে। বার্তা সংস্থা এএফপির এক প্রতিবেদনে এ তথ্যগুলো জানানো হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এক হাজার কর্মী ছাঁটাইসহ প্রথম পর্যায়ের পরিবর্তনগুলো করতে বছরে ৫০ কোটি পাউন্ড সাশ্রয় করবে বিবিসি।
তবে বিবিসি জানিয়েছে, কোনো ভাষার পরিষেবা একেবারে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে না। কয়েকটি অনলাইন পরিষেবার সঙ্গে যুক্ত হবে। বাংলাসহ চীনা, গুজরাটি, ইগবো, ইন্দোনেশীয়, পিজিন, উর্দু ও ইওরুবা ভাষার পরিষেবা শুধু অনলাইনভিত্তিক হয়ে যাবে। একই সঙ্গে বিবিসির বাংলা পরিসেবা লন্ডন থেকে সরিয়ে ঢাকায়, থাই পরিষেবা ব্যাংককে, কোরীয় পরিষেবা সিউলে এবং ফোকাস অন আফ্রিকা টিভি বুলেটিন পরিষেবা নাইরোবিতে স্থানান্তর করা হবে। পরিষেবা কার্যালয় লন্ডনে না রেখে সংশ্লিষ্ট শ্রোতাদের কাছাকাছি স্থানান্তর করা হবে। তবে রেডিও সম্প্রচারের পরিবর্তে আরবি ও ফারসি উভয় ভাষার নির্ধারিত টিভি সম্প্রচার অব্যাহত থাকবে। আরবি ও ফারসি ভাষার অডিও ও অন্যান্য ডিজিটাল সামর্থ্য বাড়াতে বিনিয়োগ করা হবে। করপোরেশনটি বলছে, উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও ক্রমবর্ধমান ব্যয়ের সমন্বিত চাপের ফলে কঠিন এই সিদ্ধান্তের দিকে যেতে হচ্ছে।
১৯৪১ সালের ১১ অক্টোবর বিবিসি বাংলায় ১৫ মিনিটের সাপ্তাহিক সম্প্রচার শুরু করে। তখন বার্তালিপি লিখতেন ব্রিটিশ ঔপন্যাসিক ও সাংবাদিক জর্জ অরওয়েল। আর সুধীন ঘোষ তা বাংলায় অনুবাদ করে সম্প্রচার করতেন। ১৯৪৪ সালের ২৩ জানুয়ারি থেকে বিবিসি প্রচার শুরু করে সপ্তাহে দুটি করে ১৫ মিনিটের অনুষ্ঠান। ১৯৪৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর থেকে তারা ১৫ মিনিটের দুটো অনুষ্ঠানের বদলে সপ্তাহে ৩০ মিনিটের একটি ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান শুরু, নাম ছিল বিচিত্রা। ১৯৪৯ সালের ৩০ অক্টোবর থেকে পূর্ব-পাকিস্তানের শ্রোতাদের জন্য সপ্তাহে আলাদা ৩০ মিনিটের অনুষ্ঠান শুরু হয় আঞ্জুমান নামে। যুক্ত হয় নারী ও শিশুদের জন্য আলাদা আলাদা অনুষ্ঠান। ১৯৫৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর থেকে একটি আধঘণ্টার সাপ্তাহিক অধিবেশন শুরু হয়। বিষয় ছিল ব্রিটিশ পত্রিকায় উপমহাদেশ প্রসঙ্গ পর্যালোচনা। সেই সঙ্গে চালু হয় ইংরেজি শেখার আসর। ১৯৬৫ সালের ১৬ নভেম্বর থেকে দৈনিক ১৫ মিনিটের প্রভাতী অনুষ্ঠান শুরু; তাতে থাকত ১০ মিনিটের বিশ্ব সংবাদ এবং পাঁচ মিনিটের সংবাদভাষ্য। ১৯৬৯ সালের ১ জুন থেকে প্রতি সন্ধ্যায় ১৫ মিনিটের অনুষ্ঠান শুরু হয় ‘প্রবাহ’ নামে।
১৯৯৪ সালে বিবিসি ঢাকায় এফএম সম্প্রচার শুরু এবং সন্ধ্যাবেলা ৪০ মিনিটের প্রবাহের পর শুধু ১০০ এফএম-এ ২০ মিনিটের বাড়তি অনুষ্ঠান চালু করে। ১৯৯৫ সালের সেপ্টেম্বর থেকে দুপুরবেলা আধঘণ্টার অনুষ্ঠান শুরু। ২০০৫ সালে চালু হয় বিবিসির বাংলা ওয়েবসাইট এবং ২০০৫ সালের নভেম্বরে বাংলাদেশ সংলাপ নামে একটি আলোচনা অনুষ্ঠান শুরু হয়। ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি শুরু হয় সকালের দ্বিতীয় আধঘণ্টার অধিবেশন প্রত্যুষা। ২০০৮ সালের মার্চে এফএম সম্প্রচার সম্প্রসারিত হয় খুলনা, চট্টগ্রাম, সিলেট, রাজশাহী, রংপুর ও কুমিল্লায়। ২০১৪ সালের বরিশাল, কক্সবাজারসহ ঢাকার বাইরে এফএম সম্প্রচারের পরিধি বিস্তৃত হয় ৯টি শহরে।
এ প্রসঙ্গে কথা হচ্ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা ও গণযোগাযোগ বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ফাহমিদুল হকের সঙ্গে, যিনি যুক্তরাষ্ট্রের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করছেন। তিনি মন্তব্য করলেন, ‘প্রযুক্তির দ্রুত পরিবর্তন ও মানুষের গণমাধ্যম ব্যবহারের অভ্যাস পাল্টে যাওয়ায়, এ হয়তো অনিবার্য ছিল। তবে বিবিসি বাংলার সঙ্গে বাংলাদেশের মানুষের ঐতিহাসিক সম্পর্কের বিচারে এ এক বিষাদময় খবর বটে।’
মুক্তিযুদ্ধের উত্তাল দিনগুলোতে স্বাধীন বাংলা বেতার কিংবা বিবিসির অনুষ্ঠান শোনাও ছিল অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। তবে সন্ধ্যা হলেই রূপপুর গ্রামে চাঞ্চল্য শুরু হতো। কাশেম মোল্লার চায়ের দোকানে বিবিসি খবর শোনাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে আরও কয়েকশ দোকান, বিস্তার লাভ করতে থাকে পরিধি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাজারটি ‘বিবিসি বাজার’ নামে নামকরণ হয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার কয়েক দিন আগে রাজাকারদের খবরের ভিত্তিতে হঠাৎ এক দিন পাকিস্তানি সেনারা হানা দেয় কাশেম মোল্লার চায়ের দোকানে। বিবিসি শোনার অপরাধে তারা রাইফেলের বাঁট দিয়ে তার পায়ে আঘাত করে। সেই থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত কাশেম মোল্লার সেই পা অকেজো ছিল।
১৯৯২ সালে বিবিসির পঞ্চাশ বছর পূর্তি উপলক্ষে লন্ডন থেকে তাদের একটি টিম বাংলাদেশে এসে কাশেম মোল্লার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে, পরিদর্শন করে বিবিসি বাজারটি। সেদিন রূপপুরে বিবিসির ইস্টার্ন সার্ভিস সেকশন প্রধান ভ্যারি ল্যাংরিজ, বাংলা বিভাগের তৎকালীন উপপ্রধান সিরাজুর রহমান, ভাষ্যকার দীপঙ্কর ঘোষ এবং বিবিসির সাবেক বাংলাদেশ সংবাদদাতা আতাউস সামাদও গিয়েছিলেন।
কাশেম মোল্লার লাগানো কড়ই গাছ বেশ মোটাতাজা হয়েছে। বিবিসি বাজার অনেকে চিনলেও জানে না বিবিসি বাজার গড়ে ওঠার পেছনে কাশেম মোল্লার অবদানের কথা। মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোতে মহা উৎকণ্ঠা, আশঙ্কার কথা জেনেও যিনি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ভরা বাজারে বসে শত শত মুক্তিযোদ্ধাকে শুনিয়েছেন বিবিসির খবর। কাশেম মোল্লা মারা গেছেন ২০১৫ সালে। তবে তার সেই রেডিও এখনও যত্ন করে রাখা আছে আলমারিতে। আজ বিবিসি বাংলা রেডিও সার্ভিস আনুষ্ঠানিকভাবে বন্ধ। তবে বাংলাদেশের গ্রামে-গঞ্জে হাজারো কাশেম মোল্লার স্মৃতিতে, ইতিহাসের পাতায় পাতায় বিবিসি বাংলা রেডিও সার্ভিসের নাম গৌরবের সঙ্গেই লেখা থাকবে।