আইপিডির গবেষণা: যে চারটি কারণে বন্যা ভয়াবহ রূপে

দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে চলমান বন্যা চার কারণে ভয়াবহ রূপ লাভ করেছে। এবারে ২০০ বছরের মধ্যে রেকর্ডভাঙা বৃষ্টি হয়েছে আপার মেঘনা ও বরাক অববাহিকায়। ওই পানি ধারণের মতো অবস্থা নেই হাওড়ে। এ অঞ্চলের সাত জেলার হাওড়ে গত ৩২ বছরে জলাভূমি কমেছে শতকরা ৮০ ভাগের বেশি। এছাড়া ঘরবাড়িসহ বিভিন্ন ধরনের স্থাপনা হাওড়ে বেড়েছে। এতে নির্মিত রাস্তাঘাট, স্লুইসগেট এবং বাঁধও বাধা দিচ্ছে বানের পানি প্রবাহে। কমে গেছে এ অঞ্চলের নদীর নাব্যতা। এ কারণে মৌসুমি বন্যা পরিণত হয়েছে স্মরণকালের মহাদুর্ভোগে।

এ তথ্য জানা গেছে ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইপিডি) গবেষণা ও বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলাপে। এদিকে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল এবং উত্তরাঞ্চলে চলমান এই বন্যা ৫ দিনের মধ্যে পুরোপুরি কেটে যেতে পারে। মূলত দেশের সিলেট অঞ্চল এবং ভারতের মেঘালয় ও আসামে আগামী ৭ দিন ভারি বৃষ্টির আশঙ্কা নেই। এর ফলে উজান বা অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে বড় পরিমাণে নতুন পানি যুক্ত হওয়ার আশঙ্কা কম।

এ মুহূর্তে সিলেট-সুনামগঞ্জ-নেত্রকোনায় যে ৫টি নদীর পানি বিপৎসীমার ওপরে আছে সেগুলোর মধ্যে কুশিয়ারা অমলশীদ পয়েন্টে সবচেয়ে উচ্চতায় ৬৭ সেন্টিমিটার ওপরে প্রবাহিত হচ্ছে। ওই পয়েন্টে ২৪ ঘণ্টায় ১৫ সেমি. পানি কমেছে। এই হারে পানি নেমে গেলে ৫ দিনে বন্যামুক্ত হবে ওই এলাকা। এর ফলে ওই এলাকার মানুষ ঈদের আগে বন্যামুক্ত হতে পারেন। বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের (এফএফডব্লিউসি) দুই সপ্তাহের এক দীর্ঘমেয়াদি পূর্বাভাসেও এ তথ্য পাওয়া গেছে।

বুয়েটের পানি ও বন্যা ব্যবস্থাপনা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. একেএম সাইফুল ইসলাম বলেন, ৭ দিনে তেমন বৃষ্টির আশঙ্কা নেই সিলেট, মেঘালয়সহ বরাক অববাহিকায়। ৭ দিন যে ২০০ মিলিমিটারের মতো বৃষ্টির পূর্বাভাস দেখা যাচ্ছে, তাতে এক সপ্তাহে পানি নেমে যাওয়ার পর এ পরিমাণ বৃষ্টি নতুন করে বন্যা সৃষ্টি করবে বলে মনে হচ্ছে না। তবে বানের পানি যেভাবে ধীরগতিতে নামছে, সেটি একটি দুশ্চিন্তার প্রধান কারণ। তবু আগামী দুই সপ্তাহ সিলেট নতুন কোনো বন্যায় ভুগবে বলে মনে হচ্ছে না।

এবারের এ বন্যার প্রথম কারণ দেশের ভেতরে আর ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় বিভিন্ন রাজ্যে অতিভারি বৃষ্টি। এবার মেঘালয়-আসামসহ বরাক অববাহিকায় ২০০ বছরের রেকর্ডভাঙা বৃষ্টি হয়। মেঘালয়ের চেরাপুঞ্জিকে পৃথিবীর শীতলতম স্থান বলা হলেও ১৭ জুন ওই রাজ্যেরই মাওসিনরামে ২৪ ঘণ্টায় ১০০৩ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়। একই দিন চেরাপুঞ্জিতে বৃষ্টি হয়েছে ৯৭২ মিলিমিটার। অন্যদিকে এফএফডব্লিউসির ১৭ জুনের এক হিসাবে দেখা যায়, সিলেটে জুনের স্বাভাবিক বৃষ্টির পরিমাণ ৮৪২ মিলিমিটার। কিন্তু ১৭ দিনেই ১০২২ মিলিমিটার হয়ে গেছে। আবার সুনামগঞ্জে জুনে গড় বৃষ্টি ১০৪৫ মিলিমিটার হলেও ১৭ জুনের মধ্যে ১৬০৩ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। এই বৃষ্টি পরে গত মাসের শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত কমবেশি অব্যাহত ছিল।

আইপিডির গবেষণা বলছে, ১৯৮৮ সালে হাওড়ে যে পরিমাণ জলাভূমি ছিল, ২০২০ সালে সেখান থেকে প্রায় ৭৭ শতাংশ কমে গেছে। এর মধ্যে ২০০৬ সালের মধ্যে কমে যায় ৪০ ভাগ, আর ২০২০ সালের মধ্যে আরও ৩৭ ভাগ। অন্যদিকে ২০২০ সালে শুকনো মৌসুমের জলাভূমির পরিমাণ সিলেটে ৭৫ ভাগ, সুনামগঞ্জে ৮০, নেত্রকোনায় ৯০, কিশোরগঞ্জে ৮৫, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ৭০, হবিগঞ্জে ৯০ এবং মৌলভীবাজারে প্রায় ৭০ ভাগ হ্রাস পেয়েছে। অর্থাৎ, সংরক্ষিত এলাকায়ও মানুষের থাবা পড়েছে। উল্লিখিত গবেষণায় বেরিয়ে এসেছে, ১৯৮৮ সাল থেকে হাওড়ের শুষ্ক মৌসুমের জলাভূমির পরিমাণ ২০ শতাংশ হ্রাস পায়। বাকি ৮০ শতাংশ জমিতে বসতবাড়ি, সড়কসহ বিভিন্ন ধরনের অবকাঠামো তৈরি হয়।

আইপিডির গবেষক পরিকল্পনাবিদ ইনজামামউল হক রিফাত ও মারিয়া মেহরিন যৌথভাবে এই গবেষণাটি পরিচালনা করেন। বুয়েটের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ড. শাকিল আকতারের তত্ত্বাবধানে গত বছরের মার্চ থেকে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত সময়ে এটি পরিচালনা করা হয়।

পরিকল্পনাবিদ ইনজামামউল হক রিফাত বলেন, বিগত ৩২ বছরে বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সাত জেলার হাওড় অঞ্চলের শুষ্ক মৌসুমের জলাভূমির পরিমাণ কমেছে শতকরা ৮০ ভাগেরও বেশি। ফলে হাওড় এলাকায় মৌসুমি বৃষ্টিপাত ও পাহাড়ি ঢলের ?কারণে সৃষ্ট পানি ধারণ করার প্রাকৃতিক ক্ষমতা মারাত্মকভাবে কমে গেছে। এ কারণে বন্যা-দুর্যোগ এই এলাকায় নিয়মিতভাবে দেখা যাচ্ছে। ওই এলাকার জলাভূমির আশঙ্কাজনক পরিবর্তন এখনই রোধ না করা গেলে পরিবেশ বিপর্যয়ের পাশাপাশি ভবিষ্যতে আরও ভয়ানক বন্যার আশঙ্কা থাকবে।

আইসিডির পরিচালক পরিকল্পনাবিদ আরিফুল ইসলাম বলেন, হাওড় এবং ওই অঞ্চলের নদনদী ভরাট হয়ে যাওয়ার ঘটনা এবারের এই বন্যার আরেক কারণ। জলাভূমি না থাকায় পানি নদনদী আর হাওড়ে জমছে। পাহাড়ে বৃক্ষনিধনের কারণে আগের চেয়ে বেশি আসছে পলি। ফলে নদীর নাব্যতা ও নদী-জলাশয়ের পানি ধারণক্ষমতা কমে গেছে।

বুয়েটের অধ্যাপক একেএম সাইফুল ইসলাম বলেন, বন্যা থেকে মুক্তি পেতে হলে হাওড় এলাকার খালবিল, নদীনালার প্রাকৃতিক পানিপ্রবাহ ও পানির ধারণক্ষমতা বাড়াতে হবে। এ লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় গবেষণা শেষে ভৈরব বাজারের উজানের সব নদী ড্রেজিং করতে হবে। এটা সম্ভব হলে কেবল বন্যার ভয়াবহতা থেকে মুক্তিই শুধু নয়, জীবন-জীবিকা ও প্রাণ-প্রকৃতি রক্ষা পাবে।

Scroll to Top