বিজয়ের ৫০ বছরে বাংলাদেশ উন্নয়ন-অর্জনে বিশ্বের বিস্ময়

তলাবিহীন ঝুড়ির অপবাদকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে বিশ্ব পরিমণ্ডলে বাংলাদেশ এখন অনেক দেশের জন্যই অর্থনৈতিক উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে জায়গা করে নিয়েছে। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পূর্তিতে স্বনির্ভর আর স্বাবলম্বী বাংলাদেশ এক অনন্য অর্জন। স্বাধীনতার পর যে জাতি লজ্জা নিবারণ আর শীতের কাঁপুনি থামাতে বিদেশ থেকে আসা খয়রাতি কম্বল মুড়ি দিয়েছিল, সে জাতিই আজ পুরো উন্নত বিশ্বের জন্য প্রস্তুত করছে নামিদামি ব্র্যান্ডের কাপড়। অর্জন করছে মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা। যার ফলে প্রহর গুনছে রপ্তানি আয় ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৫০০০ কোটি ডলারের রেকর্ড ছোঁয়ার। জাতিসংঘ ও বিশ্বব্যাংকের মানদণ্ড অনুযায়ী স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বেরিয়ে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে প্রবেশ করছে বাংলাদেশ। উন্নয়ন সহযোগী বিশ্বব্যাংক, আইএমএফের মতে অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা আর অর্থনৈতিক ঝুঁকি মোকাবিলার সূচকেও অনন্য অর্জন রয়েছে বাংলাদেশের। অর্থনৈতিক ও সামাজিক অনেক সূচকে ভারত, পাকিস্তান, ভিয়েতনামসহ পৃথিবীর বহু দেশকে পেছনে ফেলেছে বাংলাদেশ।

শুধু তাই নয়, এক সময় বৈদেশিক সহায়তা ছাড়া চলতে না পারা বাংলাদেশ এখন নিজস্ব অর্থায়নেই বাস্তবায়ন করছে পদ্মা সেতুর মতো বৃহৎ প্রকল্প। এ ছাড়া মেট্রোরেল, পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, মাতারবাড়ী বিদ্যুৎ কেন্দ্র, এক্সপ্রেসওয়ের মতো মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নেও বাংলাদেশ প্রমাণ করছে তার সক্ষমতা। এক সময়ের ক্ষুধা, দরিদ্রতম জাতির দুর্নাম ঘুচিয়ে বাংলাদেশ খাদ্যেও স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। ফলে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে বাংলাদেশের প্রাপ্তির শেষ নেই। এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য এবং বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) এর সাবেক চেয়ারম্যান ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. এ কে আজাদ চৌধুরী বলেন, স্বাধীনতার পর তলাবিহীন ঝুড়ির বাংলাদেশ থেকে আজ উন্নয়ন-অর্জনে যে সাফল্য দেখিয়েছে তা প্রশংসার দাবিদার। বাংলাদেশ যেভাবে এগিয়েছে তার নজির বিশ্বে অন্য দেশে নেই বললেই চলে। দেশের জনসংখ্যাও বেশি, প্রত্যাশাও অনেক। সরকারকে জনগণের প্রত্যাশা পূরণে আরও সতর্ক হয়ে কাজ করতে হবে। তিনি বলেন, দেশের অর্থনীতি, সামাজিক, শিক্ষা, নারীর ক্ষমতায়ন, স্বাস্থ্যসেবা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় সক্ষমতা অর্জন বিরল ঘটনা। ছোট একটি দেশ, বিশাল জনসংখ্যার বাসস্থান, খাদ্যের জোগান দেওয়া সহজ কথা নয়। বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার যোগ্য নেতৃত্বে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। দেশকে আরও এগিয়ে নিতে তাঁর হাতকে শক্তিশালী করতে দেশবাসীকে শপথ নিতে হবে। এদিকে মহান বিজয় দিবসের ৫০ বছরের মধ্যে স্বাধীনতা অর্জনে নেতৃত্বদানকারী আওয়ামী লীগ দেশ পরিচালনা করে সাড়ে একুশ বছর। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার মাত্র সাড়ে তিন বছর দেশ পরিচালনার সুযোগ পায়। জাতির পিতাকে হত্যার পরবর্তী দীর্ঘ একুশ বছর পর ১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকে পাঁচ বছর। মাঝে পাঁচ বছর বাদ দিয়ে ২০০৯ সালের নির্বাচনে ক্ষমতায় আসার পর এ পর্যন্ত অর্থাৎ গত এক যুগেরও বেশি সময় টানা ক্ষমতায় রয়েছে বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া প্রাচীন রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ।

অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ আজকে উন্নয়নের রোল মডেল। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর বছরেই গত ফেব্রুয়ারিতে জাতিসংঘের উচ্চতর কমিটি স্বল্পোন্নত দেশ বা এলডিসি শ্রেণি থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের চূড়ান্ত সুপারিশ করে। আর গত ২৪ নভেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ তা অনুমোদন করেছে। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গত এক যুগ অবকাঠামো উন্নয়নে বিশেষত বড় প্রকল্প বাস্তবায়নে সাফল্য দেখিয়েছে। নিজস্ব অর্থায়নে স্বপ্নের পদ্মা সেতু এখন উদ্বোধনের অপেক্ষায়। ঢাকাবাসী ইতিমধ্যে মেট্রোরেলের পরীক্ষামূলক চলাচল দেখেছে। আগামী বছর এই ট্রেন যাত্রী নিয়ে চলাচল করবে। কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মাণাধীন দেশের প্রথম টানেলও চালু হবে আগামী বছর। ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল নির্মাণের কাজ দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলছে। ইতিমধ্যে কয়েকটি অঞ্চলে উৎপাদন শুরু হয়েছে। উদ্বোধন করা হয়েছে পায়রা বন্দর সেতু। যা দক্ষিণাঞ্চলের যোগাযোগে নতুন দিগন্তের সূচনা হয়েছে।
১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে দেশের মাথাপিছু আয় ছিল মাত্র ৮৮ ডলার, যা ছিল বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বনিম্ন। সর্বশেষ হিসাবে মাথাপিছু আয় দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৫৫৪ ডলার। গত ১০ বছরে বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপি প্রবৃদ্ধি হয়েছে গড়ে ৬ শতাংশের বেশি। করোনা মহামারীর মধ্যেও গত অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৫ দশমিক ৪ শতাংশ। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে সবচেয়ে বেশি অবদান এই তৈরি পোশাক খাতেরই। মোট প্রবৃদ্ধির ৬-৮ শতাংশই আসছে পোশাক খাত থেকে। বাংলাদেশের এই শিল্পকে বর্তমানে উন্নত বিশ্বসহ উন্নয়নশীল দেশগুলো অনুকরণ করছে। বিশ্বের দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির দেশের তালিকায় বাংলাদেশ এখন পঞ্চম। স্বাধীনতার পর গত পাঁচ দশক ধরে দেশে নীরবে বেসরকারি খাতে শিল্প বিপ্লব ঘটে চলেছে। এ দেশের মানুষের সবচেয়ে বড় সম্পদ হলো শ্রমশক্তি। যার ফলে দেশের কর্মক্ষম সাড়ে ৮ কোটি মানুষের অন্তত ৮০-৮৫ শতাংশেরই জীবিকা জড়িত বেসরকারি খাতের সঙ্গে। স্বাধীনতার ৫০ বছরে কৃষিনির্ভর থেকে বেরিয়ে শিল্প নির্ভরতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। চট্টগ্রামের মিরসরাইতে বঙ্গবন্ধু শিল্প সিটি গড়ে তোলা হচ্ছে। যেখানে অন্তত ২০টি দেশের বিনিয়োগ আসছে। চীন, জাপানসহ আরও কয়েকটি দেশের কারখানায় ইতিমধ্যে উৎপাদন শুরু হয়েছে।

শুধু তাই নয়, গত ৫০ বছরে দেশে খাদ্যশস্যের উৎপাদন বেড়েছে বহুগুণ। ধান, গম ও ভুট্টার উৎপাদন বিশ্বের গড় উৎপাদনকে পেছনে ফেলে ক্রমেই এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশে। ফলে কৃষির অন্তত ৯টি ফসল উৎপাদনে শীর্ষ ১০ তালিকায় উঠে এসেছে দেশ। ১৯৭১ সালে দেশে যেখানে দানাদার খাদ্যশস্য উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ১ কোটি ১৮ লাখ টন, সেখানে ২০২১ সালে খাদ্যশস্য উৎপাদন হয়েছে সোয়া ৪ কোটি টন। ফলে চাল উৎপাদনে বাংলাদেশ ভিয়েতনামকে পেছনে ফেলে উঠে এসেছে তৃতীয় স্থানে। মাছ ও সবজি উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান এখন তৃতীয়। ইলিশ উৎপাদনে প্রথম। সামগ্রিক খাদ্য উৎপাদনে বিশ্বের শীর্ষ ১১ দেশের একটি বাংলাদেশ।

বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু ৭২.৩ বছর, ভারতে ৬৯.৪ এবং পাকিস্তানে ৬৭.১ বছর। শিক্ষার হারের দিক থেকে ভারত থেকে সামান্য পিছিয়ে বাংলাদেশ। মানবসম্পদ উন্নয়নসহ আরও অনেক সূচকে ভারত-পাকিস্তানের তুলনায় এগিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ। ২০২০ সালে বাংলাদেশে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের মধ্যে প্রতি হাজারে ৩১ জনের মৃত্যু হয়েছে। ১৯৯০ সালে এ সংখ্যা ছিল ১৪৪ জন। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের ভর্তির হারের ক্ষেত্রেও অনেক উন্নতি হয়েছে। মাধ্যমিক পর্যায়ের বয়স বিবেচনায় শিশুদের ৭৩ ভাগ এখন স্কুলে যাচ্ছে। ১৯৭৩-৭৪ সালে দেশে দারিদ্র্যের হার ছিল ৮২ শতাংশ। ২০১৯ সালে দারিদ্র্যের হার নেমে এসেছে ২০ দশমিক ৫ শতাংশে। স্বাধীনতার পর ২০০৯ সাল পর্যন্ত চার দশকে বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা বেড়েছে ৫ হাজার মেগাওয়াট। গত এক যুগে তা ২৫ হাজার মেগাওয়াট ছাড়িয়ে গেছে। বিদ্যুতের আলোয় আলোকিত প্রায় ৯৯.৯৯ ভাগ মানুষ।

নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ক্ষমতায় এসে নির্বাচনী ইশতেহার অনুযায়ী ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তোলার উদ্যোগ নেয় আওয়াম লীগ। দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে শুরু হয় বিশাল কর্মযজ্ঞ। সারা দেশে ৩৯টি হাইটেক পার্ক ও সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক স্থাপন করা হয়েছে। ডিজিটাল খাতে রপ্তানি এখন ১ বিলিয়ন বা ১০০ কোটি মার্কিন ডলার ছাড়িয়ে গেছে ২০১৮ সালেই। আগামী ২০২৫ সালের মধ্যে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি খাতে রপ্তানি আয় ৫ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করার লক্ষ্যে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ ড. আতিউর রহমান বলেন, স্বাধীনতার ৫০ বছরে বাংলাদেশ যে হারে এগিয়েছে সেটা সত্যিই অনেকের জন্যই ঈর্ষণীয়। অর্থনীতির অনেক ক্ষেত্রেই আমরা দারুণ সাফল্য অর্জন করেছি। পৃথিবীর অনেক দেশই আমাদের অনুসরণ করছে। তিনি আরও বলেন, করোনা মহামারীতেও বাংলাদেশ তার সক্ষমতার পরিচয় দিয়েছে। মহামারীতে বিশ্বের অনেক উন্নত দেশ যেখানে ধরাশায়ী সেখানে এই মহামারীতেও আমরা উচ্চতর প্রবৃদ্ধি ধরে রেখেছি। সবচেয়ে বড় কথা দেশে কোনো খাদ্য সংকট নেই। এ ছাড়া নেই বড় কোনো অর্থনৈতিক সংকটও। তিনি আরও বলেন, এখন আমরা বাংলাদেশকে নিয়ে গর্ব করে বলতে পারি সেই তলাবিহীন ঝুড়ি আজ বিশে^র বিস্ময়, উন্নয়নের এক রোল মডেল। স্বাধীনতার সময়ে অর্থনীতির প্রতিটি সূচকে পাকিস্তান এগিয়ে ছিল। আজ ৫০ বছর পর পুরো চিত্রই উল্টো। এটিই আমাদের স্বাধীনতার বড় অর্জন। স্বাধীনতার ৫০ বছরে নারীর ক্ষমতায়নেও আমরা সাফল্য অর্জন করেছি। সবকিছুতেই নারীর অংশগ্রহণ চোখে পড়ার মতো। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, আগামী দিনের সম্ভাবনার অর্থনীতির নাম হবে ডিজিটাল অর্থনীতি। আমিও সেটাই বলি। আগামীতে আইসিটি খাত হবে দ্বিতীয় পোশাক খাত।

Scroll to Top