বাংলাদেশে সুগন্ধি জাতের ধানের চাষ বাড়ছে। দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিশ্বের ১৩৬ দেশে রপ্তানিও হচ্ছে। সাধারণত দেশে আমন মৌসুমে সুগন্ধি ধানের আবাদ হলেও বর্তমানে উচ্চ ফলনশীল সুগন্ধি ধান আউশ ও বোরো মৌসুমেও চাষ করা হচ্ছে। উৎসবপ্রিয় ও ভোজনরসিক বাঙালি সুপ্রাচীনকাল থেকে সুগন্ধি ধানের চাষ করে আসছে।
মূলত ঘরোয়া কোনো উৎসব, জামাই কিংবা আত্মীয়স্বজন আপ্যায়নে বাঙালির ঐতিহ্যের অংশ সুগন্ধি চালের তৈরি নানান মুখরোচক খাবার। কৃষক তাই জমির কোণে বা কোনো একটি অংশে চাষ করে আসছে সুগন্ধি সরু বা চিকন ধান। উৎপাদিত সুগন্ধি ধান কৃষক নিজের চাহিদামতো রেখে বাকিটুকু বিক্রি করে দিত। তবে সম্প্রতি সুগন্ধি চালের নানামুখী ব্যবহারে বেড়েছে এর চাহিদা। সেই লক্ষ্যে বাড়ছে উৎপাদনও।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এখন শুধু পারিবারিক প্রয়োজনে নয়, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সুগন্ধি ধানের চাষ হচ্ছে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে। কারণ সমান শ্রমে এই ধানচাষে লাভ বেশি। অন্য যে কোনো চালের তুলনায় সুগন্ধি চালের দাম অনেক বেশি। এক কেজি সাধারণ চালের দাম যেখানে ৪৫-৫০ টাকা, সেখানে এক কেজি সুগন্ধি চালের দাম ৮০-১২০ টাকা পর্যন্ত হয়। সুগন্ধির চালের তৈরি খাবার বাণিজ্যিকভাবে স্থান করে নিয়েছে হোটেল-রেস্তোরাঁর কোনো উৎসব কিংবা সেট মেন্যুতে।
আশার কথা হলো, বাংলাদেশে জিওগ্রাফিক্যাল আইডেন্টিফিকেশন (জি-আই) বা ভৌগোলিক নির্দেশক হিসেবে ৯টি পণ্য নিবন্ধিত হয়েছে। এর মধ্যে দিনাজপুরের কাটারিভোগ ও কালিজিরা চাল এই সনদপত্র পেয়েছে। এর ফলে কাটারিভোগ ও কালিজিরা চাল এখন বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশের প্রকৃতি, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের প্রতিনিধি।
ব্রির গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে এক সময় প্রায় ৫৭ ধরনের সুগন্ধি জাতের ধানের চাষ হতো। বর্তমানে কম-বেশি ৩২ ধরনের ধানের চাষ হচ্ছে। এগুলোর মধ্যে অতিসুগন্ধি জাতগুলো হলো- কালিজিরা, চিনিগুঁড়া, কাটারিভোগ, তুলসীমালা, বাদশাভোগ, খাসখানী, চিনি আতপ, বাঁশফুল, দূর্বাশাইল, বেগুনবিচি, কালপাখরী ইত্যাদি। হাল্কা সুগন্ধযুক্ত জাতগুলোর মধ্যে কৃষ্ণভোগ, গোবিন্দভোগ, পুনিয়া, কামিনী, জিরাভোগ, চিনিশাইল, সাদাগুঁড়া, মধুমাধব, দুধশাইল উল্লেখযোগ্য।
প্রচলিত এসব জাতের ফলন কম হওয়ায় অনেক কৃষকের সুগন্ধি ধানচাষের আগ্রহ কম ছিল। সেই জায়গায় উচ্চ ফলনশীল সুগন্ধি ধানের চাষে আগ্রহ বাড়ছে কৃষকদের মাঝে। দেশের উত্তরাঞ্চলে প্রধানত দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়, রংপুর, নওগাঁ, রাজশাহী জেলায় সুগন্ধি ধান উৎপাদিত হয়। এই অঞ্চলের স্থানীয় জাতের পাশাপাশি উচ্চ ফলনশীল সুগন্ধি ধানের চাষ করা হচ্ছে।
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা এ পর্যন্ত ১২টি সরু ও সুগন্ধি ধানের জাত উদ্ভাবন করেছেন। আমন মৌসুমে চাষ উপযোগী ব্রি উদ্ভাবিত ধানের জাতগুলো হলো বিআর-৫ (দুলাভোগ), ব্রি-ধান৩৪, ব্রি-ধান৩৭, ব্রি-ধান৩৮, ব্রি-ধান৭০, ব্রি-ধান৭৫ ও ব্রি-ধান৮০, ব্রি-ধান৮১। অন্যদিকে বোরো মৌসুমে চাষযোগ্য সুগন্ধি ধান ব্রি-ধান৫০ বা ‘বাংলামতি’। বিঘাপ্রতি এর ফলন প্রায় ২০ মণ। এ চালের মান, স্বাদ ও গন্ধ বাসমতি চালের মতোই। এ ছাড়াও বাংলাদেশ পরমাণু গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিনাধান-৯ ও বিনাধান-১৩ এবং বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভাবিত বিইউ সুগন্ধি হাইব্রিড ধান-১ নামে তিনটি সুগন্ধি জাতের ধান রয়েছে।
ব্রি সূত্রে জানা যায়, ব্রি-ধান৩৪ চিনিগুঁড়া বা কালিজিরার মতোই অথচ ফলন প্রায় দ্বিগুণ। বাজারে যে চিনিগুঁড়া চাল পাওয়া যায় তার প্রায় ৮০ শতাংশই ব্রি-ধান৩৪ থেকে আসে। এ ছাড়াও ব্রি-ধান৭০ কাটারিভোগ টাইপ এবং বিঘাপ্রতি গড় ফলন প্রায় ১৭ মণ, যা কাটারিভোগের দ্বিগুণ এবং কাটারিভোগের চেয়ে চালও কিছুটা লম্বা। ব্রি-ধান৮০ থাইল্যান্ডের জনপ্রিয় জাত জেসমিন ধানের মতো সুগন্ধযুক্ত এবং খেতেও বেশ সুস্বাদু।
ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ড. মো. শাহজাহান কবীর বলেন, ব্রি থেকে এখন পর্যন্ত ১২টি সুগন্ধি জাতের ধান অবমুক্ত করা হয়েছে। এই জাতগুলো দুই ধরনের। একটি হলো পোলাও খাবারের জন্য, অন্যটি ভাতের জন্য। প্রচলিত জাতের চেয়ে আমাদের উদ্ভাবিত জাতগুলোর ফলন প্রায় দুই থেকে তিনগুণেরও বেশি। তিনি জানান, খুব শিগগিরই আমাদের আরও একটি নতুন জাতের সুগন্ধি ধান অবমুক্ত করা হবে। এই জাত ভারত ও পাকিস্তানের বাসমতি চালের মতোই, কিন্তু এই জাতের সুগন্ধ অনেক বেশি হবে। নতুন এই জাতের নাম হতে পাবে ব্রি-ধান১০১ কিংবা ব্রি-ধান১০২। একরপ্রতি ফলন হবে ৭ টনের মতো।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সরেজমিন উইং সূত্রে জানা যায়, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৩৪০৫৮০ হেক্টর জমিতে ৭৬৬৩০৫ মেট্রিক টন, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৬৫৮৪২০ হেক্টর জমিতে ১৫৮৬৭৯২ মেট্রিক টন, ২০২০-২১ অর্থবছরে ৭২৪৫৬১ হেক্টর জমিতে ১৭৭৫১৭৮ মেট্রিক টন সুগন্ধি চাল উৎপাদন হয়। এ ছাড়াও প্রতিবছর সুগন্ধি ধানের আবাদ ও উৎপাদন বাড়ছে।
উইংটি আরও জানায়, বিগত বছরে সুগন্ধি চাল আমদানি করা হয়নি বরং ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৫৮০৫.৪০৯ মেট্রিক টন, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ১০৮৭৯.৫২৯ মেট্রিক টন, ২০২০-২১ অর্থবছরের মার্চ পর্যন্ত ৬৫৪৯.০০৯ মেট্রিক টন সুগন্ধি চাল বিদেশে রপ্তানি করা হয়েছে। আরও জানা যায়, চলতি ২০২১-২২ রোপা আমন মৌসুমে কৃষি প্রণোদনা কার্যক্রমের আওতায় ব্রি-ধান৩৪ জাতের ১০০ মেট্রিক টন বীজ ২০ হাজার কৃষকের মাঝে বিতরণ করা হয়েছে। সুগন্ধি চালের মূল্য বেশি থাকায় কৃষক এই ধানচাষে আগ্রহী হচ্ছে। ফলে সুগন্ধি চালের উৎপাদন বাড়ছে। সার্বিক বিষয় বিবেচনা করে বিশ হাজার মেট্রিক টন পর্যন্ত সুগন্ধি চাল রপ্তানি করার অনুমতি দেওয়া যেতে পারে বলে জানান এই উইংটি।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. আসাদুল্লাহ বলেন, আমরা ব্রি-ধান৩৪ জাতের প্রদর্শনী থেকে শুরু করে বীজ উৎপাদন এবং সংগ্রহ করার কাজ করছি। বিশেষ করে দিনাজপুর অঞ্চলে এর চাষ সম্প্রসারণে কাজ চলমান। এটি লাভজনক ও দাম দ্বিগুণ। ফলনও ভালো এবং সুগন্ধি যেন বেশি হয় সে বিষয়টির ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছি। জাতটি সম্প্রসারণে কৃষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের প্রণোদনাও দিচ্ছি।
রপ্তানিসংশ্লিষ্ট কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের তথ্য বলছে, ১০ বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে সুগন্ধি চালের রপ্তানি বেড়েছে। বাংলাদেশের কিছু বেসরকারি প্রতিষ্ঠান প্যাকেটজাত সুগন্ধি চাল ইউরোপ, আমেরিকা, যুক্তরাজ্য, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ব্রুনাই, দক্ষিণ কোরিয়াসহ বিশ্বের ১৩৬ দেশে রপ্তানি করছে। এসব সংস্থার মাধ্যমে প্রতিবছর রপ্তানিকৃত সুগন্ধি চালের পরিমাণ প্রায় ১০-১৫ হাজার টন। ২০০৯-১০ অর্থবছরে যা ছিল মাত্র ৬৬৩ টন। এ ছাড়াও বিভিন্ন দেশে কর্মরত প্রায় ১ কোটি প্রবাসী বাংলাদেশিদের মাধ্যমে আরও প্রায় ৫-১০ হাজার টন সুগন্ধি চাল বিদেশে যায়।