ভারতের উত্তরপ্রদেশে ধর্মান্ধতা যেমন প্রচন্ড, নারীবিদ্বেষও তেমন প্রচন্ড। নেহা পাসোয়ান জন্মেছিল ওই রাজ্যের দেওরিয়া গ্রামে। তার বয়স ছিল সতেরো। সে ছিল নবম শ্রেণির ছাত্রী। নেহাকে পিটিয়ে মেরে ফেলেছে কোনও ডাকাত নয়, কোনও ধর্ষক নয়, কোনও ভাড়াটে খুনি নয়, মেরে ফেলেছে নেহারই ঘরের লোকেরা, নেহারই আপন ঠাকুরদা, নেহারই আপন কাকা। মেরে ফেলার কারণ নেহা জিন্স পরেছিল।
এক ধরনের মোটা সুতি কাপড়ই জিন্স নামে পরিচিত। সারা পৃথিবীর মানুষই, নারী পুরুষ উভয়ে, এ কাপড়টি দিয়ে তৈরী প্যান্ট, শার্ট, জ্যাকেট ইত্যাদি পরে। এই কাপড়টি সস্তা বলে গরিবরাও কিনে পরতে পারে। এক সময় এটি শ্রমিকদেরই পোশাক ছিল। এটি মোটা বলে টেকে অনেক দিন, এটি সুতি বলে পরতেও আরাম। শীত গ্রীষ্ম সব ঋতুতেই জিন্স চলে। কিন্তু নেহা পাসোয়ানের ঠাকুরদা আর কাকা কেন নেহার জিন্স পরা সহ্য করতে পারেনি? কারণ তারা ভেবে নিয়েছে জিন্স পুরুষের পোশাক। তারা বিশ্বাস করে পুরুষের পোশাক মেয়েদের পরা উচিত নয়। মেয়েরা, তাদের ভয়, পুরুষের পোশাক পরলে, পুরুষের মতো আচরণ শুরু করবে। নেহার ঠাকুরদা আর কাকা নিশ্চয়ই ভেবেছিল নেহা এখন কারও আদেশ শুনবে না, বাইরে বেরোবে, চা সিগারেট খাবে, নেশা করবে, ঘরে ফিরে চিৎকার চেঁচামেচি করবে। তারা চায় নেহা ইস্কুলে যাবে, ইস্কুল থেকে ফিরে মা’র সঙ্গে রান্না করবে, ঘর দোর পরিষ্কার করবে, সবাইকে বেড়ে খাওয়াবে, সবার যত্ন করবে, পুজো আচ্চা করবে, বাড়ি থেকে বেরোবে না, কোথাও আড্ডা দেবে না। নেহা তা-ই করছিল। একটা শান্ত শিষ্ট মেয়ে, যেভাবে পরিবার চায়, সেভাবেই সে তার জীবনযাপন করছিল। কিন্তু সব কিছু উল্টে পাল্টে দিয়েছে তার জিন্স। সে উদ্ধত নয়, কিন্তু জিন্স পরেছে বলে তাকে উদ্ধত বলে ভাবা হয়েছে। নেহা বাড়ির সবার সব আদেশই মেনেছে, শুধু জিন্স পরা যাবে না, এই আদেশটি মানেনি। কারণ তার অনেক দিনের শখ সে একদিন জিন্স পরবে। সেই একদিনটি এলে নেহা তো খুশি হবেই। কিন্তু নেহার খুশি সহ্য হয়নি পরিবারের লোকদের।
এই নেহাকে তার ঠাকুরদা আর কাকা উঠোনে ফেলে মেরেছে। বাবা বাড়িতে ছিল না, ছিল পাঞ্জাবে, কাজে। বাবা থাকলে ঠাকুরদা আর কাকার হাত থেকে নেহাকে বাঁচাতো নাকি সেও ঠাকুরদা আর কাকার সঙ্গে মিলে নেহাকে মারতো তা আমরা জানি না। আমরা অনুমান করছি বাবা থাকলে হয়তো বাবা বাঁচাতো। মা শুধু অসহায় চোখে বর্বরতা দেখেছে, বাঁচাতে পারেনি।
নেহাকে পিটিয়ে, এক সময় মাথা ফাটিয়ে, মেরে, গন্ডক নদীতে গিয়েছিল ফেলে দিতে। নেহার নিথর শরীর নদীতেই ভেসে যেত। কিন্তু মুশকিল হলো পাটানুয়া ব্রিজ থেকে ছুড়ে দেওয়ার পর নেহার মৃত শরীর ব্রিজের রেলিং-এ আটকে রইলো, জলে পড়লো না। রেলিংএ আটকে পড়া কিশোরীর শরীর দেখে কৌতূহল জন্মেছে পথচারীদের। এ কারণেই এটি খবর হয়েছে। তা না হলে খবর ভেসে যেত খরস্রোতা গন্ডকের জলে।
জিন্স পরা যাবে না, পুরুষের মতো শার্ট পরা যাবে না, চুল ছোট করা যাবে না, জুতো পরা যাবে না। পুরুষের মতো হাঁটাচলা, কথা বলা, চেঁচানো, অট্টহাসি, গালিগালাজ কিছুই করা যাবে না। মেয়েদের থাকতে হবে মাথা নিচু করে, মুখ বন্ধ করে, ভোগের বস্তু হয়ে। ভোগের বস্তুগুলোকে মেয়েলিভাবে সাজতে হবে, মেয়েলি পোশাক পরতে হবে, মেয়েলি ঢং-এ কথা বলতে হবে, মেয়েলি পরিশ্রমে ঘর সংসারের সমস্ত কাজ সম্পূর্ণ করে পুরুষের শরীর এবং মনকে আরাম দিতে হবে।
নেহাকে ইস্কুলে পাঠানো হতো, যেন কিছুটা লেখাপড়া শিখে এটা সেটা পড়তে পারে, বাচ্চাদের পড়াতে পারে, স্বামীর মনোরঞ্জন করতে পারে। এখনও না হয় গ্রামগঞ্জের অধিকাংশ মানুষের এমনই মানসিকতা। এক সময় কিন্তু শহরেও ছিল এমন মানসিকতার জয় জয়কার। শুধু এ দেশ বলি কেন, বিশ্বজুড়ে ছিল একই মানসিকতা। ধীরে ধীরে এই মানসিকতার পরিবর্তন হয়েছে, মেয়েরা একটু একটু করে প্রাপ্য অধিকার পেয়েছে। তারা জিন্স পরে, পুরুষের মতো শার্ট পরে, শর্টস পরে, পুরুষের মতো জুতো মোজা পরে। কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে যায়, জব করে, টাকা পয়সা রোজগার করে, নিজের পায়ে দাঁড়ায়। তারপরও মেয়েদের প্রাপ্য অধিকার সবটা পাওয়া হয়নি। হয়নি বলেই বিশ্বজুড়ে আজও মেয়েরা যৌন হয়রানি, ধর্ষণ, নির্যাতন আর খুনের শিকার। আজও ঘর এবং বাহির, কোনও স্থানই মেয়েদের জন্য নিরাপদ নয়।
কিছু কিছু শহরকে মেয়েদের জন্য নিরাপদ বানানোর উদ্যোগ নিয়েছে রাষ্ট্রপুঞ্জ বা জাতিসঙ্ঘ। কিন্তু আদৌ কি সফল হবে এই উদ্যোগ! আমার সংশয় হয়। রাস্তাঘাট ঘর বাড়ি তো নিজে থেকে অনিরাপদ হয়ে ওঠে না, মানুষ এগুলোকে অনিরাপদ করে। মানুষকে শিশুকাল থেকে পুরুষতান্ত্রিক শিক্ষা দিয়ে বড় করার পর ‘নারীকে অত্যাচার করো না, নারীও মানুষ, নারীকে যৌন হেনস্তা করো না, নারীর অধিকার মানে মানবাধিকার’-এসব উপদেশ ধোপে টেকে না। এজন্য বলি নতুন করে নারীকে হেনস্তা না করার, ধর্ষণ না করার, খুন না করার উপদেশ দেওয়ার দরকার নেই, পুরুষতন্ত্রটা মগজে না ঢোকালেই নারীর অধিকার সম্পর্কে কোনও কিছু শেখার দরকার পড়ে না। কিন্তু পুরুষতান্ত্রিক সমাজে জন্ম নেওয়া শিশুর মস্তিষ্কে পুরুষতন্ত্রই তো ঢুকে যায় সুড়সুড় করে। যা তারা দেখে, শোনে, …তা-ই তারা শেখে। তারা শিখে যায় পুরুষ প্রভু, নারী দাসী। নারী শিক্ষিত হোক, অশিক্ষিত হোক, ধনী হোক, দরিদ্র হোক, সুন্দরী হোক, অসুন্দরী হোক-সে পুরুষের দাসী। ধনদৌলত শিক্ষা সৌন্দর্য তাকে এক ধরনের নিরাপত্তা দেয় বটে, কিন্তু সে যখন সভ্য লোক দ্বারা বেষ্টিত। কিন্তু কোনও নির্জন রাস্তায় ধনী, শিক্ষিত সুন্দরীও দরিদ্র, অশিক্ষিত, অসুন্দর পুরুষ দ্বারাও নির্যাতিত হতে পারে। এর অর্থ সব রকম নারীরই সভ্য পুরুষ ছাড়া বাকি সব রকম পুরুষ দ্বারা ঘরে বাইরে নির্যাতিত হওয়ার আশঙ্কা একশ’ভাগ।
এ কারণেই সভ্য হওয়া জরুরি। সভ্যতার প্রথম শর্ত নারী পুরুষের সমানাধিকারকে বিশ্বাস করা এবং জীবনে তা চর্চা করা। নারী নির্যাতন দেখার পরও মুখ বুজে থাকা সভ্য লোকের কাজ নয়। প্রতিবাদ করতে হবে সবখানে। মানুষকে সচেতন করতে হবে সবখানে। শহর ছেয়ে যাক নারীবিরোধীদের বিরুদ্ধে পোস্টারে, গ্রাফিতিতে। রাস্তা ভরে উঠুক চকের লাল নীল লেখায়, আঁকায়। গ্রামগঞ্জ ছেয়ে যাক নারীর অধিকার বিষয়ক ব্যানারে, যাত্রা থিয়েটারে, নাচ গানে। সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে নারীর নিরাপত্তার জন্য। শুধু অপরাধীকে শাস্তি দিলেই অপরাধ বন্ধ করা যায় না। কত খুনি ধর্ষকের ফাঁসি হলো, যাবজ্জীবন হলো, তাতে কি অপরাধ কিছু কমেছে? মোটেই কমেনি। বরং দিন দিন বাড়ছে নারীবিরোধীদের কুকীর্তি। নারীরা বোরখায় ঢুকে গেছে, হিজাব দিয়ে নিজের শরীরকে আড়াল করেছে, নারীরা ঘুংঘটে আবৃত করেছে, ঘোমটায় মুখ ঢেকেছে, তারপরও তো যৌন হেনস্তা কিছু কমেনি। পুরুষ যৌন হেনস্তা করে মেয়েদের শরীর উন্মুক্ত বলে নয়, পুরুষ যৌন হেনস্তা করে কারণ পুরুষের মস্তিষ্ক পুরুষতন্ত্র আর নারীবিদ্বেষে ভরপুর। সভ্য হতে চাইলে, এ পুরুষের দায়িত্ব, মস্তিষ্ক থেকে পুরুষতন্ত্র এবং নারীবিদ্বেষ নিঃশেষ করা।
আমি চট্টগ্রামের এক মেয়েকে চিনি। সে সব সময় পুরুষের পোশাকের মতো পোশাক পরে। জুতোও পুরুষের। তার চুলও পুরুষের চুলের মতো। তাকে কিশোরী বলে কেউ মনে করে না। মনে করে কিশোর। সে দিব্যি একা রাস্তায় হাঁটে। হাটবাজার করে। এভাবেই সে মনে করে সে নিরাপদ। নিজের নিরাপত্তার জন্য সে পুরুষের সাজ পোশাককে বেছে নিয়েছে। কিন্তু সব মেয়ে এভাবে নিজেকে নিরাপত্তা দিতে চাইবে কেন? কেউ শাড়ি পরবে, কেউ সালোয়ার-কামিজ, কেউ মেয়ে হিসেবেই পরবে শার্ট-প্যান্ট, শর্টস, কেউ ঘাগড়া চোলি, কেউ যা ইচ্ছে তাই। কিন্তু সে কারণে তাকে হেনস্তা হতে হবে কেন? পোশাক আসলে একটা উপলক্ষ, নারী হওয়ার কারণেই পুরুষেরা নারীকে নির্যাতন করে।
যারা নেহা পাসোয়ানকে পিটিয়ে মেরেছে, তারা নেহা মেয়ে বলেই মেরেছে। মেয়ে হয়ে জন্ম নিলে তারা বিশ্বাস করে পুরুষের অধিকারের মতো অধিকার থাকতে নেই। তাই মেয়েরা তাদের প্রাপ্য অধিকার প্রতিষ্ঠিত করতে চাইলেই রুখে ওঠে পুরুষতন্ত্র। নেহার ঠাকুরদা আর কাকার মতো নারীবিদ্বেষী লোকে গিজগিজ করছে আমাদের জনপদ, আমাদের সমাজ আর ঘর বাড়ি। মনে রাখতে হবে সম্মিলিত প্রতিবাদ ছাড়া এসব বিষাক্ত পুরুষের বিষদাঁত উপড়ে নেওয়া সম্ভব নয়।