\”বৃষ্টির দিনে বাবার সঙ্গে বারান্দায় বসে বৃষ্টি উপভোগ করতাম। কত বিষয় যে জানার কৌতূহল ছিল! কত শত প্রশ্ন যে জাগত মনে! বাবার কাছে অনেক বিষয়ে জানতে চাইতাম। বাবা আমাকে বুঝিয়ে বলতেন। আমার সব আবদার ছিল বাবার কাছে।’ স্মৃতি হাতড়ে বলে চলে আনিশা ইসলাম। ‘বাবা কাছে নেই দুই বছর হলো। এর মধ্যে কতবার বৃষ্টি হয়েছে! কিন্তু আমি আর বারান্দায় যাই না। আমার শুধু কান্না পায় বাবার স্মৃতি মনে পড়ে গেলে। ঈদের দিন আরও বেশি কান্না পায়।\”- কথাগুলো বলতে বলতে আনিশা নামক নবম শ্রেণির এ শিক্ষার্থীর কণ্ঠে কান্না জড়িয়ে যায়।
আনিশার ব্যবসায়ী বাবার নাম ইসমাইল হোসেন। মিরপুরের এই ব্যবসায়ীকে ২০১৯ সালের ১৯ জুন র্যাব পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। এর পর থেকে তার আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। ছোট ভাই এনামকে নিয়ে বাবার সন্ধান দাবিতে জাতীয় প্রেসক্লাবে মা নাসরিন জাহানের সঙ্গে এসেছে আনিশা। বাবার জন্য অপেক্ষারত এনাম-আনিশারা বড় হচ্ছে, বড় হচ্ছে তাদের অপেক্ষার প্রহরগুলোও।
গুম হওয়া ব্যক্তিদের স্মরণে আয়োজিত মানববন্ধনে আনিশার মতো প্রিয়জনহারা এমন অনেক স্বজন হাজির হন গতকাল সকাল ১০টায় রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাবে। গুম হয়ে যাওয়া ব্যক্তিদের স্মরণে আন্তর্জাতিক সপ্তাহ উপলক্ষে এদিন মানববন্ধনের আয়োজন করে গুম হওয়া ব্যক্তিদের পরিবারগুলোর সমন্বয়ে গড়ে ওঠা সংগঠন ‘মায়ের ডাক’। অনুষ্ঠানে গুম হওয়া ২৫টি পরিবারের স্বজনদের
প্রতিবাদ, হাহাকার, কান্না, ক্ষোভে ভারী হয়ে ওঠে প্রেসক্লাবের পরিবেশ। ছোট্ট শিশু থেকে শুরু করে বৃদ্ধ-বৃদ্ধার হাতে নয়তো গলায় ঝুলে আছে গুম হয়ে যাওয়া বাবা বা ভাই কিংবা সন্তান নতুবা এমনই প্রিয় মানুষের ছবি। নিখোঁজ সেই প্রিয়জন একদিন ফিরে আসবে, এমন অপেক্ষায় পেরিয়ে যাচ্ছে তাদের অসংখ্য প্রহর। দিন যায়, অপেক্ষার প্রহর বাড়ে। কিন্তু ফিরে আসে না প্রিয় মানুষটি।
২০১৩ সালে গুম হওয়া পারভেজ হোসেনের স্ত্রী ফারজানা আক্তার মানববন্ধনে উপস্থিত ছিলেন। সঙ্গে মেয়ে রীতি (৯) ও ছেলে আরাফ (৭)। পারভেজ হোসেন বংশাল থানা ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ডিবি পরিচয়ে তাকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। ফারজানা আক্তার জানান, পারভেজ হোসেন গুম হওয়ার সময় রীতির বয়স ছিল মাত্র দুই বছর। আর ছেলে আরাফ তখন মায়ের গর্ভে। আরাফ জন্ম নিয়ে বাবাকে দেখেনি; ডাকতে পারেনি ‘বাবা’ বলে।
দুই বছরের রীতির বয়স এখন নয় বছর। মানববন্ধনে বসে ছিল বাবার ছবি হাতে নিয়ে। রীতি বলেন, \”আমার বাবাকে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে অনুরোধ করছি।\”
মানববন্ধনে অংশ নেন বিএনপির ‘নিখোঁজ’ নেতা এম ইলিয়াস আলীর ছেলে আবরার ইলিয়াস। তিনি অভিযোগ করেন, ২০১২ সালের ১৭ এপ্রিল তার বাবাকে তুলে নেওয়া হয়। সে সময় দুই সপ্তাহের ব্যবধানে সিলেট থেকে বিএনপির চার নেতা একইভাবে নিখোঁজ হন। ওই সময় সিলেটে টিপাইমুখ বাঁধবিরোধী আন্দোলন গড়ে উঠেছিল। দেশের স্বার্থে তার বাবা ওই আন্দোলনের সামনের সারিতে ছিলেন। এ অবস্থানের কারণেই তার বাবাকে গুম করা হয়েছে বলে অভিযোগ করে তিনি জানান, এখনো বাবার ফিরে আসার অপেক্ষার রয়েছেন।
মানববন্ধনে অংশ নিয়ে নিখোঁজ ভাইয়ের সন্ধান দাবি করেন ২৫ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সভাপতি সাজেদুল ইসলাম সুমনের বোন মারুফা ইসলাম। মারুফা ইসলাম বলেন, আমার ভাইকে ফিরে পেতে সরকারের সর্বস্তরে গিয়েছি। অনেক অনুনয় বিনয় করেছি। এখন আর অনুনয় করছি না। আমার ভাইকে ফেরত দিতেই হবে। তাকে ফিরে পাওয়া আমাদের অধিকার।
২০১৩ সালের ১১ নভেম্বর রাজধানীর মিরপুর এলাকার এক আত্মীয়র বাসা থেকে সেলিম রেজা পিন্টুকে তুলে নিয়ে যান অস্ত্রধারীরা। এ সময় তারা নিজেদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য পরিচয় দিয়ে কালো কাচের একটি সিলভার রঙের মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে যান। নিখোঁজ সেলিম রেজা সূত্রাপুর থানা ছাত্রদলের তৎকালীন সভাপতি ছিলেন। নিখোঁজের পর থেকে সেলিমের সন্ধানে তার পরিবার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিটের কাছে ধরনা দিয়েও কোনো ফল পায়নি। এখন শুধু অপেক্ষাই পরিবারটির একমাত্র করণীয়।
এ ঘটনায় ২০১৫ সালে রাজধানীর পল্লবী থানায় মামলা করতে গেলে পুলিশ মামলা নেয়নি। পরে আদালতে মামলা করে পরিবার। আদালতের নির্দেশে পুলিশ ঘটনার তদন্ত করে সেলিম রেজাকে তুলে নিয়ে যাওয়ার প্রমাণ পায়। তবে এ ঘটনায় জড়িত কাউকে শনাক্ত করতে পারেনি পুলিশ। সেলিম রেজা পিন্টুর ভাই ইসলাম রেজা। তিনি বলেন, ‘সরকারের কাছে একটাই দাবি- আমার ভাইকে ফিরিয়ে দিন।’
মানববন্ধনে অংশ নিয়ে নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ‘কোনো মানুষ নিখোঁজ হলে বা হারিয়ে গেলে তাকে খুঁজে দেওয়ার দায়িত্ব সরকারের। কারণ, আমাদের জানমালের নিরাপত্তা দেবে সরকার। কিন্তু সেটা হচ্ছে না।’
আলোকচিত্রী শহিদুল আলম অভিযোগ করে বলেন, এখানে সম্প্রতি যারা গুম হয়েছেন, তারা সরকারের দ্বারাই হয়েছেন। ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নুরও ছিলেন মায়ের ডাকের মানববন্ধনে। গুম হওয়া ব্যক্তিদের অবিলম্বে সন্ধান দেওয়ার দাবি জানান তিনিও।
এদিকে করোনাকালেও থেমে নেই গুমের ঘটনা। গত বছর মহামারীর ক্রান্তিকালেও অন্তত ৬ জন গুমের শিকার হয়েছেন, বলছে মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য। আর চলতি বছরের পেরিয়ে আসা চার মাসে গুমের শিকার হন ৩ জন। তবে অধিকারের তথ্য আরও উদ্বেগজনক। এ মানবাধিকার সংগঠনটি জানাচ্ছে, গত চার মাসে ১১ জন গুম হয়েছেন।
ভুক্তভোগীদের বরাত দিয়ে আসক বলছে, ২০০৭ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ৬০৮ জন গুমের শিকার হয়েছেন। পরবর্তী সময়ে তাদের মধ্যে ৭৮ জনের লাশ উদ্ধার হয়েছে; ৮৯ জনকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে এবং ৫৭ জন ফেরত এসেছে। গুম হওয়া ব্যক্তিদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে ও পোশাকে কখনোবা সাদা পোশাকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে বলে স্বজনদের অভিযোগ।
মানবাধিকারকর্মী নূর খান লিটন এ বিষয়ে বলেন, করোনাকালেও আমরা দেখেছি, গুমের ঘটনা ঘটেছে। প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা শুনে সন্দেহের অবকাশ রয়েছে যে, এ ধরনের গুমের সঙ্গে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর এক ধরনের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। দেখা যায়, গুম হওয়া মানুষগুলো কোথায় বা তাদের কী হয়েছে- সেই তথ্য উদ্ধারে সরকার সব সময় তাচ্ছিল্য প্রদর্শন করছে, কার্যকর কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করছে না। আমরা সব সময় বলেছি, একটি স্বাধীন কমিশন গঠন করুন। তারা দেখুক, কী হয়েছিল, কারা ঘটিয়েছিল, কেন ঘটিয়েছিল, ভিকটিম জীবিত না মৃত এবং এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের করণীয় কী। দুঃখজনক বিষয় হলো, সরকারের পক্ষ থেকে নানা কল্পকাহিনি বলা হলেও আজ পর্যন্ত কমিশন গঠনের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধ হয়নি। তিনি বলেন, জাতিসংঘে গুমের বিষয়টি নিয়ে যারা কাজ করেন, তারা একাধিকবার বাংলাদেশে আসার চেষ্টা করেছেন। অনুমোদন পাননি।
নূর খান লিটন মনে করেন, এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রকে জবাবদিহিতার মধ্যে আনা উচিত। কারণ আজ যারা এমন ঘটনা ঘটাচ্ছেন, তাদের সন্তানদের পক্ষ থেকেও এক সসময় এমন দাবি উত্থাপন করা হতে পারে।’
প্রতিবছর মে মাসের শেষ সপ্তাহটি বিশ্বজুড়ে গুম হয়ে যাওয়া ব্যক্তিদের স্মরণে আন্তর্জাতিকভাবে পালন করা হয়। বাংলাদেশে গুমের প্রতিটি ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্তের পাশাপাশি ‘গুম হওয়া’ ব্যক্তিদের খুঁজে বের করে পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ৪টি মানবাধিকার সংগঠন। গুম হয়ে যাওয়া ব্যক্তিদের স্মরণে আন্তর্জাতিক সপ্তাহ উপলক্ষে এশিয়ান ফেডারেশন অ্যাগেইনস্ট ইনভলান্টারি ডিজঅ্যাপিয়ারেন্স (এএফএডি), ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন ফর হিউম্যান রাইটস (এফআইডিএইচ), অধিকার ও মায়ের ডাক এক যৌথ বিবৃতিতে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি এ আহ্বান জানিয়েছে। বিবৃতিতে বলা হয়, নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকারবিষয়ক আন্তর্জাতিক চুক্তি এবং নির্যাতনবিরোধী সনদে সই করেছে বাংলাদেশ। গুমের ঘটনাগুলো এসব চুক্তি ও সনদের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। তাই জোরপূর্বক গুমের ঘটনাগুলো আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন ও মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে বিবেচনার সুযোগ রয়েছে।