সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল ও জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক-উল হক শনিবার সকালে রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন। তাঁর বয়স হয়েছির ৮৫ বছর।
প্রায় এক সপ্তাহ ধরে আদ দ্বীন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ছিলেন তিনি। শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে কয়েকদিন আগে তাকে লাইফ সাপোর্টে নেয়া হয়।
সিনিয়র এই আইনজীবী পেশাগত জীবনে সবচেয়ে বেশি আলোচনায় আসেন ২০০৭ সালে, ওয়ান-ইলেভেন নামে পরিচিত রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর কারাবন্দী আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনা ও বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার পক্ষে আইনজীবী হিসেবে দায়িত্ব পালন করে।
এছাড়া বাংলাদেশে চিকিৎসা ক্ষেত্রে উন্নয়নের লক্ষ্যে বিভিন্ন হাসপাতালে বিপুল পরিমাণ অর্থ দান করেছিলেন তিনি, যে কারণে আদ দ্বীন হাসপাতালসহ কয়েকটি বেসরকারি হাসপাতালের পরিচালনা পর্ষদের সদস্য হিসেবে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি।
একই সাথে খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনার আইনজীবী
২০০৭ সালের পর তত্বাবধায়ক সরকারের আমলে বিএনপি নেতা খালেদা জিয়া ও আওয়ামী লীগ নেতা শেখ হাসিনাসহ বিএনপি ও আওয়ামী লীগের অনেক শীর্ষ নেতার বিরুদ্ধেই মামলা করা হয়।
সেসময় রফিকুল হক শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়া উভয়ের স্বপক্ষের আইনজীবী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিক বলেন, কোনো নির্দিষ্ট রাজনৈতিক পরিচয় না থাকার কারণেই দুই দলের নেত্রীর পক্ষে আইনজীবী হতে পেরেছিলেন তিনি।
\”বাংলাদেশের বাস্তবতায় যে কোনো সিনিয়র আইনজীবীর কোনো না কোনো রাজনৈতিক পরিচয় থাকে। যেই অল্প কয়েকজন সিনিয়র আইনজীবী রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন না, রফিকুল হক ছিলেন তাদের একজন।\”
\”সেসময়ের তত্বাবধায়ক সরকারের সময় তিনি দুই জনেরই (শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়া) আইনজীবী হয়েছিলেন, কারণ তাঁর রাজনৈতিক কোনো পরিচয় ছিল না। আর সেসময় রাজনৈতিক পরিচয় থাকা অনেক আইনজীবীই বিভিন্ন কারণে ওই দুইজনকে আইনি সহায়তা দেয়া থেকে বিরত ছিলেন।\”
শাহদীন মালিক বলেন, একজন সিনিয়র আইনজীবীর একটি নির্দিষ্ট দলের প্রতি সমর্থন থাকলে অন্য রাজনৈতিক মতাদর্শে বিশ্বাসী ব্যক্তিরা আইনি সমস্যা নিয়ে ঐ আইনজীবীর কাছে যাওয়া থেকে বিরত থাকে।
রফিক-উল হক সব ধরনের রাজনীতি থেকে নিজেকে আলাদা রাখার কারণেই সব দল ও মতবাদের মানুষের কাছে তার গ্রহণযোগ্যতা ছিল বলে মন্তব্য করেন শাহদীন মালিক।
\”সুপ্রিম কোর্ট বা বার অ্যাসোসিয়েশনের রাজনীতির সাথেও তিনি কখনো জড়িত হননি, ইচ্ছাকৃতভাবে দূরে থেকেছেন। ফলে যে কোনো রাজনৈতিক দলের লোকই আইনি সমস্যা নিয়ে তার দ্বারস্থ হতে পারতেন। তিনি কখনোই যেহেতু কোনো দল করেননি, তাই সব রাজনৈতিক দলের লোকই তার কাছে যেত এবং তার ওপর ভরসা তরে পারতো।\”
আইনজীবী হিসেবে জীবন
রফিকুল ইসলাম তার পেশাগত জীবনে সব ধরনের রাজনৈতিক চাপ উপেক্ষা করে আইনজীবী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন বলে মন্তব্য করেন সিনিয়র আইনজীবী আমীর-উল ইসলাম।
আমিরুল ইসলাম বলেন, \”এরশাদের সামরিক সরকারের আমলে অনেক মানুষের বিরুদ্ধে অন্যায়ভাবে রাজনৈতিক মামলা দেয়া হয়েছে। রাজনৈতিক চাপ উপেক্ষা করেও সেসময় অনেক মামলা লড়েছেন রফিকুল হক।\”
রফিকুল হক ১৯৮৯-৯০ সালে বাংলাদেশের অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
এছাড়া যে কোনো মামলায় আইনজীবী হিসেবে দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রেওে সবসময় তিনি নিজের সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা করতেন বলে মন্তব্য করেন শাহদীন মালিক।
\”তার বয়স ৮০ বছরের বেশি হওয়ার পরও আমরা দেখেছি যে, কোনো মামলায় তিনি ব্যাপক পড়ালেখা করে, প্রস্তুতি নিয়ে আসতেন। অভিজ্ঞ, সিনিয়র আইনজীবী হওয়ায় কোনো মামলার ক্ষেত্রে কম প্রস্তুতি নিয়ে আসতে দেখিনি তাকে।\”
চিকিৎসাসেবায় অবদান
রফিক-উল হক তার ব্যক্তিগত আয় থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ বাংলাদেশে চিকিৎসার উন্নয়নের জন্য দান করেছেন। শাহদীন মালিক বলেন, \”প্রতিষ্ঠিত আইনজীবী হিসেবে তার আয় ছিল অনেক। আর সেই হারেই তিনি দানও করতেন। আমাদের ধারণা, তিনি তার জীবনে কোটি টাকারও বেশি পরিমাণ অর্থ দান করে গেছেন। আর এই বিষয়ে তিনি খুব একটা কথাও বলতেন না।\”
আদ দ্বীন হাসপাতালের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করা ছাড়াও বেশ কয়েকটি হাসপাতাল তৈরির পেছনে তার বড় ভূমিকা রয়েছে।
বারডেম হাসপাতালের একটি বিশেষ বিভাগ তৈরিতে বড় অঙ্কের অনুদান দেয়ার পাশাপাশি নিজ উদ্যোগে ঢাকার বাইরে কয়েকটি সুবিধাবঞ্চিত এলাকায় হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেছেন তিনি।
এছাড়া ঢাকার আহসানিয়া মিশন ক্যান্সার হাসপাতালের জন্যও তিনি বিপুল পরিমাণ অর্থ দান করেছেন।