প্রত্যন্ত অঞ্চলের কৃষি ও শ্রমজীবী মানুষের কাছে থানা ও পুলিশ ছিল একটি আতঙ্কের নাম। এক সময় পুলিশের নাম শুনলেই মানুষের মনে ভীতির সঞ্চার হতো। সে হোক অপরাধী কিংবা নিরাপরাধ। থানা মানেই পুলিশের ধমক, মারপিট এবং হাজতবাস, আর এসব থেকে রক্ষা পেতে হলে দিতে হবে ঘুষ-এমন ধারণা ছিল সর্বমহলে।
এ কারণে গ্রামের মানুষ সামাজিক-পারিবারিক বিরোধগুলো স্থানীয়ভাবেই মীমাংসা করতেন। অনেক অন্যায়-অবিচার সহ্য করেও খেটে খাওয়া মানুষগুলো থানামুখো হতে চাইতেন না। এমনকি নারী নির্যাতন, ধর্ষণ, হত্যাচেষ্টাসহ ফৌজদারি অপরাধগুলোও গ্রামে বসেই মিটমাট করে ফেলতেন।
কিন্তু সময় বদলে গেছে। এখন পুলিশ দেখে নিরাপরাধ মানুষের মধ্যে ভীতি অনেকটাই কমে এসেছে। ‘পুলিশ জনগণের বন্ধু’-তাদের কার্যক্রমেই সেটা প্রমাণ হচ্ছে। তেমনই একটি উদাহরণ সৃষ্টির মতো উদ্যোগ নিয়েছে সিরাজগঞ্জ জেলা পুলিশ।
থানায় প্রবেশ করলেই সেবা প্রত্যাশীদের সম্মান দেখিয়ে বসতে বলা হচ্ছে, আপ্যায়নের জন্য দেওয়া হচ্ছে চা। কৃষক-শ্রমিক-মজুর কিংবা ব্যবসায়ী-সেবা নিতে আসা মানুষ যে পেশারই হন না কেন, থানায় এলেই তাকে দেওয়া হচ্ছে প্রাপ্য সম্মান। এতেই বুক ভরে যাচ্ছে সাধারণ মানুষের।
বুধবার (০৯ সেপ্টেম্বর) সিরাজগঞ্জ সদর থানার ডিউটি অফিসারের কক্ষে গেলে এমন চিত্রই দেখা যায়। দিনভর আইনি সেবা নিতে আসা জনগণের জন্য চা প্রস্তুত করে রাখা হয়েছে। সেবাপ্রত্যাশীদের কথা শুনে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিচ্ছেন ডিউটি অফিসার।
একটি পুরনো মামলা নিয়ে কথা বলতে থানায় এসেছেন সদর উপজেলার বাঐতারা এলাকার শামছুল হক ও তার শ্যালক সুলতান মাহমুদ। কক্ষে প্রবেশ করতেই ডিউটি অফিসার উপ-পরিদর্শক দেওয়ান শাহীন তাদের বসতে অনুরোধ করলেন। তারপর এক কনস্টেবল এসে দু’জনকে চা দিলেন। চা পানের পর তাদের থানায় আসার কারণ শুনে সেকেন্ড অফিসারের কক্ষে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
সুলতান মাহমুদ বলেন, সেকেন্ড অফিসার উপ-পরিদর্শক (এসআই) সাইফুল ইসলামের কক্ষে গেলে তিনি আমাদের কথা শোনেন এবং প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেন।
কথা হয় সদর উপজেলার বাগবাটি ইউনিয়নের মাসুদ রানার সঙ্গে। তিনি বলেন, আমি থানায় এসেছিলাম একটি অভিযোগ দিতে। ডিউটি অফিসার আমাকে চা পান করিয়ে থানার পরিদর্শকের (তদন্ত) কক্ষে পাঠিয়ে দিলে তিনি আমাকে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেন।
ছোনগাছা ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য সেলিম রেজা বলেন, এলাকার একটি বিষয় মীমাংসার জন্য আমিসহ চার/পাঁচজন থানায় এসেছিলাম। ডিউটি অফিসারের আপ্যায়ন দেখে আমরা অনেকেই অভিভূত। কক্ষে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে তিনি বসতে বললেন। মুহূর্তের মধ্যেই একজন কনস্টেবল আমাদের চা দিলেন। এর আগে থানায় এমন সম্মান কখনো করা হয়েছে বলে মনে হয় না।
সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. হাফিজুর রহমান বলেন, আইনি সেবা নিতে থানায় আসা মানুষগুলোর সঙ্গে স্বাভাবিক ভদ্র ব্যবহার দেখানো পুলিশের কর্তব্য। এছাড়া আপ্যায়নের জন্য আমরা চেষ্টা করেছি প্রত্যেককে অন্তত এক কাপ করে চা পান করাতে। পুলিশ সুপার স্যারের নির্দেশনায় আমরা পুলিশকে জনগণের কাছে নিয়ে যাবার চেষ্টা করছি। এ কর্মসূচি তারই একটি অংশ।
পুলিশ সুপার মো. হাসিবুল আলম বলেন, মুজিববর্ষের অঙ্গীকার, পুলিশ হবে জনতার। এ লক্ষ্যে সিরাজগঞ্জ জেলা পুলিশকে জনগণের কাছাকাছি নিয়ে যেতে আমরা কাজ করছি। পুলিশ শুধু জনগণকে সেবা দিয়ে যাবে। এরই ধারাবাহিকতায় জেলার ১২টি থানায় একটি করে ইলেক্ট্রিক কেটলি ও চা তৈরির সরঞ্জামাদি দেওয়া হয়েছে। এছাড়া পুলিশ সুপারের তহবিল থেকে প্রতি মাসে থানাগুলোতে চা ও চিনি সরবরাহ করা হবে।
থানায় থানায় এসএমএস সিস্টেম চালু করা হয়েছে। অভিযোগ বা মামলা দিতে আসা বাদী তার মোবাইল ফোনে এসএমএসের মাধ্যমে মামলার নম্বর, তদন্তকারী কর্মকর্তার নাম ও নম্বর জানতে পারবেন বলেও জানান তিনি।