আমাদের মহান সংবিধান স্বীকৃত মৌলিক অধিকার গুলো হলো খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা ও শিক্ষা। নাগরিকদের এসব মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করতে সরকার সম্ভব সব পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে এবং করছে। দেশের প্রত্যেকটি নাগরিকের জন্য ন্যূনতম খাদ্য চাহিদা দুই হাজার ১২০ কিলোক্যালরি নিশ্চিত করতে যেমন সরকার খাদ্য নিরাপত্তাকে অগ্রাধিকার প্রদান করছে, তেমনি চিকিৎসা ও মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিতে সরকার শিক্ষাব্যবস্থায় প্রতিবছর বিনিয়োগ করছে বিশাল অঙ্কের টাকা।
একই সঙ্গে প্রত্যেক নাগরিকের জন্য নিরাপদ, মানসম্মত ও সাশ্রয়ী মূল্যে বাসস্থানের ব্যবস্থা করতেও সরকার প্রতিবছর বাজেট বরাদ্দ বৃদ্ধি করছে আবাসন খাতে। শহর ও শহরতলিতে নাগরিকদের আবাসন সমস্যা সমাধানে নিরন্তর কাজ করে যাচ্ছে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় ও এর অধীন দপ্তর বা সংস্থাগুলো। এর অংশ হিসেবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা ‘সবার জন্য আবাসন, কেউ থাকবে না গৃহহীন’ এবং টেকসই উন্নয়ন অভিলক্ষ্য সামনে রেখে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করছে। এই মন্ত্রণালয়ের চলমান কার্যক্রম ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কিছু খণ্ডিত চিত্র অতিসংক্ষেপে আলোচনা করা যেতে পারে।
গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় সারা দেশে অঞ্চলভিত্তিক উন্নয়ন মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন, হালনাগাদকরণ ও সমন্বয় করে যাচ্ছে। এ ছাড়া প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা, ‘গ্রামের মানুষকে শহরের সুবিধা প্রদান করা’ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সারা দেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলার মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়ন কার্যক্রম পরিচালনা করছে এই মন্ত্রণালয়।
রাজধানী ঢাকার বিদ্যমান ডিটেইল্ড এরিয়া প্ল্যান (ড্যাপ) রিভিউপূর্বক আরো বাস্তবসম্মত, সময়োপযোগী করে ২০১৬-২০৩৫ মেয়াদি একটি পরিকল্পনার খসড়া অনুমোদিত হয়েছে। গণশুনানি করে এটি শিগগিরই চূড়ান্ত করা হবে। রাজশাহী মহানগরীর আওতাভুক্ত ৩৬৪ বর্গকিলোমিটার এলাকায় দুর্যোগ ঝুঁকিপূর্ণ সংবেদনশীল মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়নের কাজ প্রায় সমাপ্ত। নগর উন্নয়ন অধিদপ্তর কর্তৃক কুষ্টিয়া সদর উপজেলার ৩১৮.২৩ বর্গকিলোমিটার এলাকার মাস্টারপ্ল্যান ও চট্টগ্রামের মিরেরসরাইয়ের ৪৮২.৮৮ বর্গকিলোমিটার এলাকার মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়নের কাজ সমাপ্তির পর্যায়ে রয়েছে।
পটুয়াখালী ও বরগুনার মোট সাতটি উপজেলার ৩৩২২.৭৭ বর্গকিলোমিটার এলাকার উন্নয়ন পরিকল্পনা (মাস্টারপ্ল্যান) প্রণয়ন চলমান রয়েছে। পরিকল্পিত নগরায়ণের লক্ষ্যে এই মন্ত্রণালয়ে নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা আইন প্রণয়নের কাজ চলমান আছে। জাইকার সহযোগিতায় আধুনিক ও পরিবেশবান্ধব ইটের বিকল্প ব্লক তৈরির জন্য ‘Verification survey with the private sector for Disseminating Japanese Technologies for Non-fired Solidification Ad Brick Manufacturing process’ শীর্ষক প্রকল্পের কাজ সমাপ্ত হয়েছে। এর ফলে ২০২৫ সালের মধ্যে ইটের ব্যবহার শূন্যের কোঠায় হ্রাসের সরকারি নীতি বাস্তবায়ন ত্বরান্বিত হবে। এ ছাড়া হাউজিং অ্যান্ড বিল্ডিং রিসার্চ ইনস্টিটিউট কর্তৃক পরিবেশবান্ধব Autoclave Aerated Concrete Panel তৈরির জন্য Pilot plant তৈরির কাজ চলমান রয়েছে।
রাজধানী ঢাকার জলাবদ্ধতা ও যানজট নিরসন এবং সৌন্দর্য বর্ধনের লক্ষ্যে লেক উন্নয়ন, খাল খনন, পার্ক বা উদ্যান স্থাপন ও উন্নয়ন, ফ্লাইওভার নির্মাণ কার্যক্রম চলমান রয়েছে। কার্যক্রমগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি নিচে উল্লেখ করা হলো।
কুড়িল-পূর্বাচল লিংক রোডের উভয় পাশে (কুড়িল থেকে বালু নদ) পর্যন্ত ১০০ ফুট চওড়া খাল খনন ও উন্নয়ন শীর্ষক প্রকল্পের ২.৫ মিটার গভীরতায় ১০০ ফুট চওড়া খালের মাটি খননকাজ সমাপ্ত হয়েছে। এ ছাড়া গুলশান-বনানী-বারিধারা লেক উন্নয়ন ও উত্তরা লেক উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ চলমান রয়েছে। এ ছাড়া রমনা পার্কের সৌন্দর্য বৃদ্ধিকল্পে ‘ঢাকাস্থ রমনা পার্কের অবকাঠামোগত এবং রমনা লেকসহ সার্বিক সৌন্দর্য বৃদ্ধিকরণ’ শীর্ষক প্রকল্পের কাজ চলমান রয়েছে। ঢাকা শহরের জলাবদ্ধতা নিরসন ও সৌন্দর্য বৃদ্ধিকরণের লক্ষ্যে হাতিরঝিল, গুলশান, বনানী, উত্তরা, কুড়িল ও পূর্বাচল এলাকায় ৩৯.০০ কিলোমিটার খাল খনন করা হয়েছে। ভবিষ্যতে আরো ৫৫.০০ কিলোমিটার খাল খনন করা হবে।
তুরাগ নদের বন্যাপ্রবাহ অঞ্চলের ৯১২৫.০০ একর এলাকার ৬২ শতাংশ জায়গা জলাধার হিসেবে সংরক্ষিত রেখে অবশিষ্ট এলাকায় কমপ্যাক্ট টাউনশিপ নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে। পিপিপির আওতায় ১০.২০ কিলোমিটার ফ্লাইওভার ও মিরপুরে স্যাটেলাইট টাউন নির্মাণ করা হবে।
চট্টগ্রাম শহরের জলাবদ্ধতা দূরীকরণ, পরিবেশ উন্নয়ন, চিত্তবিনোদন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের লক্ষ্যে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ্যের মাধ্যমে প্রায় ১৮ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কার্যক্রম ও তার অগ্রগতি নিম্নরূপ :
চট্টগ্রাম শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনে ৩৫টি খাল পরিষ্কার ও পুনর্খননকাজ চলমান রয়েছে। ২৪টি খালের পারে রিটেইনিং ওয়ালের কাজ চলমান রয়েছে। ৫৪টি ব্রিজ ও কালভার্টের কাজ চলমান। চট্টগ্রামের মুরাদপুর থেকে লালখানবাজার পর্যন্ত ৬.২ কিলোমিটার ফ্লাইওভারের নির্মাণকাজ সম্পন্ন হয়েছে এবং লালখানবাজার থেকে শাহ আমানত বিমানবন্দর পর্যন্ত ১৬.৫০ কিলোমিটার ফ্লাইওভার নির্মাণের কাজ চলমান। চট্টগ্রাম শহরের যানজট নিরসনের লক্ষ্যে ১৫.২০ কিলোমিটার রিংরোড নির্মাণ প্রকল্পের কাজও সমাপ্তির পর্যায়ে।
গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়াধীন বিভিন্ন সংস্থার আওতায় ঢাকা, চট্টগ্রাম মহানগরীসহ দেশের বিভিন্ন জেলা ও উপজেলা শহরে ৩৫ হাজার ৩৬৫টি প্লট উন্নয়ন এবং আট হাজার ৯১২টি ফ্ল্যাট নির্মাণের কাজ সম্পন্ন হয়েছে। এ ছাড়া গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন প্রকল্পের আওতায় ১৮ হাজার ১০৫টি প্লট উন্নয়ন এবং সাত হাজার ৯৬০টি ফ্ল্যাট নির্মাণের কাজ চলমান। জেলা ও উপজেলা পর্যায়েও প্লট ও ফ্ল্যাট উন্নয়নে প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। ভব্যিষতে সারা দেশে ১৮ হাজার ১৪৮টি প্লট উন্নয়ন ও এক লাখ ৪১ হাজার ৬৮৭টি ফ্ল্যাট নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের।
প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে ঢাকায় বসবাসরত বস্তিবাসীদের জন্য ৫৩৩টি ভাড়াভিত্তিক ফ্ল্যাট নির্মাণের কাজও চলমান এবং আরো ১০ হাজার ৫৩০টি ফ্ল্যাট নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য ৯টি প্রকল্পের আওতায় তিন হাজার ৬৮টি ফ্ল্যাট নির্মাণের কাজ সমাপ্ত হয়েছে। ঢাকা মহানগরীতে সরকারি কর্মচারীদের আবাসন সুবিধা ৮ থেকে ৪০ শতাংশে উন্নীতকরণে ঢাকা মহানগরীতে ১৩টি চলমান প্রকল্পের আওতায় ছয় হাজার ৮৭৯টি ফ্ল্যাটের নির্মাণকাজ চলমান রয়েছে। ঢাকা মহানগরীর বাইরে চট্টগ্রাম ও নোয়াখালীতে চারটি প্রকল্পের দুই হাজার ৮৯৬টি ফ্ল্যাট নির্মাণের কাজও চলমান রয়েছে। আরো আটটি প্রকল্পের আওতায় মোট আট হাজার ৮৩৫টি ফ্ল্যাট নির্মাণের অনুমোদন প্রক্রিয়াধীন।
প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী রাজধানী ঢাকার পার্শ্ববর্তী এলাকায় চারটি স্যাটেলাইট সিটি নির্মাণের প্রকল্প গ্রহণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া পদ্মা বহুমুখী সেতুর উভয় প্রান্তে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট সিটি নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। ঢাকার পূর্বাচলে আধুনিক ও নান্দনিক স্থাপত্যশৈলীসম্পন্ন ১৪২ তলা আইকনিক টাওয়ার নির্মাণ করা হবে। পূর্বাচল নতুন শহরে পিপিপি পদ্ধতিতে ৬০ হাজার ফ্ল্যাট নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।
বর্তমান সরকার ভিশন : ২০২১, ভিশন : ২০৪১, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা, সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা, প্রেক্ষিত পরিকল্পনা। বদ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০ এবং সর্বোপরি বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে। সরকারের সব পরিকল্পনাই জনগণের কল্যাণে এবং জনগণের সর্বাত্মক অংশগ্রহণই এসব পরিকল্পনা বাস্তবায়নের মূল হাতিয়ার। সরকারের লক্ষ্য বাস্তবায়নে তাই আমাদের প্রত্যেকের উচিত নিজ নিজ ক্ষেত্র থেকে দেশের কল্যাণে আত্মনিয়োগ করা এবং সরকারের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে ভূমিকা রাখা। আর তাতে সুফলভোগী হব আমরা- অর্থাৎ সাধারণ নাগরিকরাই।
লেখক : জনসংযোগ কর্মকর্তা, গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়
:কালের কণ্ঠ