সাবেক বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্য মেজর (অব.) সিনহা মো. রাশেদ খান খুনের অন্যতম অভিযুক্ত কক্সবাজারের টেকনাফ থানা থেকে সদ্য প্রত্যাহার হওয়া ওসি প্রদীপ কুমার দাশের নানা কুকীর্তির বিবরণ বেরিয়ে আসছে। মাদকের ট্রানজিট পয়েন্ট টেকনাফে যোগদানের পর তিনি অভিনব কায়দায় শুরু করেন চাঁদাবাজি। তার এসব অপকর্মের কেউ প্রতিবাদ করলে চালানো হতো অমানুষিক নির্যাতন। ইয়াবা দিয়ে ফাঁসিয়ে দেওয়া হতো। অপকর্মের প্রতিবাদ করে ওসি প্রদীপের রোষানলে পড়েছেন সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে অনেক রাজনৈতিক কর্মী। এমন কি গণমাধ্যম কর্মীও বাদ যাননি তার রোষানল থেকে।
পুরো কক্সবাজারজুড়ে প্রদীপের অপকর্ম ওপেন সিক্রেট হলেও এ বিষয়ে অবহিত নন বলে জানান কক্সবাজারের পুলিশ সুপার এ বি এম মাসুদ হোসেন। পুলিশ সুপার বলেন, ‘টেকনাফের সাবেক ওসি প্রদীপ কুমারের বিরুদ্ধে আগে কোনো অভিযোগ পাইনি আমরা। আর এ মুহূর্তে প্রদীপের বিষয়ে কোনো কথা বলতে চাই না। কথা বললে কনফিউশন বাড়বে। তাই কোনো মন্তব্য করতে পারব না।’
অনুসন্ধানে জানা গেছে, প্রদীপ কুমার দাশ কক্সবাজারের টেকনাফ থানায় যোগদানের পর নিজস্ব বলয় তৈরি করেন। এরপর শুরু করেন অভিনব স্টাইলে চাঁদাবাজি। শুরুতে তিনি টার্গেট করেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত মাদক ব্যবসায়ীদের। তিনি এই মাদক ব্যবসায়ীদের থানায় ধরে এনে আদায় করতেন কোটি কোটি টাকা। আবার অনেক ক্ষেত্রে তাদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা আদায়ের পরও ‘বন্দুকযুদ্ধে’র নামে হত্যার নজির তৈরি করেছেন। অভিযানের মুখে চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ীরা এক পর্যায়ে এলাকা ছাড়া হলে প্রদীপ এলাকার ধনাঢ্য ও অবস্থা সম্পন্ন পরিবারের লোকজনকে টার্গেট করতে থাকেন।
এসব ব্যক্তিকে মাদকবিরোধী অভিযানের নামে থানায় এনে চালান অমানুষিক নির্যাতন। অনেককে ১০ থেকে ১৫ দিন পর্যন্ত আটকে রেখে চালাতেন নির্যাতন। যারা টাকা দিতে ব্যর্থ হতেন তাদের বন্দুকযুদ্ধের নাম করে হত্যা করা হতো। কোনো বন্দুকযুদ্ধ হওয়ার পর নতুন করে শুরু করতেন বাণিজ্য। অধিকাংশ বন্দুকযুদ্ধের ঘটনায় দুই থেকে তিনটি মামলা দায়ের করা হতো থানায়। এসব মামলায় আসামি করা হতো এলাকার সম্ভ্রান্ত পরিবারের লোকজনকে। তাদের চার্জশিট থেকে বাদ দেওয়ার নাম করে তিনি হাতিয়ে নিতেন লাখ লাখ টাকা। অনেক ক্ষেত্রে এসব মামলার আসামিদের গ্রেফতারের নামে বাড়িতে চালানো হতো অভিযান।
কথিত অভিযানে বাড়ি থেকে লুট করা হতো স্বর্ণালঙ্কার, টাকাসহ মূল্যবান জিনিসপত্র। প্রদীপের এসব কাজের যারাই প্রতিবাদ করেছেন তাদের ওপর নেমে এসেছে অমানুষিক নির্যাতন। অভিযোগ অনুযায়ী, তার অপকর্মের প্রতিবাদ করায় ইয়াবা দিয়ে ফাঁসিয়ে দেওয়া হয়েছে অনেককে। আবার অনেককে থানায় ধরে নিয়ে চালানো হয়েছে অমানুষিক নির্যাতন। প্রতিবাদ করে প্রদীপের রোষানলে পড়েছেন রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী, সমাজকর্মী থেকে শুরু করে সাধারণ লোকজন। প্রদীপের অপকর্ম নিয়ে প্রতিবেদন করায় রোষানলে পড়েছেন গণমাধ্যম কর্মীরাও। জানা গেছে, টেকনাফে প্রদীপের অবৈধ লেনদেনের টাকা গ্রহণ করতেন চারজন। তাদের মধ্যে দুজন টেকনাফের বড় গরু ব্যবসায়ী, অপর দুজন স্বর্ণ কেনাকাটার মহাজন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে টেকনাফের এক রাজনীতিবিদ বলেন, ‘ওসি প্রদীপের নির্যাতনের কাহিনি শুনলে যে কারও গা শিউরে উঠবে। টেকনাফের লোকজনের জন্য প্রদীপ ছিলেন মূর্তিমান আতঙ্ক।
তার অপকর্মের প্রতিবাদ করলে থানায় ধরে নিয়ে চালানো হতো অমানুষিক নির্যাতন। প্রতিবাদ করায় অনেককে ইয়াবা দিয়ে ফাঁসিয়ে দেওয়া হয়েছে। অভিযানের নামে অনেকের ঘরে লুটপাট চালানো হয়েছে।’ কক্সবাজারের আরেকজন অধিবাসী বলেন, ‘পর্যটন শহরের সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য মেরিন ড্রাইভ তৈরি করা হলেও টেকনাফের ওসি এটিকে মৃত্যুপুরীতে পরিণত করেন। প্রদীপের হাতে সংঘটিত বন্দুকযুদ্ধের সিংহভাগ হয়েছে এই মেরিন ড্রাইভে।’