মহামারী করোনার প্রভাবে গোটা বিশ্বেই বিরাজ করছে অস্থিতিশীল পরিবেশ। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর প্রাতিষ্ঠানিক আইসোলেশনে (বিচ্ছিন্ন রাখা) থাকা রোগীদের যে হিসাব প্রতিদিন দিয়ে যাচ্ছে, তা নিয়ে অস্পষ্টতা তৈরি হয়েছে। প্রাতিষ্ঠানিক আইসোলেশন বলতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর আসলে কী বোঝাচ্ছে, সেটি নিয়েও ধোঁয়াশা রয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্যে প্রাতিষ্ঠানিক আইসোলেশনে থাকা রোগীদের মধ্যে করোনা শনাক্ত হওয়া রোগী আসলে কতজন, সেই হিসাবও গোলমেলে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, যাঁদের করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) শনাক্ত হয়েছে, তাঁরাই হাসপাতালে বা বাড়িতে ১৪ দিন আইসোলেশনে থাকবেন। করোনা শনাক্ত হওয়ার পর যাঁদের অবস্থা জটিল নয় এবং উপসর্গ মৃদু, তাঁরাই বাড়িতে থেকেই চিকিৎসকের পরামর্শমতো চলবেন।
যাঁরা সরকারি ব্যবস্থাপনায় হাসপাতালে বা সরকার নির্ধারিত কোনো হোটেল কিংবা আইসোলেশন সেন্টারে চিকিৎসা নিচ্ছেন, নিয়ম অনুযায়ী তাঁরাই প্রাতিষ্ঠানিক আইসোলেশনে রয়েছেন। গড়ে দৈনিক ১৫ থেকে ১৮ হাজার রোগী প্রাতিষ্ঠানিক আইসোলেশনে রয়েছেন, এমন তথ্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিয়মিত বুলেটিনে উল্লেখ করা হয়।
দেশে শুধু করোনা রোগীদের চিকিৎসার জন্য বিভিন্ন হাসপাতালে শয্যা রয়েছে ১৪ হাজার ৯৪৫টি। গতকাল সারা দেশে করোনা রোগী ভর্তি ছিলেন ৪ হাজার ৩৬১ জন। অর্থাৎ, রোগী অনুপাতে হাসপাতালের শয্যা ফাঁকা ছিল ১০ হাজার ৫৮৪টি। অন্যদিকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গতকাল দেশে আইসোলেশনে ছিলেন ১৭ হাজার ১৯২ জন। এখন প্রশ্ন উঠেছে, করোনা রোগীদের প্রাতিষ্ঠানিক আইসোলেশনে রাখা হলে হাসপাতালের এত শয্যা ফাঁকা থাকছে কীভাবে। প্রাতিষ্ঠানিক আইসোলেশনে থাকা রোগীদের কারও বাসায় থাকার কথা নয়।
এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক নাসিমা সুলতানা বলেন, প্রাতিষ্ঠানিক আইসোলেশনের যে সংখ্যা দেওয়া হয়, তাতে করোনা শনাক্ত ও সন্দেহভাজন—দুই ধরনের রোগীর তথ্যই থাকে।
বিষয়টি নিয়ে দুজন বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক, দুজন সিভিল সার্জন এবং দুজন উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তার সঙ্গেও কথা বলেছে গণমাধ্যম। প্রাতিষ্ঠানিক আইসোলেশনে থাকা রোগীরা করোনা শনাক্ত হওয়া রোগী নাকি সন্দেহভাজন রোগী, তা নিয়ে তাঁদের বক্তব্যেও ভিন্নতা পাওয়া গেছে।
একজন বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক ও একজন সিভিল সার্জন বলেন, যেসব রোগীর করোনা শনাক্ত হয়েছে, কিন্তু লক্ষণ ও উপসর্গ মৃদু, তাঁদের প্রাতিষ্ঠানিক আইসোলেশনে রাখা হচ্ছে। হাসপাতালের পাশাপাশি স্কুল, সরকারি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রেও আইসোলেশনে রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে। তবে হাসপাতালের বাইরে দেশে আইসোলেশন শয্যার সংখ্যা কত, সেটি তাঁরা বলতে পারেননি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরও এখন পর্যন্ত প্রাতিষ্ঠানিক আইসোলেশন শয্যা কত রয়েছে, তা প্রকাশ করেনি।
রংপুর বিভাগের স্বাস্থ্য পরিচালক আমিন আহমেদ খান প্রথম আলোকে বলেন, প্রাতিষ্ঠানিক আইসোলেশনে যাঁরা থাকেন, তাঁরা করোনা শনাক্ত রোগী, তাঁদের উপসর্গ মৃদু এবং তাঁদের মাধ্যমে সংক্রমণ ছড়ানোর আশঙ্কা রয়েছে। বাড়িতে আইসোলেশনে থাকার সুযোগ না থাকার কারণেই মূলত অনেকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে আইসোলেশনে থাকেন।
অন্যদিকে একজন বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক, একজন সিভিল সার্জন এবং দুজন উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা বলেন, করোনার উপসর্গ দেখা দিলেও পরীক্ষা করার আগ পর্যন্ত নিশ্চিত হওয়া যায় না, ওই ব্যক্তি আসলেই করোনাভাইরাসে আক্রান্ত কি না। উপসর্গ নিয়ে হাসপাতালে আসা রোগীকে সরাসরি করোনা ইউনিটে পাঠানো যায় না, সাধারণ নন-কোভিড ওয়ার্ডেও রাখা যায় না। সন্দেহভাজন এসব রোগীকে হাসপাতালের আইসোলেশন ইউনিটে রেখে প্রাতিষ্ঠানিক আইসোলেশনে থাকা রোগী হিসেবে দেখানো হচ্ছে।
বরিশাল বিভাগের স্বাস্থ্য পরিচালক বাসুদেব কুমার দাস প্রথম আলোকে বলেন, উপসর্গ নিয়ে হাসপাতালে আসা রোগী, যাঁদের করোনা পরীক্ষা হয়নি বা পরীক্ষার ফল এখনো পাওয়া যায়নি, তাঁদের প্রাতিষ্ঠানিক আইসোলেশনে রাখা হচ্ছে। উপজেলা, জেলা, মেডিকেল কলেজ—সব জায়গাতেই আইসোলেশন ইউনিট রয়েছে। বরিশাল জেলায় দৈনিক ৮০ থেকে ১০০ জন এমন সন্দেহভাজন রোগী প্রাতিষ্ঠানিক আইসোলেশনে থাকছেন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের গত ১৫ মার্চের একটি গাইডলাইনে বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তির জ্বর, কাশি, গলাব্যথা, শ্বাসকষ্ট থাকে, তাহলে ওই ব্যক্তিকে ‘সন্দেহজনক রোগী’ হিসেবে বিবেচনা করা হবে। এই রোগীদের পৃথক করে তাঁদের চিকিৎসা হাসপাতালে হওয়া উচিত। চিকিৎসাসেবা অপ্রতুল হলে বা রোগী হাসপাতালে থাকতে না চাইলে বাড়িতে রেখে চিকিৎসার বিষয়টি বিবেচনা করা যেতে পারে।
মুন্সিগঞ্জের শ্রীনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা সৈয়দ রেজাউল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, প্রতিটি উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ৫ শয্যার আইসোলেশন ইউনিট রয়েছে। হাসপাতালে আসার পর সন্দেহভাজন রোগীদের এই আইসোলেশন ইউনিটে রাখা হচ্ছে। করোনা পরীক্ষার ফলাফল আসার আগ পর্যন্ত সন্দেহভাজন রোগীদের প্রাতিষ্ঠানিকভাবে আইসোলেশনে রাখা হচ্ছে।
প্রতিদিন প্রাতিষ্ঠানিক আইসোলেশন থেকে ছাড় পাচ্ছেন কতজন, সেটিও জানাচ্ছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। গতকাল আইসোলেশন থেকে ছাড় পান ৭৬৮ জন। করোনা শনাক্ত রোগীদের যদি প্রাতিষ্ঠানিক আইসোলেশনে রাখা হয়ে থাকে, তাহলে সেখান থেকে ছাড় পাওয়া মানে ওই রোগী সুস্থ হয়ে গেছেন। কিন্তু প্রতিদিন সুস্থ হওয়া রোগীর সংখ্যা আলাদাভাবে দেখাচ্ছে অধিদপ্তর। কিন্তু সেখানে প্রাতিষ্ঠানিক আইসোলেশন থেকে ছাড় পাওয়া রোগীদের হিসাব থাকছে না।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক অধ্যাপক বে-নজির আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য-উপাত্ত নানা ধরনের বিভ্রান্তি তৈরি করছে। কারও করোনা শনাক্ত হলে তাঁকে বাসায় বা হাসপাতালে আইসোলেশনে রাখতে হবে, এটাই নিয়ম। শনাক্ত রোগীদের যদি প্রাতিষ্ঠানিক আইসোলেশনে রাখা হয়ে থাকে, তাহলে হাসপাতালে এত শয্যা ফাঁকা থাকছে কেন, এই প্রশ্ন তাঁরও।
বে-নজির আহমেদ বলেন, যদি সন্দেহভাজন রোগীদের প্রাতিষ্ঠানিক আইসোলেশনে রাখা হয়ে থাকে, তাহলে শনাক্ত রোগীদের কতজন প্রাতিষ্ঠানিক সেবা নিচ্ছে, সেটি আলাদা করে বলতে হবে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য-উপাত্ত জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য হতে হবে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অব্যবস্থাপনার কারণে দেশে করোনা পরিস্থিতি নিয়ে একধরনের অযাচিত ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে।
: প্রথম আলো