জাল-জালিয়াতি, নামে-বেনামে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সিন্ডিকেট গড়ে তুলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় নিয়ন্ত্রণে নিয়েছেন মোতাজ্জেরুল ইসলাম মিঠু। তিনি এতটাই প্রভাবশালী হয়ে উঠেছেন যে, তাকে বলা হয়ে থাকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মাফিয়া ডন। স্বাস্থ্য খাতে তার কথায়ই কেনাকাটা, তার কথায়ই প্রাইজ লিস্ট। কাজ বণ্টনও তার নির্দেশেই। কোনো কর্মকর্তা তার নির্দেশমতো কাজ না করলে তিনি আর সেই পদে বহাল থাকতে পারেন না। আমেরিকায় বসেই মিঠু স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন ঠিকাদারি প্রায় সব কাজ তার ২০টি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করছেন। শুধু তাই নয়, মালামাল সরবরাহ না করেও বিল উত্তোলনের মতো ভয়ঙ্কর জালিয়াতির অসংখ্য ঘটনা ঘটিয়েছেন তিনি। করোনাকালে দেশের স্বাস্থ্য খাতের যে নাজুক অবস্থা ধরা পড়েছে, সে জন্য অনেকেই ‘মিঠু সিন্ডিকেট’কে দায়ী করেন।
তবুও ধরাছোঁয়ার বাইরেই রয়ে গেছেন স্বাস্থ্য খাতের মাফিয়া ডন মিঠু। জানা গেছে, মিঠুর উত্থান ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত শাসনামলে। তবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে তখন পদচারণা তার খুব একটা ছিল না। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে টুকটাক ব্যবসা করতেন। কিন্তু ২০০৯ সাল থেকে নাটকীয় উত্থান ঘটে এই মিঠুর। তৎকালীন স্বাস্থ্যমন্ত্রী আ ফ ম রুহুল হকের আশীর্বাদ নিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় দখলে নেয় মিঠু সিন্ডিকেট। এ সময় তার সিন্ডিকেটের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে হাজার হাজার কোটি টাকার কাজ নিয়ে আকাশছোঁয়া অবস্থানে চলে যান মিঠু। বিএনপি-জামায়াতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা থাকলেও মিঠুর উত্থান তাতে কোনো বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। একসময় তিনি দেশের স্বাস্থ্য খাতের মাফিয়া হয়ে উঠেন। তার বনানীর অফিস কার্যত হয়ে উঠে স্বাস্থ্য বিভাগের সাব অফিস। সেই অফিসে বসেই স্থাস্থ্য খাতের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা মিঠুর নির্দেশমতে কাজ বণ্টন করে। যে হাসপাতালে যন্ত্রপাতি সরবরাহ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, সে স্থানে আগে ভাগেই নিজের পছন্দমতো কর্মকর্তাকে বদলি করিয়ে নেয় মিঠু। তবে মিঠুর প্রতিষ্ঠানগুলো দেড় দুই বছরের বেশি কাজ করে না। প্রতি অর্থবছরে নতুন নতুন নামে প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স নেন তিনি।
রাজধানীর ৪/৩ নম্বর কমলাপুর বাজার রোডের ঠিকানায় ফিউচার ট্রেড নামে একটি প্রতিষ্ঠানের মালিকানা দেখানো হয় মিঠুর স্ত্রীর নামে। এ প্রতিষ্ঠানটি মুগদা ৫০০ শয্যাবিশিষ্ট মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে উচ্চ মূল্যে নিম্নমানের যন্ত্রপাতি সরবরাহ করে। এ নিয়ে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা ও বেসরকারি টিভি চ্যানেলে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। অনুসন্ধানে কমলাপুরে মিঠুর সেই অফিসের কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি। ঠিকানা অনুযায়ী সেই অফিস কখনই ছিল না। তার অধিকাংশ লাইসেন্সেরই ঠিকানা অনুযায়ী অফিস খুঁজে পাওয়া যায় না। এই হাসপাতালে দুটি মেশিন সরবরাহের মূল্য তালিকা দেখলেই লুটপাটের চিত্র ফুটে ওঠে। টেন্ডারে অংশ নিয়ে ক্যাথ ল্যাব সরবরাহে ফিলিপস কোম্পানি দর দিয়েছিল ৪ কোটি টাকা। অথচ সেই ক্যাথ ল্যাব মিঠুর কোম্পানি সরবরাহ করেছে প্রায় ৮ কোটি টাকায়। সিটি স্ক্যান সরবরাহের জন্য ফিলিপস কোম্পানি ৪ কোটি ৮০ লাখ টাকা দর দিলেও সেই সিটি স্ক্যান মেশিন সরবরাহ করেছে সাড়ে ১৩ কোটি টাকায়। দেশের ১৮টি মেডিকেল কলেজ ও মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বড় অঙ্কের অধিকাংশ ঠিকাদারি কাজই হাতিয়ে নেয় তার প্রতিষ্ঠানগুলো। সংশ্লিষ্টরা বলছে, গত দুই বছরে স্বাস্থ্য খাত নিয়ে দুদক অনেক অনুসন্ধান করে। এমনকি দুদকের সুপারিশের পর স্বাস্থ্য অধিদফতর যে ১৪ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে ‘কালো তালিকাভুক্ত’ করেছে সেখানে মিঠুর একটি প্রতিষ্ঠানের নামও নেই।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের এই প্রভাবশালী ঠিকাদার মিঠু সিন্ডিকেটের কিছু তথ্য তুলে ধরে সিএমএসডির বিদায়ী পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শহীদউল্লাহ গত ৩০ মে জনপ্রশাসন সচিবকে একটি চিঠি পাঠান। তার বিদায় হওয়ার পেছনে এই সিন্ডিকেট রয়েছে বলে অনেকে মনে করেন। তিনি চিঠিতে বলেন, ‘স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিব ও স্বাস্থ্যমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সহকারী (পিএস) তাকে (শহীদুল্লাহ) মেডিটেক ইমেজিং লিমিটেড নামে একটি প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেওয়ার নির্দেশ দেন। স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও তার ছেলের পক্ষ থেকে ওই প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেওয়ার নির্দেশনা রয়েছে বলে তাকে জানান ওই দুই কর্মকর্তা।’ চিঠিতে শহীদউল্লাহ আরও জানান, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ওই দুই কর্মকর্তা মেডিটেক ইমেজিং লিমিটেডসহ তার সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলোতে কাজ দেওয়ার জন্য চাপপ্রয়োগ অব্যাহত রাখেন। ওই কোম্পানির পাঠানো তালিকা ও মূল্য অনুযায়ী দ্রব্যাদি কেনাকাটা করার মৌখিক নির্দেশনা দেওয়া হয়। তিনি এ প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন এবং ক্রয় তালিকায় সেগুলো অন্তর্ভুক্ত করেননি। এতে মেডিটেক ইমেজিংসহ সহযোগী ঠিকাদাররা ক্ষুব্ধ হন।’
স্বাস্থ্য অধিদফতরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সম্প্রতি মন্ত্রণালয় কভিড হাসপাতালের আইসিইউর জন্য ডিপিএমে (সরাসরি ক্রয় পদ্ধতি) কিছু চিকিৎসা যন্ত্রপাতি ক্রয়ের চাহিদা দেয়। মন্ত্রণালয়ের কয়েক কর্মকর্তা মৌখিকভাবে মেডিটেক ইমেজিংয়ের কাছ থেকে ওইসব সামগ্রী ক্রয়ের নির্দেশ দেন। কিন্তু মেডিটেক ইমেজিংয়ের যন্ত্রপাতি ছিল নিম্নমানের ও দাম বেশি। ফলে তারা বাদ পড়ে। এরপরও মিঠুর বেনামি প্রতিষ্ঠান মেডিটেক ইমেজিংকেই বিভিন্ন হাসপাতালে ২৫০টি আইসিইউ মেশিন সরবরাহের কাজ দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে বলে জানা গেছে। আর এ প্রক্রিয়ায় প্রতিটি আইসিইউ মেশিনের দাম ধরা হয়েছে প্রকৃত বাজারদরের চেয়ে ৪-৫ গুণ বেশি।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, মিঠুর রয়েছে কমপক্ষে ২০ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান । মিঠু, তার স্ত্রী, ভাই, ভাগ্নিসহ আত্মীয় ও বন্ধুবান্ধবের নামে থাকা কমপক্ষে ২০টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের নাম পাওয়া যায়। সংশ্লিষ্টরা বলেন, মিঠুর প্রতিষ্ঠানগুলো দেড়-দুই বছরের বেশি কাজ করে না। প্রতি অর্থবছরে নতুন নতুন নামে প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স নেন তিনি। ২০১৬ সালে দুদকের তদন্তে মিঠুর নামে-বেনামে থাকা ১৬ প্রতিষ্ঠানের নাম উঠে আসে। এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে মিঠু ও তার স্ত্রীর যৌথ নামে রয়েছে লেক্সিকোন মার্চেন্ডাইজ ও টেকনোক্রেট লিমিটেড। ওই সময় দুদকের চিঠিতে মিঠুকে এ দুটি প্রতিষ্ঠানের প্রোপাইটর উল্লেখ করা হয়। প্রতিষ্ঠানগুলোর ঠিকানা উল্লেখ করা হয় (১) বাসা নং-৮, রোড-৬, ব্লক-সি, বনানী, ঢাকা। (২) কাজী ভবন, ৭মতলা, ৩৯ নিউ এলিফ্যান্ট রোড, ঢাকা। (৩) রুম নং-৩০৯, রাজা রামমোহন মার্কেট, রংপুর (৪) হাউস নং ৪২০, রোড-১১, সিডিএ, আগ্রাবাদ, চট্টগ্রাম। (৫) ১৪৩, মালিবাগ বাজার রোড, ঢাকা। (৬) বাড়ি নং-৫/এ, রোড-২৫/এ, ব্লক-এ, বনানী, ঢাকা। এছাড়া মিঠুকে ঢাকা সেন্ট্রাল ইন্টারন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হসপিটালের চেয়ারম্যান উল্লেখ করে সে বিষয়েও তথ্য চায় দুদক। জানা গেছে, মিঠুর স্ত্রী নিশাত ফারজানা ও অন্যান্য আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে বড় ভাইয়ের নামে রয়েছে সিআর মার্চেন্ডাইজ ও এলআর এভিয়েশন নামে দুটি ঠিকাদারি লাইসেন্স। মিঠুর ভাবির নামে রয়েছে জিইএফ অ্যান্ড ট্রেডিং। ভাগ্নের নামে রয়েছে ট্রেড হাউস। ভাগ্নের স্ত্রীর নামে আছে মেহেরবা ইন্টারন্যাশনাল। আত্মীয়দের নামে আরও আছে ক্রিয়েটিভ ট্রেড, ফিউচার ট্রেড, লেক্সিকোন আইটি প্রাইভেট লিমিটেড, টেকনো ট্রেড, বেলএয়ার এভিয়েশন, জিইএস অ্যান্ড ট্রেডিং, হ্যাভ ইন্টারন্যাশনাল, লেসিকন হসপিটালিটি, নর্থ টেক এলএলসি লিমিটেড, থ্রি-আই মার্চেন্ডাইজিং, ইনসেনারিটি লিমিটেড। তার এসব ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য অধিদফতর, কেন্দ্রীয় ঔষধাগার (সিএমএসডি), স্বাস্থ্য শিক্ষা ব্যুরো, পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতর, স্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগ, ঔষধ প্রশাসন, জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, নার্সিং অধিদফতর, প্রায় সব কটি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে ঠিকাদারি করেন। এ ছাড়া বিভিন্ন জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয় এবং জেনারেল হাসপাতালগুলোতেও যন্ত্রপাতি সরবরাহ করে তারা। অভিযোগ রয়েছে, স্বাস্থ্যসেবা ও স্বাস্থ্য শিক্ষাসংক্রান্ত প্রতিষ্ঠানগুলোতে আছে মিঠুর ‘বিশ্বস্ত ও অতিবিশ্বস্ত’ এজেন্ট। তারাই মিঠুর হয়ে সব কাজ করে। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, এ জন্য কখনো ‘প্রতাপশালী’ ব্যক্তিদের প্রভাব খাটানো হয় অথবা কখনো অর্থ লেনদেনের মাধ্যমে ‘ম্যানেজ’ করা হয়।
আবার কখনো সংশ্লিষ্টদের জন্য ‘প্লেজার্স ট্যু’র ব্যবস্থা করা হয়। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, ফিনল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচারের অভিযোগ আছে ‘এই চক্রের’ বিরুদ্ধে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, দুদক কোনো নোটিস হলেই হাই কোর্টে রিট আবেদন করেন মিঠু। পরে সেটি নথিভুক্ত করার মাধ্যমে ‘অভিযোগ নিষ্পত্তি’ করিয়ে নেন তিনি। মিঠুর বিরুদ্ধে এ পর্যন্ত একটি ‘নন-সাবমিশন’ মামলা করেছে দুদক। ২০১৬ সালের ১০ মে বনানী থানায় মামলাটি করেন দুদকের সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ সিরাজুল হক। এরই মধ্যে গত ১ জুলাই মিঠুকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ‘অতীব জরুরি তলবি নোটিস’ পাঠিয়েছে দুদক। দুদকের পরিচালক মীর মো. জয়নুল আবেদীন শিবলী স্বাক্ষরিত ওই নোটিসে তাকে ৯ জুলাই কমিশনে হাজির থাকতে বলা হয়েছে। নোটিসে বলা হয়েছে, ‘স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় এবং স্বাস্থ্য অধিদফতরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অনিয়ম, দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে কভিড-১৯-এর চিকিৎসার নিমিত্ত নিম্নমানের মাস্ক, পিপিই ও অন্যান্য স্বাস্থ্য সরঞ্জাম ক্রয়সহ বিভিন্ন হাসপাতালে সরবরাহ করার নামে অন্যদের যোগসাজশে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎপূর্বক অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ উঠেছে। এ অভিযোগের সুষ্ঠু অনুসন্ধানের স্বার্থে বর্ণিত অভিযোগ বিষয়ে তাদের বক্তব্য শ্রবণ ও গ্রহণ করা একান্ত প্রয়োজন।’ নোটিসে মিঠুকে ঢাকা সেন্ট্রাল ইন্টারন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হসপিটালের চেয়ারম্যান ও লেক্সিকোন মার্চেন্ডাইজ ও টেকনোক্র্যাট লিমিটেডের মালিক বলা হয়।
দুদকের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা জানান, সম্পদের অনুসন্ধান করতে গিয়ে নানা অনিয়ম ও অবৈধ টেন্ডার বাণিজ্যের মাধ্যমে বিপুল সম্পদের মালিক হওয়ার তথ্য মিলে মিঠুর বিরুদ্ধে। সাবেক এক স্বাস্থ্যমন্ত্রীর ছেলেকে ব্যবসায়িক অংশীদার হিসেবে রেখে মহাজোট সরকারের গত আমলে স্বাস্থ্য খাতের সব ধরনের টেন্ডার এককভাবে নিয়ন্ত্রণ করেন মিঠু।
:বাংলাদেশ প্রতিদিন