বাংলাদেশে মহামারী করোনা নিয়ন্ত্রণে করণীয় বিষয়

মহামারী করোনা, কভিড-১৯ নামক ভাইরাস দ্বারা সংঘটিত মারাত্মক আতঙ্ক সৃষ্টিকারী একটি সংক্রামক রোগ। যার সংক্রমণ হার অত্যন্ত বেশি কিন্তু মৃত্যুহার কম। কভিড-১৯ একটি ক্ষিপ্রগতিসম্পন্ন দুর্দান্ত শক্তিশালী ভাইরাস, যা আক্রান্ত রোগী থেকে মুখ, নাক এবং চোখ দিয়ে সুস্থ মানবদেহে সংক্রমিত হয় এবং একই সঙ্গে আক্রান্ত রোগীর Respiratory, Cardiac, Renal ও Gastro-intestinal system-কে দ্রুত আক্রমণ এবং ক্ষতিগ্রস্ত করে। তবে অধিক ক্ষতিগ্রস্ত হয় নিউমোনিয়া, অ্যাজমা, হূদরোগ, ডায়াবেটিস ও কিডনি রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিরা। যাদের সংখ্যা মাত্র ৫%-১০%। বাকি ৯০%-৯৫% মানুষের শরীরে প্রতিরোধক্ষমতা বেশি হওয়ায় তাদের খুব একটা ক্ষতি করতে পারে না এবং সামান্য চিকিৎসা ও মানবদেহে রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বৃদ্ধিকারী পথ্যাপথ্য খেলেই ভালো হয়ে যায়।

করোনায় সংক্রমণ এবং মৃত্যুর মিছিল যেভাবে দীর্ঘ হচ্ছে তাতে বাংলাদেশ খুব দ্রুত পৃথিবীর অন্যান্য অধিক সংক্রমণশীল দেশের কাতারে চলে আসছে। বিজ্ঞানসম্মত কারণেই হয়তো ওই সব দেশে করোনা মৃত্যুহার অনেক বেশি। তবে করোনা মহাযুদ্ধে টিকে থাকার জন্য তাদের মতো যদি আমাদের সমরাস্ত্র থাকত, তাহলে এ দেশে করোনা রোগীর মৃত্যুসংখ্যা হয়তো এত না-ও হতে পারত।

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে, যেমন—দক্ষিণ কোরিয়া, চীন, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, ফ্রান্স, স্পেন, ইতালি, তুরস্ক, ইরান ইত্যাদি র‍্যাপিড টেস্ট কিট ব্যবহার করে দ্রুত করোনা পরীক্ষা করছে। যেসব দেশ করোনাকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম হয়েছে, তাদের মধ্যে দক্ষিণ কোরিয়া, হংকং, সিঙ্গাপুর, তাইওয়ান, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া প্রভৃতি দেশ করোনা রোগী দ্রুত পরীক্ষা এবং পৃথক থাকা নীতি অবলম্বন করেই সফল হয়েছে। এটি সত্য যে বিভিন্ন প্যারামিটারে করোনা নিরূপণ, প্রতিরোধ ও চিকিত্সা বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের সক্ষমতা পূর্বাপেক্ষা অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। RTPCR পরীক্ষা একটি উত্তম ব্যবস্থা তাতেও কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই। কিন্তু যে হারে মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে, তাতে RTPCR-এর মতো একটি ল্যাবরেটরি ভিত্তিক পরীক্ষা ব্যবস্থা দেশের সর্বত্র আক্রান্ত সব করোনা রোগীর জন্য উন্মুক্ত করা কোনোক্রমেই সম্ভব নয়। অন্যদিকে ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা করতে গিয়ে জনবহুল পরিবেশে সুস্থ ব্যক্তি অসুস্থ ব্যক্তির সংস্পর্শে এসে আক্রান্ত হচ্ছে। আক্রান্ত ব্যক্তি বিলম্বে রিপোর্ট পাওয়ার কারণে চিকিত্সাব্যবস্থা গ্রহণে বিলম্ব হচ্ছে; অপরাপর শারীরিক ও মানসিক দিক থেকে দুর্বল হয়ে পড়ে। বিড়ম্বনার ভয়ে পরীক্ষা না করে আক্রান্ত ব্যক্তি অন্যদের মাঝে রোগ ছড়াচ্ছে।

করোনা রোগীর সংখ্যা এবং মৃত্যুহার যেভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে তাতে মনে হয় এটি মোকাবেলায় পরীক্ষা ও চিকিত্সাব্যবস্থার চলমান কৌশলে পরিবর্তন আনা বিশেষ প্রয়োজন।

ক. দেশের প্রখ্যাত প্রগতিশীল বক্ষব্যাধি বিশেষজ্ঞ, মেডিসিন বিশেষজ্ঞ এবং জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ নিয়ে ‘Corona Control Action Committee’ গঠন করা যায়। যাঁরা করোনা প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে একটি Time Bound Road Map প্রস্তুত এবং তা বাস্তবায়ন উপযোগী SOP তৈরি করে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় কাঙ্ক্ষিত সময়ের মধ্যে করোনায় মৃত্যু ও বিস্তার হার হ্রাস করতে পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন।

খ. RTPCR মেশিনে করোনা রোগী শনাক্তের পাশাপাশি করোনা র্যাপিড টেস্ট কিট ব্যবহার করে দ্রুত রোগ শনাক্তপূর্বক প্রয়োজনীয় চিকিত্সা প্রদান ও রোগী পৃথককরত এক ব্যক্তি থেকে অন্য ব্যক্তিতে করোনা বিস্তার রোধ করা। এ ক্ষেত্রে দেশীয়ভাবে যদি টেস্ট কিট সংগ্রহ করা সম্ভব না হয়, তবে বিদেশ থেকে দ্রুত তা আমদানি করে সব রোগীর পরীক্ষার জন্য উন্মুক্ত করা। এতে সন্দেহভাজন রোগী সহজে রোগ শনাক্ত করে নিজ থেকেই পৃথক থাকতে পারবে এবং অন্যকে রোগ ছড়াবে না। RTPCR-এর ওপর চাপ কমবে। করোনা বিস্তার হ্রাস পাবে এ রোগ সংক্রমণের প্রাথমিক অবস্থায় রোগীর শারীরিক অবস্থা অপেক্ষাকৃত ভালো থাকে। সুতরাং প্রাথমিক অবস্থায় যথাযথ চিকিত্সা প্রদান করা হলে যেকোনো রোগীর আরোগ্য লাভের সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়, ফলে মৃত্যুর হারও কমবে।

করোনায় টেস্ট কিট ব্যবহার করার আরেকটা সুবিধা—এ প্রক্রিয়ায় রোগীর দেহে করোনা এন্টিবডি উপস্থিতি নিরূপণ করা হয়। সুতরাং ওই রোগী আরোগ্যের পর তালিকাভুক্ত করে তাদের রক্ত সংগ্রহপূর্বক Plasma Therapy প্রস্তুত করা সহজ হবে। মানুষ যদি ফার্মেসি থেকে করোনা টেস্ট কিট ক্রয় করে নিজ ঘরে বসে, ফার্মেসিতে বা নিকটবর্তী স্বাস্থ্যকেন্দ্রে করোনা পরীক্ষা করতে পারে, তাহলে আক্রান্ত হলেও নিজ থেকেই পৃথক থেকে চিকিৎসা গ্রহণ করতে পারবে। আর রোগাবস্থা বেশি খারাপ হলে দ্রুত Refferal হাসপাতালে গিয়ে যথাযথ চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হতে পারবে।

গ. বড় শহর ছাড়াও, বিশেষ করে জেলা সদর ও মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালগুলোতে Oxygen ও Ventilation সুযোগ সমৃদ্ধ করে করোনা Refferal হাসপাতালে উন্নিতপূর্বক দেশের সর্বত্র জটিল করোনা রোগীর দ্রুত সুচিকিৎসা ব্যবস্থা নিশ্চিত করা।

ঘ. হাসপাতাল ছাড়াও (প্রকাশ্য বা গোপনে) দেশের সব প্রান্তে নিজ নিজ বাড়িতে অবস্থানরত সব রোগীকে Tracing ও Tracking পদ্ধতিতে সরকারি পরিসংখ্যানের আওতাভুক্ত করে সুচিকিৎসা নিশ্চিত করা। যাতে বিনা চিকিৎসা বা অপচিকিৎসায় কোনো রোগী মারা না যায় এবং পরিবার, সমাজ বা জনগোষ্ঠীতে কোনো রোগীই রোগ ছড়াতে না পারে। এর জন্য প্রয়োজনীয় সরকারি কর্মীদের পাশাপাশি দেশব্যাপী সব University এবং College-এর ছাত্র-ছাত্রীদের দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করে ভলান্টিয়ার হিসেবে নিয়োগ প্রদান করা। যারা শহর-বন্দর-গ্রাম সর্বত্র বিচরণ করে করোনা রোগীর তথ্য সংগ্রহ, তাদের চিকিত্সা এবং আরোগ্য লাভ, জনসাধারণকে মাস্ক ধারণ ও সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে উদ্বুদ্ধ করবে।

ঙ. করোনা রোগীর শরীরে রোগ প্রাবল্য নিরূপণের জন্য Oxygen Concentration নিরূপক যন্ত্র বা অক্সিমিটারসহ অন্যান্য যন্ত্রপাতি উপজেলা হাসপাতাল, কমিউনিটি ক্লিনিক এবং বিশেষ করে সিটি করপোরেশন এলাকায় ওয়ার্ড লেভেল স্বাস্থ্য সেবাকেন্দ্র সরবরাহ করা। যাতে সামান্য আক্রান্ত রোগীরা রোগ প্রাবল্য নিরূপণ করে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের দেওয়া Guide Line মোতাবেক যথাশিগগির সঠিক ব্যবস্থা গ্রহণপূর্বক ভালো করা যাবে এবং অধিক আক্রান্ত রোগীকে দ্রুত Refferal হাসপাতালে পাঠিয়ে সঠিক চিকিৎসা প্রদান করে মৃত্যুহার কমানো যাবে। এভাবে একসময় করোনা মৃত্যুহার এবং ব্যক্তি থেকে ব্যক্তিতে করোনা বিস্তার নিয়ন্ত্রণে আসবে বলে আমি মনে করি।

চ. করোনা বিস্তার রোধে ‘আক্রান্ত ব্যক্তি অন্যদের থেকে পৃথক হয়ে থাকা, সবার মাস্ক পরিধান করা, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা’ প্রভৃতি স্বাস্থ্যবিধিগুলো মানতে জনগণকে যেকোনো উপায়ে বাধ্য করা। এ বিষয়ে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কর্তৃক গৃহীত পদক্ষেপের পাশাপাশি বিশেষ করে জুমার নামাজের সময় ইমামদের সাহায্যে অত্যাবশ্যকীয়ভাবে বয়ান দিয়ে মুসল্লিদের মাঝে করোনা সংক্রমণ এড়ানো বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি করা।

বর্তমান বিশ্বে করোনা নিয়ন্ত্রণে দক্ষিণ কোরিয়া সবচেয়ে বেশি সফল দেশ। দক্ষিণ কোরিয়ায় করোনা সংক্রমণ প্রথম নিরূপিত হয় ২০ জানুয়ারি, ২০২০। ২৭ জানুয়ারি কোরিয়া ডিজিস কন্ট্রোল ও প্রিভেনশন সেন্টার (KCDC) কর্তৃক সে দেশের বিশেষজ্ঞ চিকিত্সক, ওষুধ কম্পানির নির্বাহী অফিসাররা এবং অন্যান্য সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ের বিশেষজ্ঞদের একত্র করে করোনা মোকাবেলায় প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি ও Road Map প্রস্তুতে সহযোগিতা কামনা করা হয়। ফলে তারা করোনা যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার প্রয়োজনীয় সামগ্রী, যেমন—সবার জন্য ব্যক্তিগত সুরক্ষা সামগ্রী, টেস্ট কিট, দ্রুত রোগ নিরূপণের অন্যান্য দ্রব্য এবং প্রয়োজনীয় ওষুধ অন্যান্য চিকিত্সাসামগ্রী প্রস্তুত করা শুরু করে। টেস্ট কিট প্রস্তুতে প্রায় ৩০টি কম্পানিকে সরকারি লাইসেন্স প্রদান করা হয়, যারা নিজ দেশের চাহিদা পূরণ করে ১২০টি দেশে তা রপ্তানি করছে।

করোনা সংক্রমণ প্রাবল্য বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সব নাগরিক মাস্ক ব্যবহার এবং সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার ওপর অতিশয় প্রাধান্য দিতে শুরু করে। টেস্ট কিট দিয়ে রোগ নিরূপণ করাকে বেশি অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। করোনা শনাক্তকরণে সন্দেহভাজন জনসাধারণকে এক জায়গায় একত্র না করে Drive Through ও Walk Through পদ্ধতিতে রাস্তাঘাট, দোকানপাট, বসতবাড়ি, অফিস-আদালত সর্বত্র মানুষের করোনা পরীক্ষা করে রোগ নিরূপণ করা হয়। এর ফলে সর্বোচ্চ ১০ মিনিটেই প্রতিটি রোগীর রোগ শনাক্তকরণ সম্ভব হয়।

এভাবে প্রায় তিন সপ্তাহে দুই লাখ ৭০ হাজার জনের করোনা পরীক্ষা করে ১০ হাজার ৭২৮ জন রোগী শনাক্ত করা হয়। আক্রান্ত রোগীদেরকে পৃথক থাকার জন্য উদ্বুদ্ধ করা হয়। রোগীদেহে রোগ প্রাবল্য নিরূপণে Chest-X-Ray AI Image Support Decision Tool-এর সাহায্যে কয়েক সেকেন্ডেই ফুসফুসের সংক্রমণ অবস্থা নিরূপণ করা হয় এবং আক্রান্ত রোগীদের মৃদু সংক্রমণ, মধ্যম অবস্থা, তীব্র ও অতি তীব্র আক্রান্ত প্রভৃতি শ্রেণিতে বিভক্তপূর্বক তাদের অবস্থা অনুযায়ী প্রয়োজনীয় চিকিত্সাব্যবস্থা গ্রহণ করে ৮,৭১৭ (৮১%) রোগীকে রোগমুক্ত করা হয় এবং ২৪২ (২.৩%) কভিড-১৯ রোগী মারা যায়। যখন (২৬ এপ্রিল ২০২০) যুক্তরাষ্ট্রে অন্তত ৫০ হাজার এবং স্পেন, ইতালি, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্যে ২০ হাজারের অধিক মানুষ কভিড-১৯-এ আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করে (Worldometer 2020)। এভাবে সে দেশে সার্বিক জীবনযাত্রা সচল রেখে কোনো প্রকার লকডাউন না দিয়ে জনগণ সঠিক নিয়মানুবর্তিতা চর্চা করেই প্রায় তিন সপ্তাহের মধ্যে পাঁচ কোটি জনসংখ্যা অধ্যুষিত দক্ষিণ কোরিয়া করোনাকে নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়।

করোনা নিয়ন্ত্রণ একটি ভয়ংকর যুদ্ধ, যাতে এ দেশের সব মানুষের অংশগ্রহণ অত্যাবশ্যক। করোনা যুদ্ধেও আমাদের সবাইকে অংশগ্রহণ করে বিজয়ী হতে হবে।

লেখক : জেনারেল সেক্রেটারি-RIAF Bangladesh Chapter
:কালের কণ্ঠ

Scroll to Top