এমপি দুর্জয় এখন পাওয়ার প্লান্টের মালিক, গলার কাঁটা \”পাপিয়াকান্ড\”

স্ত্রীসহ চাকরির আয়ে জীবিকা চলত। দুর্জয় ছিলেন একজন ক্রিকেটার। এমপি হওয়ার পর অদৃশ্য জাদুর ছোঁয়ায় সেই নাঈমুর রহমান দুর্জয়ের হাতে চলে আসে আলাদীনের চেরাগ। রাতারাতি গড়ে ওঠে অঢেল সম্পদ আর প্রাচুর্য। এমনকি পাওয়ার প্লান্টের মালিকও হয়েছেন তিনি। দেশ-বিদেশে হরদম যাতায়াত চলে তার। মালয়েশিয়ায় গড়ে তুলেছেন নানা রকম ব্যবসা- বাণিজ্য। এসব নিয়ে দুর্জয়ের নির্বাচনী এলাকায় আলোচনা-সমালোচনা মানুষের মুখে মুখে। তাকে ঘিরে বিতর্ক সৃষ্টির আরেকটি কারণ হচ্ছে, পাপিয়াকান্ডে তার নাম উঠে আসা।

মানিকগঞ্জ-১ আসনের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর থেকেই নাঈমুর রহমান দুর্জয় তার নির্বাচনী এলাকাকেও ব্যবসা কেন্দ্রে পরিণত করেছেন। থানা, ইউনিয়ন, ওয়ার্ড কমিটি গঠন, পদ প্রদান, পদ থেকে হটিয়ে দেওয়া, সবকিছুর পেছনেই বাণিজ্য করার এন্তার অভিযোগ রয়েছে। এ বাণিজ্যিক সুবিধা প্রদানে ব্যর্থ হওয়ায় আওয়ামী লীগের ত্যাগী নেতা-কর্মীদের দল থেকে হটিয়ে দেওয়া হয়েছে। সর্বত্রই এমপির পকেট কমিটি গঠিত হয়েছে। তাদের মাধ্যমেই চলছে ঘিওর, দৌলতপুর ও শিবালয় উপজেলার যাবতীয় কর্মকান্ড।

এলাকার যাবতীয় ঠিকাদারি, সব ধরনের নিয়োগ, বালুমহাল জবরদখল, সরকারি খাস জমি ও খাল-নালা ভরাট করে পজেশন আকারে কেনাবেচা, নদ-নদীতে অবৈধভাবে ড্রেজিংসহ বেপরোয়া মাটি বাণিজ্যের সবকিছুই এককভাবে নিয়ন্ত্রণ করছেন দুর্জয়। এ ছাড়া আরিচা ও পাটুরিয়াঘাটে ঝুঁকিপূর্ণ স্পিডবোটের অবৈধ বাণিজ্যও গড়ে তুলেছেন তিনি। দলের নিজস্ব ক্যাডার ও আস্থাভাজন নেতা-কর্মীদের মাধ্যমেই তার প্রতিটি ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালিত হচ্ছে। ফলে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগের নেতারা এখন এমপির ব্যবসা কেন্দ্রের ম্যানেজার, ক্যাশিয়ার, সুপারভাইজার হিসেবেই বেশি পরিচিত হয়ে উঠেছেন।

দলীয় কর্মকান্ডে তৎপরতা না থাকলেও ব্যবসায়িক কাজের ছোটাছুটিতে ঘাম ঝরে তাদের। দুর্জয়ের এসব কর্মকান্ড নিয়ে অনেক দিন ধরেই দলের ভিতরে-বাইরে নানা বিতর্ক, নানা সমালোচনা চলছে। সৃষ্টি হয়েছে চরম অসন্তোষের। কিন্তু কোনো কিছুতে বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ নেই তার। অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন, স্বামী-স্ত্রী উভয়ের চাকরির আয়ে জীবন চালানো দুর্জয় হঠাৎ কীভাবে পাওয়ার প্লান্টের মালিক হলেন? কোথায় পেলেন এত টাকা? তিন উপজেলার সব ধরনের ঠিকাদারি তার নিয়ন্ত্রিত। দল-উপদলের নেতাদের খুশি না করে ঠিকাদারি করার দুঃসাহস রাখেন না কেউ। হাটবাজার ইজারা নেওয়া, খেয়াঘাট বরাদ্দ পাওয়া, খাসজমি ইজারা দেওয়া থেকে শুরু করে ব্রিক ফিল্ডে মাটি সাপ্লাই দেওয়ার ক্ষেত্রেও নির্ধারিত চাঁদা পরিশোধ করেই পা ফেলতে হয়। মাটি খননের নিষিদ্ধ এসকেবিউটর ভেকু মেশিন চলে শতাধিক। হাজার হাজার একর ফসলি জমি মুহূর্তেই ধ্বংস করে রাত-দিন মাটি সরবরাহ দেওয়া হচ্ছে। হাই কোর্টের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও ড্রেজিং চলছে অবিরাম। স্পিডবোট চলছে কাজীরহাট রুটে চরম ঝুঁকি নিয়ে। এসব ক্ষেত্রে কেবল এমপির নির্দেশনাকে পুঁজি করেই সবকিছু পরিচালিত হচ্ছে, আইন-কানুনের তোয়াক্কা করা হচ্ছে না।

সংসদীয় এলাকার তিন উপজেলায় টিআর, কাবিখা ও সোলার প্যানেল বরাদ্দে অনিয়ম-দুর্নীতির শেষ নেই। চলমান করোনা দুর্যোগ মোকাবিলায় সরকারের বরাদ্দ ত্রাণ ও নগদ টাকা বিতরণ নিয়েও রয়েছে অন্তহীন অভিযোগ। ৮/১০টি গ্রাম ও পাড়া ঘুরেও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ঘরে ত্রাণের একমুঠো চাল পৌঁছানোর নজির মেলেনি। এলাকায় আছেন এমপির তিন ‘খলিফা’। যারা প্রতিটি বরাদ্দ থেকে পার্সেন্টেজ আদায় করেন। তারা টাকা ছাড়া কোনো কাজ করেন না।

নিয়োগ বাণিজ্য ও উন্নয়ন প্রকল্পের নামে লাখ লাখ টাকা তিন খলিফার হাত ঘুরে চলে যাচ্ছে এমপি পরিবারে। এলাকার প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতারা বলেন, সংসদ সদস্য নাঈমুর রহমান দুর্জয়ের পরিবারের সদস্যরাই গিলে খাচ্ছেন সবকিছু। এমপির চাচা জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক তায়েবুর রহমান টিপু, চাচাতো ভাই জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি মাহবুবুর রহমান জনি ও ছাত্রলীগ নেতা আব্বাসসহ কয়েকজনের হাতেই বন্দী এই নির্বাচনী এলাকার উন্নয়ন, দখলবাজি, খবরদারিত্ব। তাদের দাপুটে প্রভাব ও স্বেচ্ছাচারিতার কাছে পুরনো আওয়ামী লীগ নেতারা কোণঠাসা হয়ে আছেন। টুঁ শব্দটি পর্যন্ত করতে পারেন না কেউ।

দীর্ঘ সময়ের পোড় খাওয়া জেলা আওয়ামী লীগের নেতারা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, কয়েক বছর আগেও মানিকগঞ্জ-১ আসনভুক্ত ঘিওর, দৌলতপুর ও শিবালয় উপজেলায় শক্ত দলীয় অবস্থান ছিল। নেতা-কর্মীদের মধ্যে চমৎকার বোঝাপড়াও ছিল। তখন পর্যন্ত ছাত্রলীগ-যুবলীগ নেতাদের মধ্যে অপরাধের ছায়া ছিল না। অথচ সেই নেতা-কর্মীদের নামে এখন চাঁদাবাজি, দখলবাজি, বখরাবাজি, সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের দেদার অভিযোগ উঠছে।

দুর্জয়ের ক্যাডারদের ভয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ত্যাগী আওয়ামী লীগ নেতারা বলেন, দলের প্রবীণ ও ত্যাগী নেতা-কর্মীদের সরিয়ে দিয়ে বিএনপি-জামায়াত নেতাদের গুরুত্বপূর্ণ সব পদে বসানো হয়েছে। তারাই এখন চাঁদাবাজি, দখলবাজি, লুটপাট, সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে তার সব দায় আওয়ামী পরিবারের বর্তমান প্রজন্মের ওপর চাপাচ্ছে। অনুপ্রবেশকারীরাই আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের একের পর এক মামলা, হামলা, হয়রানি-নির্যাতনের মাধ্যমে এলাকাছাড়া করে রাখছে। অরাজনৈতিক জনপ্রতিনিধি, উড়ে এসে জুড়ে বসে দলের কান্ডারি সেজে ভিআইপিরা আওয়ামী লীগের অস্তিত্ব নিশ্চিহ্ন করার পাঁয়তারায় লিপ্ত।

দুর্জয়ের গলার কাঁটা ‘পাপিয়াকান্ড’ : দুর্জয় এমপির নামের সঙ্গে ‘পাপিয়াকান্ড’ জড়িয়ে থাকার বিষয়টি তার জন্য এখন গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। নানাভাবে চেষ্টা করেও এমপি ও তার ঘনিষ্ঠজনরা দুর্জয়ের নাম থেকে পাপিয়াকে হটিয়ে দিতে পারছেন না, বরং যৌথ নামটি রীতিমতো স্থায়িত্ব পেতে বসেছে। পাপিয়াকান্ডের কয়েক মাস অতিবাহিত হয়েছে। এর মধ্যেই শুরু হয়েছে করোনার মহাদুর্যোগ। তার পরও মানিকগঞ্জবাসীর মুখে মুখে ছড়িয়ে আছে দুর্জয়-পাপিয়ার নানা মুখরোচক কাহিনী। তবে এমপি দুর্জয়ের সঙ্গে পাপিয়ার নাম যুক্ত করে কেউ কিছু মন্তব্য করলেই তার আর রেহাই নেই। ফেসবুকে উভয়ের ছবি পোস্ট করলেই তার বিরুদ্ধে মামলা রুজু ও জেলহাজতে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হচ্ছে। তবুও পাপিয়াকান্ডের প্রচারণা থেকে কোনোভাবেই রেহাই পাচ্ছেন না দুর্জয়।

Scroll to Top