পৃথিবীতে বেঁচে থাকার জন্য সবচেয়ে প্রয়োজনীয় জিনিস হলো অক্সিজেন। বাতাসের ক্ষুদ্র এক অদৃশ্য কণা, মাত্র ২১% যার হিস্যা, কিন্তু এটাই জীবনের মূল চালিকাশক্তি। নিঃশ্বাসের সাথে অক্সিজেন প্রবেশ করে তা রক্তের হিমোগ্লোবিনের সাথে যুক্ত হয়ে ছড়িয়ে পরে সারা দেহে, দহন হয়, তৈরী করে শক্তি। বিনিময়ে ফেরত নিয়ে আসে কার্বন-ডাই-অক্সাইড যা দূষিত বাতাস নামে পরিচিত। শ্বাসনালীর নানারকম রোগে রক্তে এই অক্সিজেনের ঘাটতি দেখা যায়।
রক্তে অক্সিজেনের স্বাভাবিক শতকরা হার (যা সুস্থ মানুষের ক্ষেত্রে ৯৬-১০০%) কমে গেলে বাইরে থেকে অক্সিজেন সাপ্লাই দেয়ার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। যারা দীর্ঘদিন ধরে ধূমপান করেন বা যারা হাঁপানি রোগী, তাদের শরীরের সহ্যক্ষমতা একটু বেশি। তবুও শতকরা হার ৯০-৯২ এ নেমে গেলে তাদেরও অক্সিজেন দেয়ার প্রয়োজন হয়। ঘরে বসে রক্তে অক্সিজেনের শতকরা হার পরিমাপের উপায় হলো PULSE OXYMETER (পালস অক্সিমিটার), যেটি ক্ষুদ্র, ব্যাটারি চালিত ও সহজে বহনযোগ্য।
পৃথিবীজুড়ে সোমবার পর্যন্ত করোনা আক্রান্ত হয়েছেন ৬৮,৯১,২১৩ জন এবং মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছেন ৩,৯৯,৭০৫ জন। মৃত্যুমুখে পতিত হওয়া সবার এবং সুস্থ হয়ে ওঠা বেশিরভাগ মানুষেরই বিভীষিকা ছিল অক্সিজেন স্বল্পতা। সময়মতো একটু অক্সিজেন সরবরাহ করা গেলেই হয়তো অনেকে বেঁচে যেতেন, বিশেষ করে তারা, যাদের চিকিৎসা করার কোনো সুযোগই পাওয়া যায়নি।
এখন প্রশ্ন হলো, অক্সিজেন কোথায় পাবো। প্রথমত: হাসপাতালে সিলিন্ডার বা পাইপলাইনে অক্সিজেন সরবরাহ করা হয়। বড় বড় হাসপাতালে অক্সিজেন এর সেন্ট্রাল ইউনিট থাকে, যেখান থেকে পাইপে করে বিভিন্ন ওয়ার্ডে সরবরাহ করা হয়। ছোট হাসপাতাল/ ক্লিনিকগুলো সিলিন্ডার ব্যবহার করে, যা ফুরিয়ে গেলে ডিপোতে পাঠাতে হয়, রিফিল করতে। ডিপো আবার অক্সিজেন প্রস্তুতকারী কম্পানি হতে ভরা সিলিন্ডার নিয়ে আসে। সারা দেশে অক্সিজেন প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান হাতে গোনা কয়েকটি মাত্র, যা বতর্মান প্রেক্ষাপটে নিতান্তই অপ্রতুল।
দ্বিতীয়ত: কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান এই দুঃসময়ে অক্সিজেন সিলিন্ডার বিক্রি বা ভাড়া দিয়ে এই জাতীয় রোগীদের সেবা দিচ্ছেন, তবে সেটিও এখন সোনার হরিণ। কারণ সিলিন্ডার স্বল্পতা এবং চাহিদার তুলনায় সরবরাহ নিতান্তই কম। একটি স্ট্যান্ডার্ড টাইপ E পোর্টেবল মেডিকেল সিলিন্ডার প্রতি মিনিটে ২ লিটার করে অক্সিজেন সরবরাহ করলে সর্বোচ্চ ৮ ঘণ্টা তা ব্যবহার করতে পারবেন। এরপর? সিলিন্ডারতো অনেক কাটখড় পুড়িয়ে জোগার করেছিলেন !! এবার আবার দৌড়াদৌড়ি। ভারী সিলিন্ডার কাঁধে করে পুনরায় দোকানে যান, রিফিল করে নিয়ে আসুন !!
আজ থেকে ১০ বছর আগে এই একই ঝক্কি সামলাতে হয়েছিল আমাকে। আমার বাবা যিনি নিজেই একজন ফুসফুস এর রোগের বিখ্যাত ডাক্তার ছিলেন, তাঁর নিজেরই ধরা পড়লো Interstitial Lung Disease। মূল চিকিৎসা নিরবিচ্ছিন্ন অক্সিজেন সরবরাহ, যতদিন বেঁচে থাকবেন, ততোদিন। প্রথম দিকে প্রতিদিন বাসের ছাদে উঠিয়ে নাটোর থেকে রাজশাহী বা বগুড়া পাঠাতাম রিফিলের জন্য। পরে সংগ্রহ করলাম একটি OXYGEN GENERATOR (অক্সিজেন জেনারেটর)। এটি এমনই একটি সহজে বহনযোগ্য মেশিন যা সাধারণ বাতাসকে টেনে নিয়ে ফিল্টার করে শ্বাস নেয়ার জন্য যে অক্সিজেন প্রয়োজন সেটাকে আলাদা করে প্রতি মিনিটে ১-৭ লিটার হারে সরবরাহ করে, প্রতিদিন, ২৪ ঘণ্টাই। তিনি মৃত্যুর আগে পর্যন্ত প্রায় ২ বছর মেশিনটি ব্যবহার করেছিলেন। দিনে দিনে OXYGEN GENERATOR মেশিনের আরো উন্নতি সাধন হয়েছে, আকার ও ওজনে ছোট হয়েছে।
যারা একটু সচেতন, যাদের বাসায় বয়স্ক মানুষ/ হাঁপানী/ আইএলডি এর রোগী আছে, যারা কোভিড সংক্রমণের ঝুঁকিতে আছেন, অনেক ছোট-খাট মেডিকেল সেন্টার যারা সাময়িক ভাবে চিকিৎসা সহায়তা প্রদান করে রোগীকে হাসপাতালে প্রেরণ করেন অথবা প্রত্যন্ত অঞ্চলের হাসপাতালগুলি যেখানে জরুরী প্রয়োজনে সিলিন্ডার সংগ্রহ বা রিফিলের কোনো সুযোগই নেই, তারা এটি ব্যবহার করতে পারেন।
যাদের জ্বর ভাব, সর্দি/কাশি, গলা ব্যথা উপসর্গ এরমধ্যেই দেখা দিয়েছে, কোভিড টেস্ট করে পজিটিভ রিপোর্ট পেয়েছেন অথবা হয়তো টেস্ট করার ব্যবস্থাও করতে পারেননি, তাদের এলার্ট থাকতে হবে। কিছুক্ষণ পরপর পালস অক্সিমিটার দিয়ে নিজের অক্সিজেন লেভেল পরিমাপ করতে হবে। যদি দেখেন রক্তে অক্সিজেনের শতকরা হার ৯৪ এর নীচে নেমে যাচ্ছে, ভয় না পেয়ে উপুর হয়ে শুয়ে পড়ুন, বুক ভরে ভরে শ্বাস নিন। দেখবেন আস্তে আস্তে অক্সিজেন মাত্রা উপরে উঠতে শুরু করেছে। যদি না বারে অথবা যদি কমতে থাকে, তবে অক্সিজেন জেনারেটর মেশিনটি অন করে এর সাথে সরবরাহকৃত মাস্ক মুখে সেট করে জেনারেটরে ৩-৪ লিটার অক্সিজেন সরবরাহ সিলেক্ট করে শ্বাস নিতে থাকুন। ধীরে ধীরে আপনার শ্বাসের কষ্ট কমতে থাকবে। এখন আপনার পরিচিত চিকিৎসক এর সাথে যোগাযোগ করুন অথবা হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নেয়া শুরু করুন।
মনে রাখতে হবে, একটি পালস অক্সিমিটার ও একটি অক্সিজেন জেনারেটর মেশিন রক্ষা করতে পারে শত শত জীবন। আসুন, আমরা সকলে সচেতন হই, করোনা আতংকে না ভুগে সঠিকভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলে করোনাকে প্রতিহত করি।
লেখক
ডা. শান্তনু কুমার ঘোষ
সহকারী অধ্যাপক, ভাসকুলার সার্জারি
জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট