লকডাউন নিয়ে উভয়সংকটে সরকার

করোনা পরিস্থিতি ক্রমেই জটিল আকার ধারণ করছে। মানুষ বিভিন্নভাবে সান্ত্বনা পাওয়ার চেষ্টা করছে। কখনো বলা হচ্ছে বয়স্করা বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন এবং মারা যাচ্ছেন। আবার বলা হচ্ছে উষ্ণ ও আর্দ্র আবহাওয়ায় করোনাভাইরাস খুব বেশি সক্রিয় থাকে না। বিভিন্ন তথ্য, নানা গবেষণা, নানা গুজবে মানুষ দিশেহারা হওয়ার জোগাড়। গভীর রাতে হবিগঞ্জে কেয়ামত দেখতে বেরিয়েও পড়েছিল অনেকে। কেউ কেউ থানকুনিপাতা চিবাচ্ছে। আধুনিক বিজ্ঞান থেকে ঝাড়ফুঁক-তুকতাক সবই চলছে। অনেকে অদৃষ্টবাদের দিকে ঝুঁকে পড়ছে। রাষ্ট্র যখন নাগরিকদের রক্ষার সুপরিকল্পনা দিতে ব্যর্থ হয়, যখন জনমনে রাষ্ট্রের সদিচ্ছা নিয়ে সন্দেহ থাকে, তখন নিয়তিবাদী হয়ে পড়ে মানুষ। সমাজে নানা গুজবও ছড়িয়ে পড়ে।

সরকার কোনো পরিস্থিতি সামাল দিতে ব্যর্থ হলে রাষ্ট্রের নাগরিক থেকে প্রশাসন যন্ত্র, সবাই অস্বাভাবিক আচরণ করা শুরু করে। কেয়ামত দেখতে বের হওয়া, রাস্তায় প্রকাশ্যে বয়োজ্যেষ্ঠ নাগরিকদের কান ধরিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখা, ছবি তোলা সেই অস্বাভাবিক আচরণেরই প্রতিফলন। করোনার সামগ্রিক পরিস্থিতিতে প্রশ্ন জাগে, দেশে কি লকডাউন ঘোষণা করা হয়েছে? বিভিন্ন জায়গায় ঘর থেকে বের হওয়া লোকজনকে লাঠিপেটা করা হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। যশোরের মনিরামপুর উপজেলার চিনেটোলা বাজারে তিন বৃদ্ধের কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকার ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম সয়লাব। প্রশ্ন হচ্ছে, ভ্রাম্যমাণ আদালতের এই এখতিয়ার আছে কি না? সরকারের তরফ থেকে মাস্ক ব্যবহারের কোনো বাধ্যবাধকতা জারি করা হয়েছে কি না। দেশের নাগরিকদের হেনস্তা করার অধিকার ভ্রাম্যমাণ আদালতের নেই। ব্যাপক প্রতিবাদের কারণে এখন ওই সরকারি কর্মকর্তাকে বদলি করা হয়েছে।

বিভিন্ন স্থানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কর্তৃক হেনস্তার শিকার বেশির ভাগই প্রান্তিক জনগোষ্ঠী। একদল নাগরিক আবার এই হেনস্তাকে সমর্থনও করছে। কিন্তু সাধারণ মানুষ কেন এই দুর্যোগের মধ্যেও বের হচ্ছে? করোনা ছড়ানোর শঙ্কা সত্ত্বেও কেন রাজধানী ছাড়ল ১ কোটি ১০ লাখ মানুষ? যাঁরা ভাবছেন, করোনার ভয়ে মানুষ সারা দিন ঘরে বসে থাকবে, তাঁরা সম্ভবত কল্পনার জগতে অবস্থান করছেন। আপনি সরকারি–বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। বাসায় সুন্দর চেয়ার–টেবিল সাজিয়ে ঘরে বসে অফিস করার সেলফি দিচ্ছেন।

এই সেলফি দেখে মুটে–মজুরের পেট ভরে না। তারা ঘর থেকে বের হয়। এরা বাজারে যায়। এরা কাজের খোঁজে বিভিন্ন জায়গায় যায়। এরা রিকশা চালায়। এরা আপনার বাসাবাড়িতে কাজ করে। কাজ না থাকলে এদের খাবার জোটে না। এরাই ঘর থেকে বের হতে বাধ্য হচ্ছে। ঢাকা ছাড়তে চায় বাধ্য হয়ে। কারণ, মাস শেষেই এদের ভাড়া গুনতে হয়।

এই নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত রাষ্ট্রের কৌশলী আচরণের ফাঁদে পড়েছে। সারা দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করা হয়েছে। অফিস–আদালতও বন্ধ। ঘরে থাকার জন্য বলা হয়েছে। রাজধানীতে বিভিন্ন স্থানে ওয়ার্ড কমিশনারের নামে মাইকিং করে ঘরে অবস্থান করতে বলা হচ্ছে। কিন্তু সরকারিভাবে লকডাউনের ঘোষণা আসেনি। কারণ, লকডাউন করলে নাগরিকদের দায়দায়িত্ব নেওয়ার প্রশ্ন আসে। জার্মানির দুটি রাজ্যে লকডাউন করা হয়েছে। ইতালি ও ফ্রান্সে অনেক আগেই লকডাউন করা হয়েছে। এসব দেশে রাষ্ট্রের তরফে বলা হয়েছে, বাসাভাড়া, বিদ্যুৎ বিল, গ্যাস বিল, সব মওকুফ করা হবে। প্রয়োজনে খাবার সরবরাহ করা হবে। জার্মানিতে ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের সরাসরি আর্থিক সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। হোটেল, রেস্টুরেন্ট, কারখানা বন্ধ রাখলে শ্রমিকদের বেতন সরকার দিয়ে দিচ্ছে।

দেশে কি এভাবে নাগরিকদের দায়দায়িত্ব নেওয়া সম্ভব? আমাদের সেই সাধ্য নেই। বিদ্যুৎ, গ্যাস বিল দেওয়ার তারিখ পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে। মওকুফ করা হয়নি। দুর্নীতি, হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার, অতিরিক্ত রাষ্ট্রীয় ব্যয় আমাদের অর্থনীতিতে দুর্বল করে দিয়েছে। উন্নয়নের নানা বুলি শোনানো হয় বটে, কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। বলা হয়ে থাকে, টাকার সংকটে আছে সরকার। তাই আমাদের পক্ষে কয়েক মাস বসিয়ে খাওয়ানো সম্ভব না। সরকারের তরফে স্বল্পমূল্যে খাবার সরবরাহ করলেও ঝামেলা আছে। বাজার থেকে অতিরিক্ত মূল্যে কিনে দরিদ্রদের মধ্যে সরবরাহ করতে হবে। নতুবা ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট খেপে উঠবে। এমনিতেই পণ্যের মূল্য বেড়েছে। বাজারের ওপর সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ আছে বলে দেখা যায় না। একদিকে শহরে জিনিসের দাম বেড়েছে, অন্যদিকে গ্রামে কৃষকেরা ফসলের দামই পাচ্ছে না। আর্থিক সংকট ও মুনাফাভোগী সিন্ডিকেটের কারণে সরকারের পক্ষে সিদ্ধান্ত নেওয়া সহজ হচ্ছে না। এ কারণেই সরকার লকডাউনও ঘোষণা করছে না। আবার ঘর থেকে বের হতেও দিচ্ছে না। লকডাউন করে ঘরে রাখলে সহায়তা দিতে হবে। বের হতে দিলে বিপদ হচ্ছে করোনা ছড়াতে পারে। তাই অঘোষিত লকডাউন চলছে। এতে দায়িত্বও নিতে হচ্ছে না। আবার লোকজনকে ঘরে আটকে রাখা হচ্ছে কিছুটা ভয় দেখিয়ে। চাপ দিয়ে।

পাশের দেশ ভারত লকডাউন করেছে। পশ্চিমবঙ্গে দরিদ্রদের স্বল্পমূল্যে চাল দেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। আর আমাদের দেশে পোশাকশিল্পের জন্য পাঁচ হাজার কোটি টাকা সহায়তা দেওয়া হবে। এই অর্থ শ্রমিকদের হাতে কতটা যাবে, তা নিয়ে অনেকের মধ্যে সংশয় আছে। দেশের মানুষও এও মনে করে, করোনা শনাক্তকরণে সরকার যথাযথ দায়িত্ব পালন করতে পারছে না। অনেক আগ্রহী ব্যক্তি যোগাযোগ করেও করোনা পরীক্ষা করাতে পারছেন না। সম্প্রতি একজন তিন দিন ঘুরেও পরীক্ষা করাতে পারেননি। তার হয়তো করোনা হয়নি। কিন্তু বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পক্ষ থেকে বারবার বলা হচ্ছে, পরীক্ষার কোনো বিকল্প নেই। যত বেশি পরীক্ষা করা হবে, তত বেশি জনমনে আস্থা তৈরি হবে। দুশ্চিন্তা দূর হবে। শঙ্কা, ভয় থেকে মুক্তি পাবে। কিন্তু রাষ্ট্র নাগরিকদের আশ্বস্ত করতে পারছে না।

শুধু নাগরিকেরাই না, বিদেশিরাও রাষ্ট্রের পদক্ষেপে আস্থা রাখতে পারছে না। বিদেশিরা ঢাকা ছাড়তে শুরু করেছে। বিদেশিরা কেন ঢাকা ছাড়ছে? তাদের নিজদের দেশে আক্রান্ত ও মৃত মানুষের সংখ্যা দুটোই অনেক বেশি। এরপরও বিদেশিরা ঢাকাকে নিরাপদ মনে করছে না। দেশের মানুষকে নাহয় লাঠি মেরে, কান ধরিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। কিন্তু বিদেশিদের দেশ ত্যাগ ভিন্ন বার্তা দিচ্ছে দেশের নাগরিকদের।

যেকোনো দুর্যোগ মোকাবিলায় লাঠিপেটা বা চাপ নয়, জনসাধারণকে সঙ্গে নিয়েই এই পথ পাড়ি দিতে হয়। আশার কথা, দেশে করোনা এখনো তেমন আঘাত হানতে পারেনি। রাষ্ট্রকে অতিমাত্রায় কৌশলী না হয়ে জনবান্ধব হতে হবে। নিজের সামর্থ্য নিয়ে রাখঢাক না করে সবাইকে নিয়ে এই মহাদুর্যোগ মোকাবিলায় সাহসী উদ্যোগ নিতে হবে। প্রয়োজনে দেশের নাগরিকেরা একবেলা, আধবেলা খাবে। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত দেশকে আগলে রাখবে। তবে এর জন্য রাষ্ট্রকে নাগরিকের বন্ধু হতে হবে। লাঠিপেটা করে, কান ধরে ওঠাবসা করিয়ে দুর্যোগ মোকাবিলা কঠিন হবে।

ড. মারুফ মল্লিক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক

সূত্রঃ প্রথম আলো

Scroll to Top