রোহিঙ্গা গণহত্যা ইতিহাসের হৃদয়বিদায়ক গণহত্যা। আদালতে হাজির সু চি। রোহিঙ্গা গণহত্যার বিচার। আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে শুনানির প্রথম দিনে গাম্বিয়ার আরজি। বিশ্ব বিবেকের কালিমা মোচনে আর দেরি নয়। আজ মিয়ানমার বক্তব্য দেবে। কাল গাম্বিয়ার বক্তব্য ও মিয়ানমারের জবাব। চার থেকে ছয় সপ্তাহের মধ্যে আদালত সিদ্ধান্ত দিতে পারেন।
বিশ্ব শান্তির জন্য পুরস্কারজয়ী অং সান সু চি গণহত্যার অভিযোগে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (আইসিজে) ১৭ জন বিচারপতির সামনে হাজির হয়েছেন, এমন দৃশ্য অভাবনীয় হলেও গতকাল মঙ্গলবার তা-ই ঘটেছে। তাঁর থেকে হাত দুয়েকের কম দূরে অভিযোগকারী আফ্রিকার দেশ গাম্বিয়ার আইনমন্ত্রী আবুবকর মারি তামবাদু মানবতাবিরোধী নৃশংসতার অভিযোগগুলোর সারাংশ তুলে ধরেন। তিনি বলেন, বিশ্ববিবেকের কালিমা মোচনে আর দেরি করা চলে না।
দার্শনিক এডমন্ড বার্কের বক্তব্য ‘দুষ্টের জয়ী হওয়ার জন্য একমাত্র যা প্রয়োজন, তা হচ্ছে ভালো মানুষদের কিছু না করা’ উদ্ধৃত করে তামবাদু বলেন, বিশ্ব দীর্ঘদিন নীরব দর্শক হয়ে থাকায় এমনটি ঘটেছে। গণহত্যা রাতারাতি ঘটে না, তার জন্য যুগ যুগ ধরে ঘৃণা আর বিদ্বেষ লালন করা হয়। একটি জাতিগোষ্ঠীকে মানবেতর প্রাণীতে পরিণত করার প্রক্রিয়া মিয়ানমার অনেক দিন ধরে অনুসরণ করে এসেছে। তিনি বলেন, ‘আদালতে আমি যখন বক্তব্য দিচ্ছি, তখনো গণহত্যার ধারা চলছে।’
আইসিজেতে আসার কারণ ব্যাখ্যা করে তামবাদু বলেন, একমাত্র এই আদালতই শান্তি পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে পারে, আশা জাগাতে পারে। আন্তর্জাতিক বিচারব্যবস্থাকে অবশ্যই কার্যকর করতে হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমরা চাই আইসিজে মিয়ানমারকে বলুক যে এখনই রোহিঙ্গা শিশুদের হত্যা বন্ধ করতে হবে, নৃশংসতার অবসান ঘটাতে হবে।’
গতকাল মঙ্গলবার স্থানীয় সময় সকাল ১০টায় আদালতের প্রেসিডেন্ট বিচারপতি আবদুলকোয়াই আহমেদ ইউসুফসহ ১৫ জন বিচারপতি এবং দুই বিরোধীয় রাষ্ট্রের মনোনীত দুজন অ্যাডহক বিচারপতি আসন গ্রহণ করেন। প্রেসিডেন্ট ইউসুফ শুরুতেই গাম্বিয়ার অন্তর্বর্তী আদেশের আরজির দ্রুত শুনানির কারণ ব্যাখ্যা করে বলেন, আইসিজে স্ট্যাটিউট বা বিধিমালায় বলা আছে, অন্তর্বর্তী আদেশের আরজি অগ্রাধিকার পাবে এবং তাই অন্যান্য মামলার আগেই এটির শুনানি হচ্ছে। শুনানির প্রস্তুতির জন্য প্রয়োজনীয় সময় দিয়েই বর্তমান শুনানির সূচি ঠিক করা হয়েছে। এরপর তিনি শুনানির পদ্ধতি তুলে ধরে অ্যাডহক বিচারপতি হিসেবে গাম্বিয়ার মনোনীত নাভি পিল্লাই এবং মিয়ানমারের মনোনীত ক্লাউস ক্রেবের শপথ গ্রহণের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করান। গাম্বিয়া যে অন্তর্বর্তী পদক্ষেপের নির্দেশনা চেয়েছে, তা পড়ে শোনান রেজিস্ট্রার ফিলিপ গটিয়ে।
কূটনীতিক, রোহিঙ্গা গোষ্ঠী ও মানবাধিকার সংগঠনের প্রতিনিধিদের অনেকেই আদালতকক্ষে উপস্থিত ছিলেন। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রসচিব শহীদুল হক এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এশিয়া প্রশান্ত মহাগরীয় অঞ্চলের দায়িত্বপ্রাপ্ত সচিব মাসুদ বিন মোমেনসহ কয়েকজন কূটনীতিক উপস্থিত এ সময় ছিলেন।
গাম্বিয়ার পক্ষে আদালতে গণহত্যার উদ্দেশ্য, গণহত্যার কার্যক্রম, ধর্ষণ ও যৌন সহিংসতা, গাম্বিয়া এবং মিয়ানমারের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টির পটভূমি, আদালতের এখতিয়ার এবং অন্তর্বর্তী পদক্ষেপ হিসেবে কী কী ব্যবস্থা প্রয়োজন, সেগুলো তুলে ধরেন আরও সাত আইন বিশেষজ্ঞ। তাঁরা হলেন অধ্যাপক পায়াম আখাভান, অ্যান্ড্রু লোয়েন্সটিন, তাফাদজ পাসিপান্দো, আরসালান সুলেমান, অধ্যাপক পিয়ের দ’আরজেন, পল এস রাইখলার এবং অধ্যাপক ফিলিপ স্যান্ডস। তাঁরা আদালতে পরিস্থিতির ভয়াবহতা তুলে ধরে জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা করেন। মূলত জাতিসংঘ মানবাধিকার সংস্থার ইন্দোনেশিয়ার বিশেষজ্ঞ দারুসমানের নেতৃত্বাধীন তথ্যানুসন্ধানী দল এবং মিয়ানমারে জাতিসংঘের স্পেশাল র্যাপোর্টিয়ার ইয়াংহি লি এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থা ও মানবাধিকার গোষ্ঠীর প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে তাঁরা পরিস্থিতির ব্যাখ্যা দেন।
অধ্যাপক স্যান্ডস বলেন, আদালত অন্তর্বর্তী ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেবেন কি না প্রশ্ন সেটা নয়, প্রশ্ন হচ্ছে কী কী সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থা নিতে বলবেন। তিনি আদালতকে স্মরণ করিয়ে দেন যে সার্বিয়ার প্রতি আইসিজের অন্তর্বর্তী আদেশের দুই বছর পর বসনিয়ায় সবচেয়ে নৃশংস সেব্রেনিৎসা গণহত্যা সংঘটিত হয়, যাতে আট হাজার বসনীয় মুসলমানকে হত্যা করা হয়েছিল। কাজেই এখানে আর বিলম্বের সুযোগ নেই। নিকারাগুয়ার ক্ষেত্রে, রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে বিরোধের ক্ষেত্রে , কাতার এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের বিরোধের ক্ষেত্রে আইসিজে অন্তর্বর্তী ব্যবস্থার আদেশ দিয়েছে। তবে মিয়ানমার আন্তর্জাতিক আইন এবং জনমতকে যেভাবে উপেক্ষা করে চলেছে, তাতে সুর্নিদিষ্ট ব্যবস্থা এবং তা প্রতিপালনের বিষয়টি নিশ্চিত করার জন্য সময়সীমা বেঁধে দেওয়া প্রয়োজন। নইলে মৃত্যু, গণহত্যা বন্ধ হবে না।
এর আগে পায়াম আখাভান আদালতকে স্মরণ করিয়ে দেন যে গত সোমবার গণহত্যা সনদের ৭০তম বার্ষিকী ছিল। কিন্তু এই সনদের আলোকে গণহত্যা বন্ধ হয়নি। গণহত্যা সনদের লঙ্ঘন কীভাবে ঘটেছে, তা তুলে ধরে তিনি বলেন, জাতিসংঘ তদন্তকারীরা রোহিঙ্গা জাতিগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ঘৃণা ও বিদ্বেষ ছড়ানোয় রাষ্ট্রীয় ভূমিকার প্রমাণ পেয়েছেন। তদন্তে পাইকারি হারে হত্যাযজ্ঞ পরিচালনার প্রমাণ মিলেছে, যা সনদের লঙ্ঘন। গণহত্যা সনদের একাধিক ধারা ও আইসিজের রায়ে যে ধর্ষণ ও যৌন সহিংসতাকে গণহত্যার মতো অপরাধ গণ্য করা হয়েছে, জাতিসংঘ তদন্তে সে ধরনের অপরাধের বিবরণ তুলে ধরা হয়েছে বলেও তিনি একাধিক বেঁচে যাওয়া ভুক্তভোগীর সাক্ষ্য উদ্ধৃত করেন।
যুক্তরাষ্ট্রের আইনজীবী অ্যান্ড্রু লোয়েনস্টেইন তাঁর যুক্তি তুলে ধরে বলেন, মিয়ানমারের জনমিতিক গঠনে (ডেমোগ্রাফিক) ভারসাম্য পরিবর্তনের চেষ্টা চালানো হয়েছে। সেনাপ্রধান রোহিঙ্গাবিরোধী প্রচারে জড়িত থাকায় তাঁর ফেসবুক ও টুইটার অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দিতে হয়েছিল, যা রাষ্ট্রীয় নীতি ও ভূমিকার প্রমাণ।
যুক্তরাষ্ট্রের আরেক আইনজীবী তাফাদজ পাসিপান্দো আরাকানে এখনো যে ছয় লাখ রোহিঙ্গা আছে তাদের দুর্ভোগ ও ঝুঁকির কথা তুলে ধরেন। মিস পাসিপান্দো সেখানে রোহিঙ্গাদের কাঁটাতারের বেষ্টনীর মধ্যে শিবিরে আটক রাখা, চলাচলের স্বাধীনতা খর্ব করা ও অন্যান্য বিধিনিষেধের কথা যা জাতিসংঘ তদন্তে উঠে এসেছে, সেগুলোর বিবরণ দেন।
মিস পাসিপান্দো বলেন, ধর্ষণের অপরাধ অস্বীকার করতে দেশটির নিজস্ব তদন্ত কমিটির প্রধান বলেছেন, সেনাবাহিনী এবং বৌদ্ধ জনগোষ্ঠীর কেউ নোংরা বাঙালি মেয়েকে ছোঁবে না। ওরা আকর্ষণীয় নয়। ফেসবুকে ‘ফেক রেপ’ নামে যে পেজ খোলা হয়েছে, সেটির নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে স্টেট কাউন্সেলরের দপ্তর। তিনি বলেন, এগুলোতে গণহত্যার উদ্দেশ্যের প্রতিফলন ঘটেছে।
মার্কিন আইনজীবী আরসালান সুলেমান আইসিজের এখতিয়ার বিষয়ে আদালতের বিধিমালার ৪১(১) উদ্ধৃত করেন। বলেন, ইসলামিক সহযোগিতা সংস্থার (ওআইসি) ঢাকা সম্মেলনে যে ঢাকা ঘোষণা গৃহীত হয়, তাতে মিয়ানমারকে গণহত্যার কার্যক্রম বন্ধের আহ্বান জানানো হয়েছিল। গণহত্যার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের জবাবদিহি নিশ্চিতের কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু মিয়ানমার সে দাবি প্রত্যাখ্যান করেছে। গাম্বিয়া ওআইসির ঢাকা সম্মেলনে গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মিয়ানমারের গণহত্যাবিষয়ক মন্ত্রী পর্যায়ের কমিটির সভাপতি হিসেবে বারবার অভিযোগ করার পরও মিয়ানমার নিষ্ক্রিয় থেকেছে। ফলে এই গাম্বিয়া সংক্ষুব্ধ এবং সে কারণেই এই বিরোধ নিষ্পত্তির এখতিয়ার হচ্ছে আইসিজের।
যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী পল এস রাইখলার আদালতের কেন অন্তর্বর্তী পদক্ষেপের নির্দেশনা দেওয়া উচিত, তার যুক্তি তুলে ধরে বলেন, জাতিসংঘের বিভিন্ন তদন্ত ও প্রতিবেদনের তথ্যে দেখা যায় যে বসনিয়ার ক্ষেত্রে যতটুকু তথ্যের ভিত্তিতে আদালত অন্তর্বর্তী নির্দেশনা দিয়েছিলেন, মিয়ানমারের অবস্থা তার চেয়েও খারাপ।
গাম্বিয়া রোহিঙ্গাদের সুরক্ষা ও তাদের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে যেসব অন্তর্বর্তীকালীন পদক্ষেপ নেওয়ার আবেদন জানিয়েছে, তার মধ্যে রয়েছে রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যাসহ সব ধরনের নিপীড়ন বন্ধ রাখা, গণহত্যার কোনো আলামত নষ্ট না করা, জাতিসংঘের তদন্তকারীসহ অন্যদের আরাকানে ধ্বংসপ্রাপ্ত রোহিঙ্গাদের গ্রামগুলোতে অবাধে প্রবেশাধিকার দেওয়া।
অধ্যাপক স্যান্ডস আদালতকে বলেন, গাম্বিয়া দাবি করে যে আদালতের নির্দেশিত অন্তর্বর্তী ব্যবস্থাগুলো মিয়ানমার মানছে কি না, তা আদালতকে জানানোর জন্য চার মাস সময় বেঁধে দেওয়া হোক। কেননা, দেশটি এ পর্যন্ত আন্তর্জাতিক জনমত উপেক্ষা করে এসেছে।
এরপর শুনানি মুলতবি হয় এবং আইসিজের প্রেসিডেন্ট ইউসুফ ঘোষণা করেন, আজ বুধবার মিয়ানমারের বক্তব্য শোনা হবে। বৃহস্পতিবার আদালত বসবেন দুই বেলা। সকালে গাম্বিয়া ও বিকেলে মিয়ানমারের জবাব ও নতুন কোনো যুক্তি থাকলে সেগুলো শোনা হবে। আদালতের রেজিস্ট্রারের দপ্তর থেকে ধারণা দেওয়া হয়, চার থেকে ছয় সপ্তাহের মধ্যে আদালত সিদ্ধান্ত দিতে পারেন।
বিক্ষোভের মুখে সু চি
আদালত থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় সু চি বিক্ষোভের মুখে পড়েন। গণহত্যার জন্য ‘শেইম অন ইউ সু চি’ স্লোগানে মুখর বিক্ষোভকারীদের সামনে দিয়ে তাঁর গাড়ির বহর বেরিয়ে যায়। বিক্ষোভকারীদের অবশ্য পুলিশ আলাদা করে রাখে। মিয়ানমারের সমর্থনে তখন সেখানে কোনো জমায়েত চোখে পড়েনি।
এই শহরেরই ১০ কিলোমিটারের ব্যবধানে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি), যেখানে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে এর আগে উত্থাপিত মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ এখনো তদন্তাধীন।