‘আমার দুরবস্থার কথা লেইখা কি হইব। যদি পারেন আমারে দুইডা ভাত দেন, দিনের পর দিন না খাইয়া আছি, ডায়বেটিসসহ নানা অসুখে ভুগতাছি, ওষুধ কিনার পয়সাও নাই।
’ অঝোর কান্নায় ভেঙে পড়ে এভাবে নিজের অসহায়ত্বের কথা জানালেন চলচ্চিত্রের একজন এক্সট্রা শিল্পী লাভলী। ৪০ বছর ধরে এই মাধ্যমে কাজ করছেন তিনি। গত কয়েক বছরে চলচ্চিত্র নির্মাণ উদ্বেগজনক হারে কমে যাওয়ায় এমন ঘোর দুর্দিন আর কখনো দেখেননি লাভলী। এখন এফডিসিতে কখনো ছবির সেট হলে তা ভাঙার পর কাঠখড় আর রাস্তায় পড়ে থাকা কাগজ বোতল কুড়িয়ে তা বিক্রি করে যা পান তা দিয়ে কখনো আধপেট খেয়ে আর না খেয়ে দিন কাটে তার।
লাভলী জানান মাঝে মধ্যে ছবির কাজ হলেও মিজান, সুমন, রাজা প্রমুখ দালাল বাইর থেকে লোকজন এনে কাজ করায়। পার্টির কাছ থেকে ১ হাজার টাকা নিয়ে কাজ করিয়ে দুই-একশ টাকা ধরিয়ে দেয়। এর প্রতিবাদ করেন বলে লাভলীদের এসব দালাল কাজ দেয় না। উল্টো নানা ভয়-ভীতি দেখায়, হুমকি দেয়। এক্সট্রা শিল্পীদের ঘোর দুর্দিন এখন। একদিকে চলচ্চিত্র নির্মাণের সংখ্যা কমেছে, অন্যদিকে বিভিন্ন ড্যান্স গ্রুপসহ নির্মাতাদের পছন্দের মানুষ আর দালালদের আনা লোকজন তাদের জায়গা দখল করে নিয়েছে। প্রায় দিনই পরিবার নিয়ে উপোস করতে হচ্ছে তাদের। তারপরও মন থেকে মুছে ফেলতে পারছেন না চলচ্চিত্র নামক প্রিয় শব্দটি। কেউ আবার বাঁচার তাগিদে অনৈতিক পথের আশ্রয় নিয়েছেন। মর্জিনা কাজ করছেন ৩০ বছর ধরে, কান্না করতে করতে তিনি বলেন, শিল্পী সমিতি কখনো আমাদের দিকে ফিরে তাকায় না। আমাদের নিজস্ব একটি সংগঠন ছিল।
সেটিও নেই। শিল্পী সমিতির কাছে সহযোগিতা বা আইডি কার্ড চাইলে তারা টাকা চায়। এমনিতেই কাজের অভাবে উপোস করছি, তাদের আবার টাকা দেব কোথা থেকে। মর্জিনা বলেন শিল্পী সমিতির বর্তমান কমিটির সাধারণ সম্পাদক নায়ক জায়েদ খান ভালো মানুষ। তিনি ঈদে তার নিজের কাছ থেকে যা পারেন সাহায্য করেন। অন্যদিকে শিল্পী ঐক্যজোটের কর্মকর্তা ডিএ তায়েব এবং জিএম সৈকতও যখন যা পারেন সাহায্য দেন। তারা তো আর প্রায় তিনশ জুনিয়র শিল্পীকে সাহায্য করতে পারবেন না। আমার আবেদন প্রধানমন্ত্রী যদি আমাদের দিকে তাকাতেন তা হলে আমাদের দুর্দিন ঘুচে যেত। ৩৮ বছর ধরে কাজ করা শিল্পী সুফিয়ারও একই অবস্থা।
রাস্তা থেকে কাগজ বোতল কুড়িয়ে জীবন নামের যন্ত্রটা কোনোভাবে টিকিয়ে রেখেছেন। তার আহাজারি, শিল্পী সমিতির আগের কমিটিগুলো যদি আমাদের দিকে তাকাত তাহলে আমাদের আজ এমন অবস্থা হতো না। বর্তমান কমিটির পক্ষ থেকে জায়েদ খান যা পারছেন করছেন। একই সঙ্গে শিল্পী ঐক্যজোটের কর্মকর্তা ডিএ তায়েব ও জিএম সৈকত আমাদের যখন যা পারেন সাহায্য করেন। সব সময় তাদের কাছে তো সাহায্য চাওয়া যায় না। প্রধানমন্ত্রী অসহায় শিল্পীদের বাঁচাতে পারেন। নূপুর নামে সবাই তাকে চেনেন। বয়স পঞ্চাশের কোঠায়। ১৫-১৬ বছর বয়সে এক্সট্রা শিল্পী হন। পিতৃহারা সন্তানকে মানুষ করতে পরিচালক সমিতিতে ঝাড়ুদারের কাজ বেছে নিতে হয়।
নাসির এফডিসিতে পান-সিগারেট বিক্রি করেন। কিশোর অবস্থায় এক্সট্রা হিসেবে চলচ্চিত্রে কাজ শুরু। তা প্রায় ৩৫ বছর হবে। ষাটোর্ধ্ব নাজমা আক্তার এখনো এফডিসির আঙিনায় কাজের অপেক্ষায় থাকেন। এক সময় ডাক্তারের চরিত্রও করেছেন। দিনে এক হাজার টাকা পর্যন্ত আয় ছিল। আলেয়া বুড়ি, দিলবাহারী, শুকুর জাহানের অবস্থাও আমার মতো। তারাও নামেমাত্র বেঁচে আছে। নূপুর, সুফিয়া, রাবেয়া, আলেয়া, রেবেকা, জাহাঙ্গীর, সেলিম, মেরিসহ প্রায় তিনশ এক্সট্রা শিল্পীর জীবনকাহিনী এমনই মানবেতর। এক্সট্রা শিল্পীদের জুনিয়র আর্টিস্টও বলা হয়। তাদের নিয়ে জুনিয়র আর্টিস্ট অ্যাসোসিয়েশন নামে একটি সংগঠনও ছিল। সাড়ে ৩০০ সদস্যকে সুরক্ষা দিতে ব্যর্থ হয় সংগঠনটি। সামান্য আয়ের ২০ থেকে ৩০ শতাংশ তুলে দিতে হয় দালাল ও চাঁদাবাজদের হাতে।
অভিনয় করতে গিয়ে আহত হলে চিকিত্সা পান না নির্মাতা কিংবা সংগঠনের পক্ষ থেকে। এক্সট্রা বলে কথা বলার অধিকার বা মূল্যায়ন কখনো ছিল না তাদের। এখন তো চলচ্চিত্র নির্মাণের ধরন বদলেছে। আইটেম গান যুক্ত হয়েছে। নায়ক-নায়িকার সখাসখী বা গানের দৃশ্যে নির্মাতা নিজের মানুষ বা ড্যান্স গ্রুপের সদস্যদের আনেন। এতে প্রকৃত এক্সট্রারা বেকার হয়ে পড়েছেন। শিল্পী সমিতির সাধারণ সম্পাদক জায়েদ খান বলেন, এদের আমি এক্সট্রা বলতে নারাজ। সমিতির গঠনতন্ত্রের ধারা ৮ এর [গ] তে উল্লেখ আছে শিল্পী হবে দুই ধরনের। যাদের পূর্ণ সদস্যপদ আছে তারা শিল্পী আর অন্যরা সহযোগী বা জুনিয়র শিল্পী। জুনিয়র শিল্পীরাও এখন শিল্পী সমিতির অন্তর্ভুক্ত। তাদের প্রতি কারও নজর নেই। আগের কমিটির কর্তাব্যক্তিরা কি করেছেন আমি জানি না। আমার কমিটির বয়স মাত্র কয়েক মাস।
কমিটিতে কোনো ফান্ড নেই। ফান্ড ক্রিয়েট করার জন্য নানা উদ্যোগ নিচ্ছি। এখন ঈদ, পূজায় ব্যক্তিগতভাবে তাদের সাহায্য করে যাচ্ছি। অনেক শিল্পীকে ভাতাও দিচ্ছি। তাদের জীবনমান উন্নয়নই এখন আমার একমাত্র লক্ষ্য। শিল্পী ঐক্যজোটের সভাপতি ডি এ তায়েব ও সাধারণ সম্পাদক জি এম সৈকত বলেন, শিল্পীরা মানুষকে তাদের কাজের মাধ্যমে আনন্দ বিনোদন দেয়। আর তারা যখন অসহায় হয়ে পড়ে তখন তাদের দিকে কেউ ফিরেও তাকায় না। এটি অত্যন্ত দুঃখজনক ও লজ্জার। আমরা আমাদের সংগঠনের পক্ষ থেকে আপ্রাণ চেষ্টা করে এ পর্যন্ত অনেক শিল্পীকে আমাদের সংগঠন ও প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে সাহায্য নিয়ে দিয়েছি।
ভবিষ্যতেও এই সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে। প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার ছটকু আহমেদ, আজিজুর রহমান, শাহজাহান চৌধুরীসহ অনেক সিনিয়র নির্মাতার কথায় সব দেশের চলচ্চিত্রে এক্সট্রা শিল্পী অপরিহার্য। এফডিসি প্রতিষ্ঠার পর ‘আমগাছতলা’ খ্যাত স্থানে এক্সট্রাদের নির্দিষ্ট ঠিকানা গড়ে ওঠে। এক সময় রমরমা অবস্থা ছিল তাদের। নব্বই দশকের শেষভাগে চলচ্চিত্রে অশ্লীলতা শুরু হলে অনেকে বাঁচার তাগিদে বাধ্য হয়ে অশ্লীল দৃশ্যে অভিনয় করেন। এরপর থেকে এই শিল্পীদের সমাজে বাঁকা চোখে দেখা হয়।
এখন তো আগের মতো ছবি নির্মাণ হয় না। তারা এখন বেশির ভাগ বেকার, নিঃস্ব। কেউ মঞ্চে উদোম নৃত্য করছেন। কেউ মিউজিক ভিডিওতে মডেল হচ্ছেন। কেউবা অনৈতিক কাজে গা ভাসিয়েছেন। অনেকেই এসবের সঙ্গে আপস না করে উপোস অবস্থায় এফডিসিতে তীর্থের কাকের মতো কাজের অপেক্ষা করছেন। আর মানবেতর জীবনযাপন করতে করতে দুস্থ অবস্থায় খাদ্য আর চিকিত্সার অভাবে মারা যাচ্ছেন।
বাংলাদেশ সময় : ১১৫৮ ঘণ্টা, ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৭,
লেটেস্টবিডিনিউজ.কম/এ