তার অভিনয় ও পরিচালনার উচ্চতা অনেক। খ্যাতির শীর্ষে থেকেও নায়করাজ রাজ্জাক বিনয়ের কাছে নতজানু ছিলেন। মনে-প্রাণে শুধুই কাজ করে গেছেন। নিজের কাজটি নিয়েই তিনি ভেবেছেন। সাফল্যকে কখনোই বড় করে দেখেননি। নায়করাজ অভিনেতা রাজ্জাকের চেয়ে পরিচালক রাজ্জাকেরই বেশি গুণগান করেছেন। দেশীয় চলচ্চিত্রের এখনকার এই দুর্দশা তাকে অনেক পোড়ায়। এই নিয়ে ২০১৬ সালের জুন মাসে একটি জাতীয় দৈনিককে দিয়েছে সাক্ষাৎকার। তার সেই সাক্ষাৎকার পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হল-
প্রত্যেক মানুষই স্বপ্ন দেখে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে স্বপ্নের বদল হয়। শৈশব থেকে আজকের নায়করাজের স্বপ্ন বদলের গল্পটা কেমন?
আমি যখন ক্লাস সেভেনে পড়ি, তখন আমার মধ্যে একটি স্বপ্ন কাজ করতো। আর তা হলো আমি ফার্স্ট ডিভিশন ফুটবল প্লেয়ার হবো। কারণ সেই সময়ে কলকাতায় ফার্স্ট ডিভিশন ফুটবল প্লেয়ার হওয়া মানে বিরাট ব্যাপার। একজন প্লেয়ারের খুব বেশি টাকা হয়তো নেই। কিন্তু বেশ ইজ্জত আছে। আমি গোলকিপার ছিলাম। ইন্টার স্কুলে দারুণ গোল কিপার হয়ে উঠেছিলাম। এরমধ্যে হঠাৎ করেই অভিনয়ে এলাম। অনেকটা জোর করেই আমাকে দিয়ে অভিনয় করালেন আমার স্কুলের গেম টিচার। সকালে মেয়েদের স্কুল, দুপুরে আমাদের ক্লাস। আমার অভিনয়টাকে মেয়েরা এপ্রিশিয়েট করে। ভালো লাগতে শুরু করল। এরপর তো অভিনয়ের একটা পোকা ঢুকে গেল আমার মাথায়। অভিনয়ের আসার পর থেকে এটা নিয়েই আমার যত ভাবনা। অভিনয় ছাড়া আর কোনো স্বপ্ন আমার নেই। আমি এই স্বপ্নটাই সব সময় দেখেছি যে, আমি একজন বড় অভিনেতা হবো। বড় রাজ্জাক নয়, বড়লোক রাজ্জাক না, পপুলার রাজ্জাক নয়, আমি একজন ভালো অভিনেতা হবো। এই টার্গেট আমার বরাবরই ছিল। আমার মনে হয়, আমি সফল হয়েছি। এখনও স্বপ্ন একটাই, ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করতে করতে মারা যাবো। তবে সেটা বোধহয় আর হবে না। এখন আমার কাজ করার কোনো জায়গা নেই। সুতরাং কোনো শুটিং ফ্লোরে পড়ে আমি মারা যাবো সেই চান্সও নেই। হয়তো বাড়িতে, নয়তো হাসপাতালের বিছানায়ই আমার মরণ হবে। তারপরও আমি স্বপ্ন দেখি ইন্ডাস্ট্রি বড় হোক, বড় তো হয়েছিলই। মাঝে আবার ছোট হয়ে গেছে। এখন একটা জায়গাতে এসেছে। আমরা স্বপ্ন দেখেছিলাম বিরাট ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি হবে। বড় বড় বাজেটের ছবি হবে। আমি যখন এলাম, তখন কবরী, ববিতা সুচন্দা কাজ করত। আমরা রোমান্টিক ছবি করতাম। সেই সময়ে আমাদের শুটিং হতো কক্সবাজারের বিভিন্ন লোকেশনে। এখন হিমছড়িতে বাসে যাওয়া যায়। তখন জোয়ার ভাটার জন্য অপেক্ষা করতে হতো। জোয়ারে যেতাম, আবার ভাটা পড়লে চলে আসতাম। আর ছিল রাঙামাটি ও কাপ্তাই। এসব লোকেশনে কাজ করেই আমরা অনেক সুপার-ডুপার হিট ছবি উপহার দিয়েছি। আর গ্রামের লোকেশন দরকার পড়লে আমরা যেতাম সাভার নয়ারহাট। ফকিন্নির হালতে ছবি করে আমরা কোথায় নিয়ে গিয়েছিলাম ইন্ডাস্ট্রিটাকে। ওটা ছিল আমাদের স্বপ্ন। শুধু আমার একার না। আমার সঙ্গে যারা যারা ছিলেন, প্রত্যেকটি মানুষ কষ্ট করে ইন্ডাস্ট্রিটাকে দাঁড় করিয়েছিলাম। কক্সবাজারে তো এখন পর্যটন কেন্দ্র হয়েছে। তখন কিছুই ছিল না। সাইক্লোন হলে মানুষ যেখানে আশ্রয় নেয়, আমরা সেখানে বিছানাপত্র নিয়ে যেতাম। সেখানে থেকেই কাজ করেছি। সেই সময় হোটেল বলতে এক সাগরিকা আর সায়মন ছিল। আমরা স্বপ্ন দেখেছি বলেই এত পরিশ্রম করেছি সিনেমা নিয়ে। আজকাল এ ধরনের স্বপ্ন ছেলেমেয়েরা দেখে না।
একজন অভিনেতা ও পরিচালক হিসেবে আপনার অনেক প্রাপ্তি রয়েছে। এটা কখন আপনার ভেতর কীরকম আলোড়ন তুলেছে?
আসলে যে স্বপ্নটা আমি দেখেছিলাম। এর প্রতিফলন ঘটেছে। আমি সফলও হয়েছি। আমি এ দেশের একজন শিল্পী হিসেবে যে সম্মান ও ইজ্জত পেয়েছি, আমার মনে হয়, পৃথিবীর আর কোনো শিল্পী আমার মতো এতটা পায়নি। আমি এই বয়সে এসেও যে সম্মান পাচ্ছি, এটা আমার জন্য বিরাট পাওয়া। আর চলচ্চিত্র আমাকে এ দেশ দিয়েছে। একটি দেশ নিয়েই তো চলচ্চিত্র। আমি এ মাধ্যমে কাজ করে যা পেয়েছি, বিশ্বের আর কোনো হিরোর ভাগ্যে হয়তো তা জোটেনি। দেশের সর্বোচ্চ যে সম্মান স্বাধীনতা পুরস্কার, সেটাও আমি এবার পেয়ে গেলাম। আমি সবই পেয়েছি। এ দেশের মানুষ আমাকে যে ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা দিয়েছে, এই ঋণ আমি কখনো শোধ করতে পারবো না। আমার যে স্বপ্ন ছিল আমি একজন ভালো অভিনেতা ও মানুষ হবো, আমি তা হয়েছি। আমার আর চাওয়ার কিছু নেই। আমার ক্যারিয়ারের শুরু থেকে অনেক পরিশ্রম করেছি, ২৪ ঘন্টার মধ্যে আমি ২০ ঘন্টা কাজ করেছি। চলচ্চিত্রের সাফল্যের যে পতাটাকে আমি ওদের হাতে তুলে দিয়ে এলাম, তা ওরা ধরে রাখতে পারল না। এক রাজ্জাক ছাড়া যদি ওরা না চলতে পারে এটা খুবই দুঃখজনক। আমাকে বিষয়টি খুব দুঃখ দিয়েছে।
এই সময়ের নির্মাতাদের অনেকেই বলেন এখন বিনোদনের মাধ্যম পরিবর্তন হয়ে গেছে। দর্শকরা ফেসবুক, ইন্টারনেটের বিভিন্ন সুবিধাগুলোতে বিনোদন খোঁজেন। এ কারণে দেশীয় চলচ্চিত্র দেখতে হলে আগের মতো দর্শক হয় না। কিন্তু আগের ছবিতে আমরা যেমন পারিবারিক গল্প পেতাম, সংসারের প্রতিটি চরিত্র ফুটে ওঠত তখনকার ছবিতে। এখন সেটা নেই। আমার তো মনে হয়, এখনকার নির্মাতারা গল্প বা নির্মাণ বৈচিত্র্য দিয়ে দর্শক টানতে ব্যর্থ হয়ে বিভিন্ন দোহাই দিচ্ছেন। আপনি কী বলবেন?
শোনো, চলচ্চিত্রের ভাষা বা গল্প কিন্তু যুগে যুগে একই। ৫০ সালে একবার টাইটানিক হয়েছিল, এখন আবার সেই টাইটানিক দিয়েই নতুন করে জনপ্রিয়তা এসেছে। আমি যদি ভালো করে ছবিতে গল্প বলতে পারি, যদি মানুষের কাছে যেতে পারি, একটি উদাহরণ দিচ্ছি-আমার প্রোডাকশন থেকে যখন অ্যাকশন ছবি হচ্ছে, আমার ছেলেরা পাগল হয়ে গেছে অ্যাকশন ছাড়া ছবি চলে না, অথচ আমি ব্যবসায়িকভাবে মার খাচ্ছি। আমি ‘অভিযান’ করলাম তিনটি হিরো দিয়ে। ছবি হিট হলো কিন্তু আলোড়ন তৈরি করল না। আমি রাগ করে হজ্বে চলে গেলাম। সেখান থেকে এসে বানালাম নরমাল একটি ছবি। শরৎচন্দ্রের কাহিনী নিয়ে ‘সৎভাই’। যেটা শাবানার ক্যারেক্টার, সেখানে আমি নিলাম নূতনকে। আর যেখানে ইলিয়াস কাঞ্চণ সেখানে আমি নিলাম আলীরাজকে। কাঞ্চণ এর আগে আমার অভিযানে ছিল। পরে তাকে না নেওয়ায় তার দুঃখ ছিল। কিন্তু এই ছবিটি আমাকে অনেক ব্যবসা দিয়েছে। এতে কিন্তু কোনো মারামারি নেই, একটা থাপ্পরও ছিল না। একটি গান ছিল তা-ও আমি ফেলে দিয়েছিলাম। তো গল্প বলতে হবে। ভালো ছবি বানাতে হবে। এখন সেই অর্থে বানাবার লোক নেই। এখনকার সিনেমাতে তো কত অশোভন জিনিস জুড়ে দেওয়া হচ্ছে। এরপরও তো তোমরা হলে তা চালাতে পারছো না। মেয়েদেরকে অর্ধনগ্ন করছো। এখন গান করার জন্য ব্যাংকক, লন্ডন কত জায়গায়ই তো যাচ্ছে মেকাররা। আর আমাদের সময় একটি রোমান্টিক গান করার জন্য পরিচালক প্রস্তুতি নিত গানটি হিমছড়িতে হবে। এটাই আমাদের জন্য বিরাট ব্যাপার ছিল। সবাই বাসে চড়ে একসঙ্গে সকাল ৯ টায় রওনা দিয়ে রাত ১০টায় পৌঁছতাম। সুন্দর একটি গান হতো। আর এখন ওদের টার্গেট দেশের বাইরে যাওয়া। সেখানে মেয়েটাকে অর্ধনগ্ন করো, আর ছেলেটাতো উলঙ্গ আছেই। এরপরও তো কিছু করতে পারছে না। কিছু কি হচ্ছে? আমরা ময়নামতির অনেক সাধের ময়না আমারের শুটিং করেছি নয়ারহাটে। এই নয়াটোলার নয়ারহাট। এখন শিল্পীদেরও চেষ্টা নেই। ভালো কিছু করার জন্য সবার সাম্মিলিত চেষ্টার প্রয়োজন। তখন জহির রায়হানের পাশাপাশি এগিয়ে এলেন কামাল লোহানী, সুভাস দত্ত ও কাজী জহিরা। আমি তাদের বললাম, আপনারা আমাকে কাজ দিন, আমি কাজ করবো। আমি কাজকে ভয় পাই না। তারা নিজেরাই আমার শিডিউল ভাগ করে নিতেন। আমি সকাল ৯টায় এফডিসিতে যেতাম, পরদিন ভোর ৫টায় বাড়িতে আসতাম। নাপিত আমার বাড়ির গেইটে থাকত। আমি চেয়ারে বসতাম, তিনি আমার দাঁড়ি কেটে দিতেন। ঐ অবস্থায় গিয়ে শুয়ে পড়তাম। আমার সেক্রেটারি ছিল অনেক কঠোর। ঠিক সকাল ৯ টায় আমার বউকে গিয়ে বলত, ম্যাডাম স্যারকে উঠিয়ে দিন প্লিজ! আমি উঠে মুখ ধুয়ে একটা চা খেয়েই বেরিয়ে পড়তাম এফডিসির উদ্দেশে। এফডিসিতেই আমি সকালের নাস্তা করেছি। তখন সেখানে আমাদের মারুফের নাস্তার দোকান ছিল। পুরি আর আলুর তরকারি। জীবনেও সেই স্বাদ আমি ভুলব না। হলিক্রস কলেজের সামনে রাস্তায় এক দাদা বসে মাঠা বিক্রি করতেন, আমি তাকে একটা বড় চীনা গ্লাস কিনে দিয়েছিলাম। আমি তার কাছে পৌছুলেই তিনি গ্লাস ভরে আমাকে মাঠা দিতেন। আমি গাড়িতে বসেই তা পান করতাম। এটাই ছিল আমার ব্রেকফাস্ট। তখন জীবনের দিকে তাকাবার সময় আমার ছিল না। নিজের শখ, আহ্লাদ, সবকিছুকে ভুলে গিয়েছিলাম। শুধু কাজ আর কাজ করেছি। আমি মনে করি, একজন স্টারের বিরাট দায়িত্ব আছে। এতবড় দায়িত্ব যদি সে পালন না করে, তাহলে ভুল হবে। একটা ঘটনা মনে পড়ছে। কবি ও লেখক সৈয়দ শামসুল হক তার মেয়েকে নিয়ে ‘নাজ’ সিনেমাহলে গিয়েছিলেন ইংলিশ ছবি দেখতে। তখন তার মেয়ে ১২ বছর বয়সী। মেয়ে ছবি দেখছে কিন্তু তার ভালো লাগছে না। সে শুধু রাজ্জাককে খুঁজছে। বাবাকে বলছে- বাবা, রাজ্জাক কই, কখন আসবে। হক সাহেব বলছে- একটু পরেই তার দৃশ্য শুরু হবে। এভাবে কয়েকটি দৃশ্য পার হওয়ার পর যখন মেয়েটি আমাকে না পেয়ে হতাশ। সে বলে উঠল-না, এই ছবি আমি দেখব না। এরপর আমার বাড়িতে এসে হক সাহেব একদিন আমাকে বললেন, এই মিয়া আমার ৫০টাকা ফেরত দিন, আমি অবাক হয়ে বললাম, আমি কবে ৫০ টাকা নিয়েছিলাম। তিনি মজা করে বললেন, নিয়েছেনই তো। আমি মেয়েকে নিয়ে গেলাম ইংলিশ ছবি দেখতে, আর সে সেখানে রাজ্জাককে খুঁজছে। আমি ইংলিশ ছবিতে কী করে রাজ্জাককে দেখাবো! আসলে আমাদের চলচ্চিত্রাকাশে সত্যিকার অর্থেই একজন স্টার পয়দা হয়েছে। আর সে রাজ্জাক। এটা তার ভাষ্য। কত বড় সার্টিফিকেট! এরপর আমি তার লেখা অনেক গল্পে অভিনয় করেছি। এই আমাদের ত্যাগ, আমি কিন্তু কখনোই নিজের সাফল্যকে মাথায় রাখিনি। আর এখনকার ছেলেমেয়েরা ইন্ডাস্ট্রিতে এসেই নিজেকে কত কী ভাবা শুরু করে!
আপনার ক্যারিয়ারের দীর্ঘ জানি। নায়ক হিসেবে খ্যাতির অনেক উঁচু জায়গাতে ছিলেন আপনি। এখনকার নায়ক-নায়িকরা একটু সাফল্য পেলেই মাথা গরম করে ফেলেন। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে তাদের ক্যারিয়ার ও ব্যক্তিজীবনেও। আপনি কীভাবে মাথা ঠান্ডা রেখে কাজ করে গেছেন?
আমি একটা কথাই মনে করতাম, আমি একজন অভিনেতা, আমি অভিনয় করি। আর কিছুই আমি মনে করতাম না। কেউ আমাকে সুপারস্টার বলছে, কেউ নায়করাজ এটা তাদের ভালোবাসা। আমি নিজেকে একজন শিল্পী ও চলচ্চিত্রের একজন কর্মী মনে করতাম। এখনো তাই করি। আমি কাজটাকে বড় করে দেখতাম, সাফল্যকে নয়। আমি এক সময় খুব ব্যস্ত ছিলাম, এখন সেটা নেই। এই বিষয়টি নিয়ে আমার মধ্যে কোনো হতাশা কাজ করে না। আমি রেস্টে আছি, ভালো আছি। আমার মতো খ্যাতির জায়গায় থেকে অবশেষে অনেকে হারিয়ে গেছে। স্টিল আমি বাংলার মানুষের কাছে সেই নায়করাজ। আমি যেখানেই যাই, মানুষ আমাকে অনেক সম্মান, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা দেয়। আগে আমি পাঁচ কোটি মানুষের হিরো ছিলাম, এখন সতের কোটি মানুষের হিরো। মাঝে যখন আমি খুব অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি ছিলাম। এরপর নতুন করে মানুষের ভালোবাসা টের পেলাম। চারদিকে মানুষের হাহাকার শুরু হয়েছিল, রাজ্জাক আছে, না মারা গেছে। আমার ছেলেরা তো পাগল হয়ে গেছে। বিশেষ করে সম্রাট। আমি যে হাসপাতালে ভর্তি ছিলাম সেখানকার নামাজের জায়গায় বসে ভক্তরা আমার জন্য দোয়া করেছে। তাদের দোয়াতেই আমি মরণ পথ থেকে এবারের মতো ফিরে এসেছি। এই যে ভালোবাসা ও দোয়াতা ভাষায় প্রকাশ করার মতো না।
ক্যারিয়ারের শুরু থেকে এ পর্যন্ত আপনি কয়েক প্রজন্ম নির্মাতাদের সঙ্গে কাজ করেছেন। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের সঙ্গে এই যে আপনার কাজ করা সময়ের বিবর্তনে নির্মাণ ভাবনার মধ্যে কী ধরনের পার্থক্য দেখেছেন?
আমার যে জেনারেশন ছিল, এর পরের জেনারেশন পর্যন্ত নির্মাণগুলো ঠিকই ছিল। তৃতীয় প্রজন্মও মোটামুটি ঠিক ছিল। তারা ফিল্ম বানাতো, ফিল্মের ভাষাটা তারা জানতো। এর পরের জেনারেশন কিন্তু ফিল্মের ভাষা জানে না। ওরা ভাবছে হলিউড ও বলিউডে কী হচ্ছে। আমরা সেটা করার চেষ্টা করি। বলিউড যে ছবি বানাচ্ছে, তাদের যে বাজেট ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা, তা আমাদের নেই। আর হলিউডের কথা নাইবা বললাম। এখন যে জেনারেশন ফিল্ম বানাচ্ছে ওরা আসছে ওদের কোনো ট্রেনিং নেই। জহির রায়হানের সহকারী ছিলেন রহিম নেওয়াজ, আমজাদ হোসেন। তাদের ক্ষমতা মানুষ দেখেছে। এরা জহির রায়হান ও কাজী জহিরের মতো মেকারের সঙ্গে কাজ করেছে। তাদের পড়াশোনা, জানার পরিধি অনেক। আমজাদ হোসেনের সহকারী ছিলেন চাষী নজরুল ইসলাম। এরা কাজ করেছে তখন। এখন টাকা দিয়ে রেজিস্ট্রেশন করানো হয় পরিচালক হিসেবে নিজের নামটা। কী জানি বা জানি না সে ব্যাপারে কোনো তদারকি নেই। আমি কারো সহকারী হিসেবে কাজ করেছি কী করি নাই, তারও কোনো ঠিক নেই। এভাবেই চলছে।
এই যে পরিচালককে সম্মান দেখানো, আলাদা ডেকে নিয়ে ভুল শুধরে দেওয়া। এমন বিনয় কি আপনি নতুন প্রজন্মের মাঝে দেখেছেন?
না, না। ওরা সামনাসামনি অপমান করতে পারলেই বরং বেশি খুশি হয়। ওরা তো পরিচালককে পরিচালকই মনে করে না। ওদের বলে কন্ডাক্টর। আর এখনকার অধিকাংশ পরিচালকই আসলে কন্ডাক্টর। ডিরেক্টর মানে তো ক্যাপ্টেইন। ক্যাপ্টেইন অব দ্য শিপ। ডিরেক্টরের কথায় আর্টিস্ট উঠবে বসবে। আর এখনকার ডিরেক্টররা তো হিরো হিরোইনের চামচামি করতে করতেই সময় ব্যয় করে ফেলে। কাজ করবে কী! আপনার দু’জন যোগ্য উত্তরসূরি রয়েছেন। একজন বাপ্পারাজ, অন্যজন সম্রাট। দুজনই অভিনয়ের পাশাপাশি পরিচালনায় নাম লিখিয়েছেন। আপনি এরইমধ্যে
সম্রাটের পরিচালনায় কাজও করেছেন। তাদের কাজ দেখে কী মনে হয়?
ভালোই মনে হয়। ওদের আমি সব সময়ই একটা কথা বলি, ভালো কাজ করবে। ওরা তাই করছে। আমি বাপ্পা ও সম্রাটের কাজের প্রতি শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও সিনসিয়ারিটি দেখেছি। ওরা যে কাজটা করে ভালোবেসেই করে। ওরা আমার দোয়া নিয়েই কাজ করতে যায়। কোনো কাজ করার আগে আমার সঙ্গে তা শেয়ার করে, স্ক্রিপ্ট পড়তে দেয়। আমি ‘ওকে’ বললেই কাজ করে। আর যদি আমি না বলি, তাহলে সেই কাজ করবে না। আমার ছেলেরা ইন্ডাস্ট্রির প্রতি অনেক শ্রদ্ধাশীল। সবার সঙ্গেই সুন্দর আচরণ করে। তোমাকে ভাই বলে কথা বলবে। এটা আজকালকার ছেলেমেয়েদের মধ্যে খুবই কম দেখা যায়। আমার ছেলেরা ওদের বাপকে যতটা ভালোবাসে, এই ইন্ডাস্ট্রিকেও ততটাই ভালোবাসে। ফলে সবার সঙ্গে ওরা সহজে বিনয় দিয়ে ভালো সম্পর্ক তৈরি করে নেয়।
এর আগেও এ দেশে যৌথ প্রযোজনায় ছবি হয়েছে। আপনিও কাজ করেছেন। সে সময় নীতিমালা মেনেই কাজ হতো। এখন সেটা মানা হচ্ছে না। এই বিষয়টি কীভাবে দেখছেন?
আমি নীতিমালার কথা বলবো না। এখন যৌথ প্রযোজনার নামে যারা কাজ করছে, তারা বাংলাদেশে আমাদের মেয়েদের ন্যাংটা করতে পারছে না। ওখানে নিয়ে গিয়ে করছে। এখনকার যৌথ প্রযোজনাকারীরা হচ্ছেন স্মাগলার। আগে আনন্দ ফূর্তি করার জন্য কিছু জমিদাররা যেমন বায়েজি এনে নাচ উপভোগ করতেন, তেমনি এই স্মাগলাররা আমাদের মেয়েদের নিয়ে গিয়ে বায়েজি নাচ নাচাচ্ছে কলকাতাতে। এর মতো অন্যায় আর কিছু হতে পারে না। তাদের এই অন্যায়ের জন্যই আমাদের ইন্ডাস্ট্রিটা ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে বা গেছে। আমাদের এখানে এখন কিছু বড়লোক গজিয়েছে। তারা নায়িকাদের বায়েজি হিসেবে ব্যবহার করছে। নীতিমালা দেখার মতো মানসিকতা তো তাদের নেই। সরকারও কিছু বলছে না। আর আমাদের সরকার তো দেখছি কোনো ব্যাপারেই সিরিয়াস না। আমি সরকারকে বলেছিলাম, আপনারা কেন এই যৌথ প্রযোজনা জিইয়ে রেখেছেন। আমাদের এখান থেকে দুজন আর্টিস্ট যাচ্ছে, আর বাকিসব ওদের। আমার দেশে দুদিন শুটিং করেই ওরা বলছে অর্ধেক কাজ হয়ে গেছে। বাকি কাজ করছে বিদেশে, আউটডোরে। আমরা দেশীয় লোকেশনে শুটিং করে কাজ করেছি। আমাদের ছবি দর্শকরা সপ্তাহের পর সপ্তাহ দেখেছেন। হিমছড়িতে শুটিং করে ছবি হলে উঠিয়েছি আর সেটা হল থেকে নামেনি সহজে। আর এখন হংকং, সিঙ্গাপুর ও লন্ডনে শুটিং করার পর ছবি হলে উঠালে একদিন পরই নামিয়ে ফেলতে হয় দর্শক নেই বলে। আমরা গ্রামীণ ছবি করলে যেতাম সাভার। একটু মডার্ণ ছবি হলে হিমছড়ি বা রাঙামাটি। এই ছিল আমাদের গ্ল্যামার। তখন আমাদের ক্যাপিটাল ছিল ক্যামেরার সামনের লোকগুলো। এই রাজ্জাক, সুচন্দা ও কবরীএরা কী করছে, কী বলছে এটাই দর্শকরা দেখতেন। পরিচালকরা আর্টিস্টদের ওপরই ভরসা রাখতেন। ব্যাকগ্রাউন্ডে কী আছে না আছে তা নিয়ে পরিচালকরা ভাবতেন না। তারা জানতেন ক্যামেরার সামনে তাদের কী জিনিস রয়েছে। আজ তোমরা স্কটল্যান্ডে শুটিং করেও ছবি চালাতে পারছো না। তবে আমরা কী করে এ দেশে শুটিং করে ছবি চালিয়েছি? হিমছড়িতে শুটিং করে আমরা ইন্ডাস্ট্রিটাকে এত বড় করেছি। তিন’শ হল থেকে তা চৌদ্দ’শ করেছিলাম। আর তোমরা এসে চৌদ্দ’শ থেকে তা তিন’শতে নামিয়েছো।
দেশীয় চলচ্চিত্র নিয়ে অনেক হতাশার কথাই বললেন। এরপরও কি আপনি কোনো আশার আলো দেখেন কিনা যে, একদিন আমাদের চলচ্চিত্র আবার আগের জায়গা ফিরে পাবে?
না, আমি সেই স্বপ্ন দেখি না। কারণ আমাদের নৈতিক চরিত্র শেষ হয়ে গেছে। আর শুধু চলচ্চিত্রের সঙ্গে জড়িত মানুষদেরই নয়, সারা দেশের মানুষের নৈতিক চরিত্র নষ্ট হয়ে গেছে। সরকার বলছে, ভাই তোমরা রমজান মাসে দ্রব্যমূল্য বাড়াইওনা। আমরা কী করছি তা না শুনে রমজান মাসে কে কত পারি জিনিসের দাম বাড়াচ্ছি। এটা কারা করছে, যারা ব্যবসায়ী। ওদের নৈতিক চরিত্র বলতে কিছু নেই। তোমরা রোজার সময় খেজুর ও ছোলার দাম বাড়াচ্ছো, যেটা রোজাদারেরা খায়। মাংস, সেটাও একই অবস্থা। রাতরাতি তো একটি গরুর দাম পাঁচ হাজার টাকা বাড়ছে না। এভাবে প্রতিটি সেক্টরের মানুষের নৈতিক চরিত্র নষ্ট হয়ে গেছে যেটা আগে ঠিক ছিল। আগে আমি বাজারে গেলে বিভিন্ন প্রকারের সবজি কেনার পর কাঁচামরিচ ও ধনেপাতা দোকানি একমুঠো ফ্রি দিয়ে দিত গিফট হিসেবে। এখন কাঁচামরিচের কেজি এক’শো টাকা। ধনেপাতার কেচি দেড়’শ টাকা। সেই প্রেম-ভালোবাসা এখন কোথায়?
নায়ক হিসেবে কাজ করতে গিয়ে আপনার পরিকল্পনা কেমন ছিল?
আমি বরাবরই বেছে বেছে কাজ করেছি। কেউ এলো আর আমি তার ছবিতে কাজ করবো, সেটা সম্ভব ছিল না। ‘বেহুলা’র (নায়ক হিসেবে নায়করাজের প্রথম চলচ্চিত্র) পর থেকেই আমার সেক্রেটারি ছিল। কেউ মন চাইলেই আমার কাছে আসতে পারত না। আমার কাছে আসার আগে তাকে কয়েকটি ব্যারিকেড পার হতে হতো। এই ব্যারিকেডগুলো ছিল বলেই ফালতু লোকগুলো আমার কাছে আসার সুযোগ পায়নি। একজন আর্টিস্টের প্রথম দরকার হলো চুজি হওয়া। তুমি কোন ছবি করবে বা করবে না এটা ঠিক করে নিতে হবে। আমি এই কাজে বরাবরই আমার সেক্রেটারিদের সহযোগিতা পেয়েছি। আমার প্রথম সেক্রেটারি ছিল আকবর। এরপর মিরাজ। আকবর তো আমার অনেক পছন্দের ছিল। ও মারা যাওয়ার পর আমি মিরাজকে নিলাম। আমার কাছে কেউ ছবি করার প্রস্তাব দিলেই আমি বলতাম আমার সেক্রেটারির সঙ্গে যোগাযোগ করুন। আর আমার সেক্রেটারির কাজ হলো তুমি কে, কোত্থেতে এসেছো। তোমার কোয়ালিফিকেশন কী, এর আগে তোমাকে ইন্ডাস্ট্রিতে দেখেছি কিনা। তুমি কার সহকারী হিসেবে কাজ করেছো। কতদিন ধরে চলচ্চিত্রে কাজ করছো। এরপর যদি সদুত্তর পাওয়া যায়, তাহলে স্ক্রিপ্ট নিয়ে আসার কথা বলা হতো। আর যদি আমার সেক্রেটারি আগেই বুঝে যায় তোমার কতটুকু ক্ষমতা, তুমি পারফেক্ট নও। তাহলে সে বলবে- না, রাজ্জাক সাহেব এই ছবি করবে না। এটাই ছিল আমার নিয়ম। এর ব্যতিক্রম হলে আমার বাপ এলেও আমি ছবি করতাম না। এমনও হয়েছে যে, আমি পঁচা পঁচা পরিচালকের কাজ করেছি। এর কারণ ছবির গল্প ভালো ছিল। আমি ভিলেনের চরিত্রেও কাজ করেছি। তো একজন আর্টিস্ট যদি গু, গোবর যা পায় তাই খায়, তাহলে হলো না। আমি নিজের কাজের ক্ষেত্রে এই নিয়মগুলো মেনে চলেছি। আজ আমার এই স্থায়ীত্ব কেন, এ কারণেই। আমার সেক্রেটারির কাছে পরীক্ষায় পাস করার পরই আমার কাছে আসার সুযোগ পেতেন পরিচালকেরা। তখন তো ছুটি ছিল রোববার। ছুটির দিন সকালে আমার বাড়িতে এক থেকে দেড়’শ লোক আসত। আমি একে একে পরিচালকদের কাছে ছবির গল্প শুনতাম। এই করতে করতে বিকাল চারটা-পাঁচটা বেজে যেত। যখন আমি কারো স্ক্রিপ্ট পছন্দ করতাম, ঐ সময় থেকেই পরিচালক আমার বেস্টফ্রেন্ড হয়ে গেল। যাতে তার মধ্যে কোনো ভয় না থাকে। ঐ সময় রাজ্জাককে নিয়ে প্রথম কাজ করার মধ্যে অনেকেরই একটু ভয় কাজ করতো। কিন্তু আমি তাদের অভয় দিতাম। পরিচালকদের সঙ্গে আমি এভাবে মিশতাম যে, সবকিছু তাদের খুলে বলার পরিবেশ তৈরি করে দিতাম। আমি পরিচালকদের বলতাম, কখনোই মানের সঙ্গে কমপ্রোমাইজ করবেন না। তাহলে কিন্তু আমি কাজ করবো না। আমি রাজ্জাক বলে আমাকে অনেক সমীহ বা তোয়াজ করতে হবেএটা আমি পছন্দ করতাম না। আমি বলতাম তুমি সেটে যখন পরিচালক, আমি যত বড় সুপারস্টারই হই না কেন, আমি তোমাকে সম্মান দেখিয়েই কাজ করবো। তুমি সেটে ভুল সিদ্ধান্ত নিলেও আমি তোমার বাইরে কোনো কথা বলবো না। তবে হ্যাঁ, পরে তোমাকে আলাদা করে ডেকে নিয়ে বলে দিবো এই এই জায়গাই এটা না করলে ভালো হয়।
এবার জানতে চাই আপনার নায়করাজ হয়ে ওঠার পেছনে কাদের ভূমিকা ছিল?
আমি আজকের আমি হতে পারতাম না, যদি না আমার সঙ্গে আমার সহযোদ্ধারা থাকত। আমি যখন এ দেশে কাজ করতে এলাম তখন রহমান ভাই জীবিত ছিলেন, কিন্তু সুস্থ নন। শওকত আকবর, হাসান ভাই আছেন, কিন্তু তারা কাজ করার মতো অবস্থায় নেই। আমার ‘আগুন নিয়ে খেলা’র পর মেকাররা মনে করল আরে একে তো সব জায়গাতেই লাগানো যায়। এ দেশের মানুষ আগে বাংলা ছবি দেখত না। আগুন নিয়ে খেলা’র পর আমাকে দেখে তারা বলতে শুরু করল, আরে এতো আমাদের হিরো। তখন কলেজ-ইউনিভার্সিটির ছাত্রছাত্রীরা ছবি দেখা শুরু করল।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন রকিব হোসেন
বাংলাদেশ সময়: ১১১০ ঘণ্টা, ২২ আগস্ট ২০১৭,
লেটেস্টবিডিনিউজ.কম/এসপি