৩ বছরের জেল হবে শাকিব খানের?

বিনা অনুমতিতে অন্যের ব্যক্তিগত কোনও তথ্যই অপর কেউ ব্যবহারের অনুমতি রাখেন না। মোবাইল টেলিফোন, ব্যাংকের চেক, বইয়ের লেখক হিসেবে নাম থেকে শুরু করে বাড়ির ঠিকানা―এর কোনটি যদি নাটক সিনেমা বা অন্য কোনও মাধ্যমে ব্যবহার করতে হয় তাহলে মালিকের অনুমতি অবশ্যই নিতে হবে।

সম্প্রতি এ বিষয়টি আবারও উঠে এসেছে নায়ক শাকিব খান অভিনীত একটি চলচ্চিত্রে একটি ফোন নম্বর ব্যবহার করাকে কেন্দ্র করে। ওই চলচ্চিত্রে শাকিব খান একটি ফোন নম্বর দেন যেটির প্রকৃত মালিক হবিগঞ্জের এক অটোরিকশাচালক। কিন্তু, এই নম্বরটি ব্যবহারের ক্ষেত্রে ফোন নম্বরধারীর কোনও অনুমতিই নেননি তিনি।
বিষয়টি উল্লেখ করে আইনজীবীরা বলছেন, বিনা অনুমতিতে শাকিব খানের সিনেমায় একজন অটোরিকশাচালকের মোবাইল নম্বর ব্যবহার করা নৈতিকতা বিবর্জিত এবং সেই ব্যক্তি যদি ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকেন তাহলে তার ক্ষতিপূরণ পাওয়ার অধিকার রয়েছে। আইনজীবীরা বলছেন, অভিযোগ প্রমাণ হলে শাস্তি সর্বোচ্চ তিন বছরের কারাদণ্ড হতে পারে এ কাজে সংশ্লিষ্টদের।

সম্প্রতি ‘রাজনীতি’ সিনেমায় নায়ক শাকিব খান একটি ফোন নম্বর ব্যবহার করেন। এরপর শুরু হয় সেই নম্বরের মালিক হবিগঞ্জের অটোরিকশাচালক ইজাজুল মিয়ার কাছে একের পর এক ফোনকল আসা। ফোন দিয়ে সবাই শাকিব খানের সঙ্গে কথা বলতে চান।

এদিকে, মাসের পর মাস ধরে শাকিব খান মনে করে তার কাছে ফোনকল আসতে থাকায় তার ব্যক্তিগত জীবনে তা প্রচণ্ডভাবে প্রভাব ফেলে। তিনি কাউকে বিশ্বাস করাতে পারেন না যে ফোনটি শাকিব খানের নয়, তার নিজের। ফোনের যন্ত্রণায় অটোরিকশা চালাতে সমস্যা হওয়ায় মালিক তার গাড়ি ফিরিয়ে নেন, যন্ত্রণা ও সন্দেহ বাড়ায় স্ত্রীও বাসা ছেড়ে চলে যান।

এমন বিড়ম্বনায় তার ব্যক্তিগত ফোন নম্বর ব্যবহার করায় ঢালিউডের শীর্ষনায়ক শাকিব খানের বিরুদ্ধে হবিগঞ্জ আদালতে প্রতারণা ও মানহানির মামলা করেন তিনি। শুধু শাকিব নন, মামলার আসামিদের মধ্যে আরও আছেন ‘রাজনীতি’ সিনেমার পরিচালক বুলবুল বিশ্বাস ও প্রযোজক আশফাক আহমেদ।

মামলার আইনজীবী এম এ মজিদ বলেন, ২০১৪ সাল থেকে ইজাজুল এই নম্বরটি ব্যবহার করছেন। সেটি বিনা অনুমতিতে একটি সিনেমায় ব্যবহার করে আমার মক্কেলের অনেক ক্ষতি করা হয়েছে। একদিকে তার আয় রোজগার ব্যাহত হয়েছে আরেকদিকে, পারিবারিক হয়রানির শিকার হয়েছেন তিনি। ফলে প্রতারণা ও মানহানি মামলা দায়ের করা হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, এটি যদি এই উপমহাদেশের বাইরের কোনও ঘটনা হতো তাহলে বিনা অনুমতিতে একজনের ব্যক্তিগত নম্বর ব্যবহার করার অপরাধে সর্বোচ্চ শাস্তিই তাকে পেতে হতো। আমরা আশা করবো ন্যায়বিচার পাবো।

ব্যক্তিগত ফোন নম্বর ব্যবহার করায় ইজাজুলের কী ধরনের ক্ষতি হয়েছে এবং এমন প্রমাণ হলে কী ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হতে পারে প্রশ্নে এই আইনজীবী বলেন, এ মামলায় প্রতারণার অভিযোগে সর্বোচ্চ তিন বছর ও মানহানিতে সর্বোচ্চ দুইবছর কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন। যদি মামলার রায় আমাদের পক্ষে আসে তখন আমরা আর্থিক ক্ষতির জন্য আবারও আরেকটি মামলা করতে পারবো। এটি দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া।

নম্বর সিনেমায় থাকায় দিনে শত শত ফোন আসতে শুরু করে জানিয়ে ইজাজুল বলেন তার স্ত্রী ভুল বুঝে বাড়ি ছেড়েছেন, এখনও তার সঙ্গে কথা বলেন না। কী হয়েছিল জানতে চাইলে ইজাজুল হক বলেন, ‘আমার ব্যক্তিগত জীবন বলে কিছু ছিল না। গাড়ি চালাই আমি। সারাদিন কল আসতে থাকে, বেশির ভাগই মেয়েদের ফোন। তাদের যতই বোঝাই এটা শাকিব খানের নম্বর না, শুনতে চায় না। ফলে নম্বরটি বর্তমানে বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছি।’

ইজাজুলের ভাষ্য, ‘আমি সামাজিকভাবে হেয় হয়েছি। শুধু আমি নই, আমার পরিবারও হাস্যরসে পরিণত হয়েছে। আমি এর প্রতিকার চাই। অন্যের নম্বর না জানিয়ে ব্যবহার করাটা অন্যায়। তাই মামলাটি করেছি।’
‘রাজনীতি’ চলচ্চিত্রের গানের দৃশ্য। এই গানের আগেই নম্বরটি বলেন শাকিব। ডানে নম্বরটির প্রকৃত মালিক ইজাজুল। ব্যক্তিগত জীবনে হয়রানি সংক্রান্ত মামলার বিষয়ে মনজিল মোরসেদ বলেন,‘অবশ্যই একজনের নম্বর আরেকজনের ব্যবহার করা সমীচিন না। এ নম্বরের যার তার অনুমতি নিলে এক কথা, না নিলে যদি তিনি বিড়ম্বনায় পড়েন তাহলে তা প্রশ্ন তুলতে পারে।’

তিনি বলেন, মামলা হলেও মামলাগুলো মোটিভেটেড কিনা সেটাও দেখার আছে। যিনি ওই ফোন নম্বরটি তার কাজে ব্যবহার করেছেন তিনি কোন ইনটেনশন থেকে করেছেন তাও বিবেচনায় নিতে হবে। বাদীর কতটুকু ক্ষতি হয়েছে সেটি আদালতে প্রমাণ করতে হবে। তবে ক্ষতিগ্রস্তের আইনের দ্বারস্থ হওয়ার সুযোগ আছে, বাদী সেই সুযোগটা নিতে চেয়েছেন।

এধরনের অনৈতিক ঘটনার আইনি উদাহরণ সৃষ্টি হওয়া জরুরি উল্লেখ করে ব্যরিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, ‘আইনে সুস্পষ্টভাবে নাই, তবে ব্যক্তিগত ফোন নম্বর ব্যক্তিগত প্রোপার্টির ধারণা সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃত। যদিও মোবাইল ফোন নম্বর সার্ভিস প্রভাইডারের সম্পত্তি, ব্যাংকের চেকের মতোই। আমরা ব্যবহার করি তাই এটা আমারও মালিকানার অংশ।’

তিনি বলেন, ‘আমার নম্বর আপনি যেকোনও ভাবে বিনা অনুমতিতে আপনার নম্বর হিসেবে চালাবেন, এটা ব্যক্তিগত সম্পত্তি ধারণার পরিপন্থী। মালিকের অনুমতি না নিয়ে ব্যবহার করে থাকলে নীতি নৈতিকতার প্রশ্নে তা অন্যায় এবং ক্ষতিপূরণ পাওয়ার অধিকারী। তবে তার আসলেই মানহানি ও ক্ষতি হয়েছে এটা আদালতে প্রমাণ করতে হবে। এ হিসেবে এখানে তার (বাদীর) ক্ষতি হয়েছে। তিনি রিকশাচালক বলে তাকে যেনতেন ভাবে হেয় করা যাবে না। আইন সবার জন্য একই।’

শাকিব খান ও ইজাজুলনিরাপত্তা বিশ্লেষক ও বাংলাদেশ নেটওয়ার্ক অপারেটর্স গ্রুপ (বিডিনগ)-এর ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান সুমন আহমেদ সাবির বলেন, ‘এটা ভায়োলেশন অব প্রাইভেসি। এর জন্য অবশ্যই যিনি প্রাইভেসি ভেঙেছেন তার শাস্তি হওয়া উচিত। প্রথমত, অন্যের মোবাইল নম্বর সিনেমার নায়ক ব্যবহার করেছেন, দ্বিতীয়ত নম্বরটাকে পাবলিক করা হয়েছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘এ ধরনের কাজের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের আর্থিক দণ্ড হলে বিষয়টি উদাহরণ হিসেবে সামনে থাকবে এবং ভবিষ্যতে এরকম কোনও কাজ করা থেকে অন্যরা বিরত থাকবেন।
এ বিষয়ে জানতে মামলার অন্যতম আসামি ও ‘রাজনীতি’ চলচ্চিত্রটির পরিচালক বুলবুল বিশ্বাসের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘মামলার বিষয়ে আমি পত্র-পত্রিকা মারফত জানতে পেরেছি। এর কোনও কাগজপত্র আমার হাতে এসে পৌঁছায়নি। আসার পরে আমি আইনজীবীর মাধ্যমে আমার বক্তব্য জানাবো।’

বাংলাদেশ সময়: ১১৩৬ ঘণ্টা, ৩১ অক্টোবর    ২০১৭

লেটেস্টবিডিনিউজ.কম/এস পি