দীপিকা পাড়ুকোন বর্তমানে বলিউডের সর্বোচ্চ পারিশ্রমিক পাওয়া অভিনেত্রী ও ভারতের অন্যতম জনপ্রিয় অভিনেত্রী। হলিউডেও কাজ করেছেন। পেয়েছেন বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কার। মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে কয়েক বছর ধরে কাজ করছেন। অভিনয় ও দাতব্য কাজের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের টাইম ও ফোর্বস সাময়িকী ভারতীয় এই তারকাকে দিয়েছে প্রভাবশালী ব্যক্তির স্বীকৃতি। সম্প্রতি নিজের শিক্ষাজীবন নিয়ে দীপিকা কথা বলেন ব্যাচ অব ২০২০: বিয়ন্ড ডিগ্রিস অ্যান্ড সার্টিফিকেটস নামের একটি তথ্যচিত্রে। ৫ জুলাই তথ্যচিত্রটি ইউটিউবে প্রকাশিত হয়েছে।
আমি ড্রপআউট হই টুয়েলভথ স্ট্যান্ডার্ড (উচ্চমাধ্যমিক সমমান) শেষ করে। তখন বেঙ্গালুরুতে থাকতাম। সেই সময় মডেলিংয়ের প্রস্তাব পেতে শুরু করি, হাতে কাজ আসতে থাকে, অনেক সফর করতে হচ্ছিল। আর মনে হচ্ছিল প্রথাগত পড়াশোনার চাপ আমাকে আমার কাজ থেকে সরিয়ে রাখছে। তখন নিজেকে প্রশ্ন করি, আমি কি প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনার অভিজ্ঞতা ছাড়া শুধু নিজের কাজের দিকে পুরো মনোযোগ দিতে পারি? বিশ্ববিদ্যালয়ে না গিয়ে দূরশিক্ষণের মতো কিছু কি করতে পারি না?
পড়াশোনার সঙ্গে আমার ছিল দা-কুমড়া সম্পর্ক। মনে হতো জ্ঞান অর্জনের নিশ্চয়ই আরও উপায় আছে। সেটা ক্লাসে বসে বই ঘেঁটেই অর্জন করতে হবে, সফল হতে হবে, এমনটা মানতাম না। আমি সেই শিক্ষার্থী ছিলাম, যাকে ক্লাসের চেয়ে বেশি ক্লাসের বাইরের জগৎটা টানত। হোক সেটা থিয়েটার, খেলা, টিচার্স ডে, চিলড্রেন’স ডের অনুষ্ঠান বা বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা—এ সবে থাকতাম সবার আগে।
কোনো এক জায়গায় স্থির থাকতে পারতাম না। এমনকি এখনো, কোনো ছবির বর্ণনা অনেক লম্বা হলে আমি অস্থির হয়ে যাই। বড় বড় চিত্রনাট্য পড়তে গেলে অনেক পরিশ্রম করতে হয়, সময় লাগে। এক জায়গায় বসে লম্বা সময় ধরে শিক্ষকের কথা শোনার মতো স্থির বাচ্চা আমি কোনো দিনই ছিলাম না। মা এখনো বলেন, আমি নাকি প্রশ্ন করে অস্থির করতাম। এটা কেন হলো? ওটা কেন হলো? এমন কেন হলো না? নতুন কিছু জানার খুব আগ্রহ ছিল। কিন্তু সেটা এক জায়গায় স্থির থেকে নয়।
স্কুল আর কলেজ শেষ করেছিলাম রীতিমতো দমবন্ধ করে। কারণ এ ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না। এটুকু আমাকে করতেই হতো। নয়তো মা-বাবা বিব্রত হতেন। পড়াশোনা নিয়ে মা-বাবা একটা কথাই বলতেন, ‘আর যা-ই করো, ফেল কোরো না। তোমাকে সবচেয়ে বেশি নম্বর পেতে হবে না। তুমি শুধু পাস করে কলেজের গণ্ডি পার হও।’
পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়া নিয়ে আমার মধ্যেও ভয় ছিল। ভয় হতো, পাস না করলে আরও এক বছর একই ক্লাসে থাকতে হবে, এক বছর বেশি পড়তে হবে। এটাই চাইছিলাম না। শুধু চাইতাম জলদি স্কুল-কলেজের পাট চুকাতে।
স্কুল-কলেজের বন্ধুরা আমাকে খুব ভালো করে চিনত। তারা আমার চেয়ে অনেক ভালো শিক্ষার্থী ছিল। একদল ছিল সারা বছর আনন্দ, ফুর্তি, ঘোরাঘুরি আর দুষ্টুমি করেও পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করত। আর আরেক দল সারা বছর, সারা দিন বইয়ে মুখ গুঁজে থাকত। সেটাই ছিল তাদের আনন্দ। তাদের একটাই লক্ষ্য ছিল, ক্লাসে প্রথম হওয়া। এই দুই দলের কোনোটাতেই আমি পড়তাম না।
এমনকি কলেজে উঠে বেশ একা হয়ে গিয়েছিলাম। আমার কিছু বন্ধু ব্যস্ত হয়ে পড়ে ক্লাসে প্রথম হওয়ার জন্য, কারও আবার ব্যস্ততা কলেজের বিভিন্ন ক্লাবের কাজে। তখন খুব দ্বিধায় পড়ে গিয়েছিলাম। কারণ, আমি জানতাম আমি কোন দিকে যেতে চাই, আমার জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কী?
সেই সময়ে পেশাদার ব্যাডমিন্টন খেলতে শুরু করি। কলেজের পড়াশোনার বাইরে যে সময় পেতাম, ব্যাডমিন্টন খেলে কাটাতাম। সেটা হয়ে উঠেছিল কলেজের ক্লান্তি থেকে পাওয়া আমার একটুখানি অবসর। তাই কলেজের পর আমি যে আর পড়াশোনা করছি না, এটা আমার বন্ধুদের জন্য অবাক হওয়ার মতো কোনো বিষয় ছিল না।
মা-বাবার সঙ্গে বসে খোলামেলা কথা বলেছিলাম। সেটার দুটি অংশ ছিল। একটি হলো তাঁদের এটা বলা যে আমি মডেলিং আর অভিনয়কে পেশা হিসেবে নিতে চাই। ১৭ বছর বয়সে পড়াশোনা আর পেশাদার ব্যাডমিন্টন খেলা ছেড়ে যখন কেউ মডেলিংয়ে নাম লেখানোর সিদ্ধান্ত নেয়, তখন বুঝতে হবে সে তাঁর ভবিষ্যতের ব্যাপারে স্পষ্ট ধারণা আর সাহস নিয়েই এ কথা বলছে।
জীবনে আমি কী করতে চাই, তা নিয়ে আমি স্পষ্ট ছিলাম। অনেক দিনের স্বপ্ন থেকেই এ সিদ্ধান্ত। তাই মা–বাবার জন্য ওটা আসলে কোনো নতুন খবর বা ব্রেকিং নিউজ ছিল না। তাঁরা জানতেন, আমি কোন দিকে যেতে চাইছি। তাঁরা জানতেন, আমি পড়াশোনায় অত ভালো করছি না। এ–ও জানতেন, ছোটবেলা থেকেই আমার কাছে স্কুলের অনুষ্ঠানে অভিনয় করা, অংশ নেওয়া ছিল সবচেয়ে আনন্দের। কারণ, আমি ওটাই ভালো করতাম। তাই আমার সিদ্ধান্তে ধাক্কা খাননি।
বলতেই হবে, আমি আর আমার বোন ভীষণ ভাগ্যবান। কারণ, ছোটবেলা থেকেই মা-বাবা আমাদের আগ্রহের পেছনে ছোটার জন্য খুব উৎসাহ দিতেন। তবে হ্যাঁ, মা–বাবার কিছু প্রত্যাশা থাকে। আমাকে ঘিরে যেমন তখন তাঁদের প্রত্যাশা ছিল, আমি যেন অন্তত কোথাও থেকে কোনো রকমে স্নাতক ডিগ্রি নিই। তাই কলেজ শেষ করার পর মডেলিংয়ের পাশাপাশি ইন্দিরা গান্ধী ন্যাশনাল ওপেন ইউনিভার্সিটি থেকে পরীক্ষা দেওয়ার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু পরীক্ষায় অকৃতকার্য হই। এরপর আরও কয়েকবার মা-বাবার প্রত্যাশা পূরণের চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু আমাকে দিয়ে হয়নি। কিছুদিন আগে পুরোনো কাগজপত্র পরিষ্কার করছিলাম, তখন সেই পরীক্ষার রেজাল্টশিটগুলো খুঁজে পেলাম। প্রতিটিতে ‘অকৃতকার্য’ লেখা! কী বিব্রতকর!
কিন্তু মন থেকে একেবারে স্পষ্ট ছিলাম, আমি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা চাই না। যে পেশায় নিজেকে দেখতে চাই, সেটার জন্য পরিশ্রম করতে চাই। তাই ওই সময় ওই ব্যথর্তাগুলো এড়িয়ে কাজে ব্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম। সেটাই ছিল লক্ষ্য। আমি উচ্চমাধ্যমিক (দ্বাদশ শ্রেণি) পাস—এটা বলতে এখন আমার আর বিব্রত লাগে না। এই যোগ্যতা নিয়েই আমি আমার লক্ষ্যে পৌঁছাতে পেরেছি।
স্কুল-কলেজ থেকে অনেক কিছু শিখেছি, যা জীবনের নানা সময়ে কাজে লেগেছে; এখনো লাগছে। কিন্তু এগুলোর কোনোটাই পাঠ্যক্রম থেকে পাওয়া শিক্ষা নয়। এমন নয় যে ‘আরে হ্যাঁ, এটা তো শেক্সপিয়ারের অমুক বইয়ের ৫৯ নম্বর পৃষ্ঠায় পড়েছিলাম।’ আমি শিখেছি ছাত্রজীবনের সংস্কৃতি থেকে, পড়াশোনার রীতিনীতি আর নিষ্ঠা থেকে, সহশিক্ষা কার্যক্রম থেকে। জীবনের বড় শিক্ষাগুলো আমাকে দিয়েছে পাঠ্যপুস্তকের বাইরের জগৎ।