শিক্ষকরা শিক্ষার প্রধান শক্তি, একজন শিক্ষার্থীর মননে শিক্ষার গুরুত্ব ও প্রয়োজনকে ভাবিয়ে মূল্যবোধ ও নৈতিকতার চর্চা অনুশীলন করার যে মহৎ কাজ সেটি একজন আদর্শবান শিক্ষক করেন। একজন শিক্ষক শুধু শ্রেণিকক্ষে পাঠদান করেন না, শ্রেণিকক্ষে উপস্থিত সকল শিক্ষার্থীকে সবুজ পৃথিবীর শুভ স্বপ্ন দেখবার অনুপ্রেরণা দিয়ে থাকেন। একবাক্যে বলা যায় শিক্ষার্থীদের দেখবার শুদ্ধ আলো, চিন্তা করার সঠিক পদ্ধতি শিক্ষকরায় প্রতিস্থাপন করেন। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে শিক্ষকদের অনুরূপ কারুকার্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দৃশ্যমান হয়। কিন্তু উদ্বেগের বিষয় আমাদের দেশের শিক্ষকরা এখনো শিক্ষকদের প্রাপ্য মর্যাদা পাওয়ার উৎকণ্ঠা নিয়ে আছেন। দেশে দীর্ঘদিন ধরে মাধ্যমিক শিক্ষকরা আন্দোলন করছেন, শিক্ষকদের জাতীয়করণের দাবিতে।
বাংলাদেশের ৯৭ শতাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বেসরকারি তথা এমপিওভুক্ত। একই যোগ্যতা ও অভিন্ন সিলেবাস হওয়া সত্ত্বেও এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কর্মরত শিক্ষক-কর্মচারীরা আজ বিরাট বৈষম্যের শিকার; যার বাস্তব উদাহরণ হলো, এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের বাড়িভাড়া মাত্র এক হাজার টাকা ও চিকিৎসা ভাতা মাত্র ৫০০ টাকা। এটি বর্তমান যুগ অনুযায়ী একেবারেই বেমানান।
দেশের মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে ২২ হাজারের বেশি। এর মধ্যে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বাদে, সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্য মাত্র ৬৮৪টি। এই সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানর মাধ্যমিকে মোট শিক্ষার্থী ১ কোটি ১ লাখ ৯০ হাজার ২২। মোট শিক্ষক আছেন পৌনে তিন লাখের মতো।
বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো অধিকাংশ এমপিওভুক্ত হওয়ায় শিক্ষকরা সরকার থেকে বেতনের পাশাপাশি কিছু নামমাত্র ভাতা পেয়ে থাকেন। সরকারি-বেসরকারি শিক্ষকদের মধ্যে বিশাল বৈষম্য, অর্থাৎ একজন সরকারি শিক্ষক পূর্ণাঙ্গ বেতন, ভাতা ফেলেও একজন বেসরকারি শিক্ষক সে সেবা ঠিক মতো পান না। এছাড়াও শিক্ষকদের ১১ দফা দাবি রয়েছে। যা নিয়ে শিক্ষকরা লাগাতার আন্দোলন করছেন। গত বছরের জুলাই মাসে (১৭ জুলাই ২০২৩) আন্দোলনরত শিক্ষকদের ওপর পুলিশ হামলা করে, অসংখ্য শিক্ষক আহত ও লাঞ্ছিত হন। শিক্ষকরা জাতীর মেরুদণ্ড, আর সে শিক্ষকদের পুলিশ দিয়ে লাঠিপেটা কিংবা লাঞ্ছিত করা খুবই নিন্দনীয়। পরবর্তীতে এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে, শিক্ষক নেতা ও শিক্ষা মন্ত্রলায়ের সমঝোতায় শিক্ষকদের আশ্বাস দিলেও প্রকৃতপক্ষে মাধ্যমিক শিক্ষার জাতীয়করণ নিয়ে স্পষ্ট কোনো বক্তব্য শিক্ষা মন্ত্রণালয় বা সরকারের পক্ষ থেকে উঠে আসেনি।
শিক্ষকদের ন্যূনতম এই মৌলিক দাবি সময় উপযোগী ও যৌক্তিক। একটি গণতান্ত্রিক দেশে শিক্ষকদের সম্পূর্ণ পরিষেবা যদি সরকার প্রহণ না করে, এতে দেশের শিক্ষার ওপর মারাত্মক আঘাত আসবে। কেননা শিক্ষকরা যদি মানসিকভাবে তার প্রাত্যহিক জীবনের পরিষেবা নিশ্চিত নিয়ে চিন্তিত থাকেন। তাহলে শিক্ষা নিয়ে শিক্ষার্থী নিয়ে শিক্ষকদের বিশেষ কোনো অনুরক্তি কিংবা গুরুত্ব থাকবে না। যার ফলে দেশের শিক্ষা যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হবে, তেমনি দেশও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। “যে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত, সে দেশের সম্পূর্ণ ব্যবস্থায় ক্ষতিগ্রস্ত”।
অন্যদিকে মাধ্যমিক শিক্ষকরা যে বৈষম্যে আক্রান্তের দাবি করেছেন, সে বৈষম্য আন্দোলনের পরপর শিক্ষকদের ওপর প্রবলভাবে পড়েছে। শিক্ষকদের নানাভাবে প্রভাবিত করা, বেতন, ভাতা দেওয়ার ক্ষেত্রে সময়ক্ষেপণ করা। নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের লক্ষ্যে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে সারাদেশে মাধ্যমিক শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছে, এবং সে অনুযায়ী প্রশিক্ষণ কর্মশালাও শেষ করা হয়েছে। কিন্তু শিক্ষকদের পরিপূর্ণ প্রশিক্ষণ ভাতা এখনো সম্পূর্ণভাবে দেওয়া হয় না। শিক্ষকরা যদি সংকটে থাকে তাহলে শিক্ষাদান কতোটা কঠিন সেটা ভেবে দেখা দরকার। কথায় বলে ‘পেটে খেলে পিঠে সয়’ কিন্তু শিক্ষকদের প্রতি বিমাতাসুলভ আচরণ আসলে কতোটা যুক্তিযুক্ত সেটাও ভেবে দেখা দরকার। শিক্ষকদের পারিবারিক সংকট থেকে তারা মুক্ত হতে পারছে না। দ্রব্যমূল্য বাড়ছে, বাড়ছে বাড়িভাড়া, জীবন-যাপনের খরচ কিন্তু শিক্ষকদের চাকরি কোনো মতেই জাতীয়করণ হচ্ছে না। শিক্ষকরা তাহলে যাবে কোথায়? এসব বিষয় নিয়ে শিক্ষকরা প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ। এটা অত্যন্ত বেদনাদায়ক।
সুতরাং সরকরের প্রতি আহ্বান মাধ্যমিক শিক্ষকদের জাতীয়করণের দাবি মেনে নিয়ে, সমস্ত ধরনের বৈষম্য দূর করে শিক্ষকদের দুশ্চিন্তা মুক্ত করুন। যাতে দেশের শিক্ষকগণ প্রাণ খুলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের পাঠদান করাতে পারেন।