ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কবি সুফিয়া কামাল হলের একটি নোটিশকে কেন্দ্র করে সামাজিক মাধ্যমসহ গণমাধ্যমে আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়। ফেসবুকে ভাইরাল হওয়া নোটিশে “ছাত্রীদের হলের অভ্যন্তরে দিনের বেলা অথবা রাতের বেলা কখনোই অশালীন পোশাক (সালোয়ারের ওপর গেঞ্জি) পরে ঘোরাফেরা অথবা হল অফিসে কাজের জন্য প্রবেশ করা যাবে না। অন্যথায় শৃঙ্খলাভঙ্গের জন্য হল কর্তৃপক্ষ বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।”- এরকম ভাষায় টাইপ করা নির্দেশনা ছিল যা নিয়ে পড়ে তুমুল বিতর্ক শুরু হয়।
এরপর পরই হল প্রশাসন ‘অশালীন পোশাক’ এর জায়গায় ‘যথাযথ পোশাক’ লিখে আরেকটি নোটিশ দেয়। হল কর্তৃপক্ষের সই ছাড়া ওই নোটিশটি আদৌ হল কর্তৃপক্ষের ছিল কিনা, এ নিয়ে আলোচনা হয় বেশি। একপক্ষ ওই নোটিশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিপক্ষে ষড়যন্ত্র হিসেবে প্রমাণ করতে ‘নোটিশটি হল কর্তৃপক্ষের নয়’ এই যুক্তি দিতে থাকেন। যদিও প্রভোস্টের সই ছাড়াই হলে নোটিশ দেয়া হয় বলে বৃহস্পতিবার সাংবাদিকদের কাছে স্বীকার করেছিলেন হলের প্রভোস্ট ড. সাবিতা রিজওয়ানা রহমান।
শুক্রবার বিষয়টি নিয়ে হলটির সাবেক ছাত্রলীগ সভাপতি এবং ছাত্রলীগের বর্তমান সাহিত্য বিষয়ক সম্পাদক খালেদা হোসেন মুন ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দেন। প্রথম নোটিশটি যে হল কর্তৃপক্ষই দিয়েছিলেন, এই বিষয়টি তিনি স্পষ্ট করে উল্লেখ করেন তার স্ট্যাটাসে। ওই স্ট্যাটাসে তিনি ঘটনার নানা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে লিখেছেন।
খালেদা হোসেন মুন তার স্ট্যাটাসে লেখেন, ‘তদন্ত কমিটির অগ্রগতি কতটুকু?
উত্তরটা আমিই দেই। গতকাল বিকাল ৩টার পরে ম্যাডামরা পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের এক ছাত্রীকে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। তার দোষ সে ফেসবুকে সুফিয়া কামাল হলের গ্রুপে প্রতিবাদি কমেন্ট করেছে এবং সেই স্ক্রীনশট ম্যাডামদের কাছে আছে। ম্যাডামদের ভাষ্যমতে সেই স্ক্রীনশট নাকি ছাত্রীদের কাছ থেকেই পাওয়া। ম্যাডামদের প্রশ্নের উত্তরে মেয়েটি খুবই সাহসী উত্তর দিয়েছে, “যেই স্ট্যাটাসে আমি কমেন্ট করেছি সেখানে তো আরও ৩২টা কমেন্ট আছে, আপনারা তাদেরকে ডাকছেন না কেন?”
এর পরে ম্যাডামরা তাকে যখন বলে যে প্রথম নোটিশটি হল থেকে দেয়া হয় নি, তখন মেয়েটি উত্তর দিয়েছে, “আমি এবং আমার রুমমেট নিজে চোখে দেখেছি দাদুকে নোটিশ লাগাতে। সেই দাদুতো হলেই আছে এখন। আপনারা দাদুকে ডেকে জিজ্ঞাসা করেন।“
ম্যাডামরা নাকি তখন দাদুকে ডেকে জিজ্ঞাসা করেন নি। আমার প্রশ্ন, কেন?
তারপর মেয়েটি যেই প্রশ্ন করেছিল ম্যাডামদেরকে তার জন্য ম্যাডামরা প্রস্তুত ছিলেন না, “ম্যাডাম আমি কমেন্ট করেছি বলে কি এখন আমার সিট কেটে দিবেন?”
আমাদের শ্রদ্ধেয় ম্যাডামরা তখন নাকি মেয়েটিকে অনুরোধ করেছিল দ্বিতীয় নোটিশ ফেসবুকে পোস্ট করার জন্য। কারণ মেয়েটি হলের একজন খেলোয়াড়, সে সবধরনের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে এবং নন-পলিটিক্যাল হওয়া সত্ত্বেও হলে তার জনপ্রিয়তা আছে।
এইসব নাটকের কি কোন দরকার ছিল?
১ম নোটিশ দেখার সাথে সাথে মেয়েরা যখন আমাকে বিষয়টা জানালো, তখন আমি প্রত্যেককে বলেছি, নোটিশটা ঠিকই আছে, শুধু আদেশ না করে ‘অনুরোধ’ করে লিখলেই কিন্তু মেয়েরা মেনে নিত। কেউ কোন প্রশ্নই তুলত না।
মেয়েরা যখন প্রতিবাদ করল তখন কি দাঁড়ালো? হল প্রশাসন সংশোধন করে আরেকটি নোটিশ দিল। আমার প্রশ্ন, হল প্রশাসন যদি প্রথম নোটিশ না দিয়ে থাকে, তাহলে সংশোধন করে দ্বিতীয় নোটিশে আগের কথাগুলোই অন্যভাবে কেন লিখে দিবে?
আর তৃতীয় নোটিশ দেওয়া হল তদন্ত কমিটি গঠন করে। আমরা জানি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যখনই কোন কিছু ধামাচাপা দিতে চায় তখনই এমন একটা করে তদন্ত কমিটি গঠন করে এবং ‘ক্যাম্পাস অস্থিতিশীল করার অপচেষ্টা’ নাম লাগিয়ে দেয়।
সমস্যার সমাধান কিন্তু খুবই সহজভাবে করা যেত। হল প্রশাসন একটা নোটিশ দিয়ে ভাষাগত ত্রুটির জন্য ছাত্রীদের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিলেই সব চুপ হয়ে যেত।
সমাধান তো হলই না। মাঝখান দিয়ে কি হল?
কিছু সাংবাদিকের গায়ে ‘হলুদ সাংবাদিক’ সিল লাগল। কবি সুফিয়া কামাল হলের কিছু প্রতিবাদী সাধারন ছাত্রীর গায়ে ‘বামদল’ সিল লাগল। কিছু ছাত্রলীগ নেতা-নেত্রী যারা সত্যটা নিয়ে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিল তাদের গায়ে ‘ষড়যন্ত্রকারী কিংবা অনুপ্রবেশকারী’ এই অপবাদটা লাগল।
আমার ছাত্রলীগের ভাই-বোনরা যারা প্রশাসনের পক্ষে স্ট্যাটাস দিলেন তাদের কাছে আমার প্রশ্ন, বঙ্গবন্ধু কি আমাদেরকে এই আদর্শ দিয়ে গেছেন? বঙ্গবন্ধু কি আমাদের মিথ্যাকে সমর্থন দিতে বলেছেন?
যাই হোক শাপে বর হয়েছে একটা জিনিস, কবি সুফিয়া কামাল হলের ছাত্রীরা দেখিয়ে দিয়েছে তাদের ক্ষমতা কতখানি।
বিঃদ্রঃ যেই ছাত্রীর সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনা আমি শেয়ার করলাম, তার অনুরোধেই আমি তার নাম প্রকাশ করলাম না। তার কাছ থেকে আমাদের সবারই অনেক কিছু শেখার আছে।
বাংলাদেশ সময়: ১৪১১ ঘণ্টা, ২৬ আগস্ট ২০১৭
লেটেস্টবিডিনিউজ.কম/এসএফ