জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) কর্তৃক সরবরাহ করা বিনামূল্যের পাঠ্যবইয়ে নানা ভুল পাওয়া গেছে। কোনো বইয়ে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ভুল; কোনো বইয়ে ভুল হয়েছে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উপস্থাপনের ক্ষেত্রে। বানান ভুল তো আছেই। বিষয়টি নিয়ে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়েছে এনসিটিবি। তারা জানেও না এসব ভুলের দায় কার। কেউ কেউ মনে করেন, বইয়ের পাঠে যা যাচ্ছে, তার দায় লেখকদের। ভুলের কারণ হিসেবে কেউ প্রশ্ন তুলেছেন এনসিটিবির সক্ষমতা নিয়ে। বলা হচ্ছে, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানটি বছরজুড়েই নতুন বই ছাপানো আর সরবরাহ করা নিয়ে ব্যস্ত থাকে, শিক্ষাক্রম প্রণয়ন ও গবেষণার মতো কাজের জন্য সময়ই পায় না। বছরজুড়ে সময় দেওয়ার পরও অবশ্য পাঠ্যবইয়ের প্রায় কার্যক্রমই সম্পন্ন করতে হয় আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে।
ভুল সংশোধনে জরুরি ভিত্তিতে কাজ শুরু করেছে এনসিটিবি। পাঠ্যবই এরই মধ্যে শিক্ষার্থীদের হাতে চলে যাওয়ায় ‘সংশোধনী’ পাঠানো হবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে।
২০২৩ শিক্ষাবর্ষের নবম-দশম শ্রেণির ‘বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয়’ পাঠ্যবইয়ের ১৬ নম্বর পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে ‘পাকিস্তানি বাহিনী ঢাকার রাজারবাগ পুলিশ ক্যাম্প, পিলখানা ইপিআর ক্যাম্প ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় আক্রমণ চালায় ও নৃশংসভাবে গণহত্যা ঘটায়।’ এখানে তথ্যগত দুটি ভুল আছে- প্রকৃতপক্ষে রাজারবাগে ছিল পুলিশ লাইনস, আর পিলখানায় ছিল ইপিআর সদর দপ্তর। গত বছরের বইয়েও একই ভুল ছিল। একই শ্রেণির ‘বাংলাদেশের ইতিহাস ও বিশ্বসভ্যতা’ বইয়ের ২০০ নম্বর পৃষ্ঠায় বলা আছে, ‘১২ই জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রধান বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েমের নিকট প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথগ্রহণ করেন।’ এ তথ্যও সঠিক নয়। প্রকৃতপক্ষে বঙ্গবন্ধুকে শপথ পড়িয়েছিলেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী। পরদিন অর্থাৎ ১৯৭২ সালের ১৩ জানুয়ারি ঢাকার সব দৈনিকের প্রথম পাতায় এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন প্রকাশ হয়। একই বইয়ের ১৮১ পৃষ্ঠায় ‘অবরুদ্ধ বাংলাদেশ ও গণহত্যা’ অনুচ্ছেদে উল্লেখ আছে, ‘২৬ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশজুড়ে পাকিস্তান সামরিক বাহিনী নির্যাতন, গণহত্যা আর ধ্বংসলীলায় মেতে ওঠে।’ প্রকৃত তথ্য হলো, পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর নির্যাতন, গণহত্যা ও ধ্বংসলীলা শুরু হয় ২৫ মার্চ কালরাতে।
ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবিরের কাছে এসব ভুলের ব্যাপারে প্রতিক্রিয়া জানতে চেয়েছিল দেশের একটি শীর্ষ স্থানীয় পত্রিকা। করণীয় কী, সে বিষয়েও কথা বলেছেন তিনি। শাহরিয়ার কবির বলেন, ‘প্রথমত পাঠ্যবইয়ে কোনো ভুল কাম্য নয়। ভুল দ্রুত সংশোধন বা পরিমার্জন করে দ্রুত শিক্ষার্থীর কাছে বই পৌঁছাতে হবে। ভুলগুলোর সংশোধনী নোট শিক্ষকদের দিতে হবে; তারা পাঠদানের সময় সঠিক তথ্যই পড়াবেন।’
বাংলাদেশের স্বাধীনতা নিয়ে একাধিক বইয়ের লেখক শাহরিয়ার কবির আরও বলেন, ‘কারা এসব ভুলের জন্য দায়ী, তাদের চিহ্নিত করে জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে।’
এনসিটিবির সাবেক এক কর্মকর্তা বলেন, পাণ্ডুলিপি থেকে চূড়ান্ত বইয়ে রূপ দেওয়ায় এ বিশদ কর্মযজ্ঞের জন্য দক্ষ জনবল নেই এনসিটিবির। বই ছাপানো থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সরবরাহের কাজ তদারকি করতেই গলদগর্ম হতে হয় তাদের। তিনি আরও বলেন, কারিকুলাম অনুযায়ী বই লেখার জন্য লেখক নির্বাচিত করা হয়। বিষয়ভিত্তিক ‘প্রথিতযশা’ বরেণ্যদের দ্বারাই লেখানো হয়। তাদের তত্ত্বাবধানে তৈরি করা হয় বইয়ের প্রচ্ছদ থেকে পাঠ্যগল্পের সামঞ্জস্য চিত্র। এসব কাজে এনসিটিবির হস্তক্ষেপ নেই। এনসিটিবি শুরুতে লেখক ও চিত্রকরদের ওরিয়েন্টেশন করে বিষয়ভিত্তিক ধারণা দিয়ে থাকে। বইয়ের পাঠে কী গল্প, কোন তথ্য উপস্থাপন করেছেন লেখকরা, সেটির দায় শুধুই লেখকের। কেননা, তারাই বইয়ের পাণ্ডুলিপি থেকে বইয়ে রূপ দেওয়া পর্যন্ত তত্ত্বাবধানে থাকেন। প্রাতিষ্ঠানিক অনুমোদন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে এনসিটিবি।
এনসিটিবির একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিষয়ভিত্তিক পাঠ্যবই তৈরির পর ত্রুটিবিচ্যুতি দেখার জন্য দেশের ‘প্রথিতযশা’ ব্যক্তিদের কাছে দেওয়া হয়। তারা দেখার পরেই চূড়ান্ত করা হয় বই। এখন প্রশ্ন উঠেছে, তা হলে ‘প্রথিতযশাদের’ বই দিয়ে লাভ কী। কোনো কোনো কর্মকর্তা মনে করেন, ‘প্রথিতযশা’ ব্যক্তিরা অন্যান্য কাজে অনেক ব্যস্ত থাকেন; এ কাজে তারা পর্যাপ্ত সময় দিতে পারেন না। ফলে ভুলের দায় সরাসরি তাদের ওপর চাপানোটা মুশকিল।
পাঠ্যবইয়ে মুক্তিযুদ্ধের তথ্য ভুলের প্রসঙ্গে অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট জেনারেল এম হারুন উর রশীদ বীরপ্রতীক স্থানীয় ওই পত্রিকাকে বলেন, ‘আমরা একটি দাবি জানিয়ে আসছি সরকারের কাছে, সেটি পূরণ হচ্ছে না। একটি স্বাধীন দেশের জাতীয় ইতিহাস কমিশন গঠন করতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের সঠিক তথ্য জানার ক্ষেত্রে আজ যে সংকট তৈরি হয়েছে, এটি তখন হবে না। আজ থেকে ১০ বছর পর কজন মুক্তিযোদ্ধা পাওয়া যাবে? কিন্তু যদি ইতিহাস কমিশন যাচাই-বাছাই করে সঠিক তথ্য দিয়ে দলিল তৈরি করত, তা হলে সে দলিলের তথ্যই বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করা যেত। এ নিয়ে কোনো বিতর্ক তৈরি হতো না। কিন্তু সে কাজটি কোনো সরকার করেনি। মুক্তিযুদ্ধের সঠিক তথ্য আমাদের নতুন প্রজন্মের কাছে পৌঁছানো জরুরি।’
এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ফরহাদুল ইসলাম স্থানীয় ওই পত্রিকাকে বলেন, ‘পাঠ্যবইয়ে কিছু ভুল আমাদের নজরে এসেছে। ভুলগুলো যথাযথভাবে চিহ্নিত করে তা সংশোধনীর তথ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠানো হবে। সংশোধনী নোট শিক্ষকদের কাছে সরাসরি পৌঁছানোর জন্য মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের সহযোগিতা নেব। এ বিষয়ে তাদের সঙ্গে আলাপ হয়েছে। শিক্ষকদের জন্য নির্ধারিত ওয়েবপোর্টালে এ তথ্য আপলোড দিয়ে সব শিক্ষকের কাছে পৌঁছানো যাবে।
তিনি বলেন, বইয়ে কী ধরনের ‘ভুল’ আছে, সেসব বিষয়ে এনসিটিবি একটি কমিটি করে পরিমার্জনের উদ্যোগ নিয়েছে। ইতিমধ্যে প্রধান সম্পাদকের নেতৃত্বে একটি দল কাজ শুরু করে দিয়েছে।
‘বাংলাদেশের ইতিহাস ও বিশ্বসভ্যতা’ বইয়ে পাঠ্যবাক্যে একাধিকবার ‘সময়কাল’ শব্দ উল্লেখ আছে। সময় ও কাল দুটি শব্দ, তবে একই অর্থ। তাই যে কোনো একটি ব্যবহার হবে। একই পৃষ্ঠায় এক জায়গায় আছে ‘নদ-নদীগুলো’। ‘নদনদী’ শব্দটিই বহুবচন। যতিচিহ্ন-কোলনের ব্যবহারও অনেক ক্ষেত্রে সঠিক হয়নি। কোনো কোনো বইয়ে ‘পরিপ্রেক্ষিত’ শব্দের বদলে ‘প্রেক্ষিত’ ছাপা হয়েছে।
নবম-দশম শ্রেণির ‘পৌরনীতি ও নাগরিকতা’ বইয়ের প্রথম অধ্যায়ে (পৃষ্ঠা-১) ‘অংশগ্রহণের’ বদলে ‘অংশগ্রহনের’ ছাপা হয়েছে। ‘ছিল না’-র বদলে ছাপা হয়েছে ‘ছিলনা’। এই বইয়েও কোলনের ব্যবহার বেশির ভাগই ভুল। বিতরণ করা অধিকাংশ পাঠ্যবইয়েই হাইফেন, ড্যাশ ও কোলনের ভুল ব্যবহার দেখা গেছে। এ ছাড়া গত বছরের মতো বিভিন্ন বইয়ে একই ভুল এবারও ছাপা হয়েছে।
এনসিটিবির সদস্য (কারিকুলাম) অধ্যাপক মশিউজ্জামান বলেন, ‘২০১৭, ২০২০ ও ২০২১ সালেও নানা ধরনের ভুল সংশোধন করা হয়েছে। এরপরও কীভাবে ভুল রয়ে গেছে, বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে।’
সংবাদ সূত্রঃ আমাদের সময়