মহামারী করোনার কারনে বন্ধ থাকা ক্যাম্পাস খোলার দাবিতে উত্তাল হয়ে উঠেছে দেশের বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলো। এরই মধ্যে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা তিন দিন ধরে নিজেরাই আবাসিক হলগুলোর তালা ভেঙে হলে থাকতে শুরু করেছেন। গতকাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) দুটি আবাসিক হলে প্রবেশ করেন ছাত্ররা। ক্যাম্পাস ও আবাসিক হল খুলে দেওয়ার দাবিতে গতকাল দিনভর উত্তাল ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (শাবিপ্রবি)সহ বেশ কয়েকটি উচ্চবিদ্যাপীঠ।
এমন পরিস্থিতিতে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি গতকাল বেলা ২টায় সংবাদ সম্মেলন করে ২৪ মে বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠদান শুরু ও ১৭ মে ক্যাম্পাসের আবাসিক হলগুলো খুলে দেওয়ার ঘোষণা দেন। এর পরও মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে শিক্ষার্থীরা হলে ওঠার দাবিতে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন।
জানা যায়, করোনার কারণে ১১ মাস ধরে বন্ধ থাকা হলগুলো খুলে দেওয়ার দাবিতে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে দিনভর বিক্ষোভ মিছিল, স্মারকলিপি পেশ ছাড়াও জোর করে হলে উঠে যাওয়ার ঘটনা ঘটে। একই দাবিতে প্রশাসনকে আলটিমেটাম দিয়েছেন আন্দোলনকারীরা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবেদক জানান, গতকাল দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ হলে অর্ধশতাধিক শিক্ষার্থী প্রবেশ করেন। কয়েকজন শিক্ষার্থী বলেন, হলের গেট খোলা ছিল তাই তারা প্রবেশ করেছেন। এতে তাদের কেউ বাধা দেয়নি। তারা বলেন, ‘শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো ছাড়া অফিস-আদালতসহ সবকিছুই চলছে। তাহলে আমরা আর কীসের জন্য অপেক্ষা করব? স্থায়ীভাবে থাকার পরিকল্পনা নিয়েই এসেছি।’ একই সময় হলে উঠতে বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী অমর একুশে হলের সামনে ভিড় জমান। এ সময় হলের মূল প্রবেশপথ পেরিয়ে হল খুলে দেওয়ার দাবিতে স্লোগানও দেন তারা। তবে বিকালে হল থেকে নেমে যান শহীদুল্লাহ হলে ওঠা শিক্ষার্থীরা।
ক্যাম্পাস ও হল খুলে দেওয়ার দাবিতে বিকালে রাজু ভাস্কর্যের সামনে ছাত্রসমাবেশ করেন শিক্ষার্থীরা। এ সময় ১ মার্চ থেকে হলগুলো খুলে দিতে ৭২ ঘণ্টার আলটিমেটাম দেন তারা। আন্দোলনকারীদের মুখপাত্র জুনাইদ হুসেইন খান বলেন, ‘সেশনজট যাতে আর দীর্ঘায়িত না হয় সে জন্য মার্চ থেকেই যেন হল খুলে দেওয়া হয়। আমরা মার্চ থেকে হলে উঠতে চাই। ৭২ ঘণ্টার আলটিমেটাম দিচ্ছি। এর মধ্যে মার্চে হল খোলার বিষয়ে লিখিতভাবে নোটিস দিতে হবে।’ পরে একটি বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে উপাচার্য কার্যালয়ে যান আন্দোলনকারীরা।
তারা হল খোলার দাবিসংবলিত স্মারকলিপি উপাচার্যের কাছে পেশ করেন। উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান পরে সাংবাদিকদের বলেন, ‘একাডেমিক কাউন্সিল সিদ্ধান্ত নিয়েছিল ১৩ মার্চ থেকে অনার্স ও মাস্টার্সের পরীক্ষার্থীদের হলে রেখে পরীক্ষা নেওয়ার। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আমরা আগামীকাল (আজ) জরুরি ভিত্তিতে একাডেমিক কাউন্সিলের সভা ডেকেছি। সেখানে আমাদের জাতীয় সিদ্ধান্ত, শিক্ষার্থীদের ভ্যাকসিনেশনের আওতায় আনা, তাদের হলে ওঠানো এবং পরীক্ষার তারিখগুলো নিয়ে আলোচনা হবে।’
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি জানান, গতকাল দিনভর শিক্ষার্থীদের হল থেকে বের করতে একের পর উদ্যোগ নিয়ে ব্যর্থ হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। রবিবার দিবাগত রাত ১টায় হল ত্যাগের বিজ্ঞপ্তি জারি করে তারা। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, সোমবার (গতকাল) সকাল ১০টার মধ্যে হল ত্যাগ করতে হবে। এর পরও কেউ হলে অবস্থান করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এরপর দুপুরে শিক্ষামন্ত্রীর ঘোষণার পর শিক্ষকরা আরেক দফা চেষ্টা করেন শিক্ষার্থীদের হল থেকে বের করতে। কিন্তু এবারও শিক্ষার্থীরা তাদের সিদ্ধান্তে অটল থাকেন।
শিক্ষার্থীরা বলছেন, জাহাঙ্গীরনগরের পরিস্থিতি অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো নয়। এখানকার অনেক শিক্ষার্থী ক্যাম্পাস-সংলগ্ন বিভিন্ন স্থানে অবস্থান করছেন। গেরুয়া গ্রামের বাসিন্দাদের অতর্কিত হামলার পর এসব স্থানে শিক্ষার্থীরা আর মোটেই নিরাপদ নন। এই ভিন্ন পরিস্থিতি কর্তৃপক্ষকে বুঝতে হবে। এ কারণেই তারা হলে অবস্থানের বিষয়ে অনড় রয়েছেন।
জাহাঙ্গীরনগরের শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, শুক্রবার জাবি-সংলগ্ন গেরুয়া গ্রামের মসজিদের মাইকে ঘোষণা দিয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর অতর্কিত হামলা চালান স্থানীয়রা। এতে ৪০ জন শিক্ষার্থী আহত হন। গুরুতর অবস্থায় সাভারের এনাম মেডিকেলে এখনো চিকিৎসাধীন রয়েছেন ১১ শিক্ষার্থী। ওই হামলার পর গেরুয়া এবং পাশের এলাকায় ভাড়া থাকা শিক্ষার্থীদের সেখানে অবস্থান অনিরাপদ হয়ে পড়েছে। এমন পরিস্থিতিতে প্রশাসন হল খুলে না দেওয়ায় বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা শনিবার নিজেরাই আবাসিক হলগুলোর তালা ভেঙে হলে থাকতে শুরু করেছেন।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবেদক জানান, ১ মার্চ হলে প্রবেশ করতে চান রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) শিক্ষার্থীরা। গতকাল বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের পেছনে লাগাতার বিক্ষোভ কর্মসূচিতে এ ঘোষণা দেন তারা। শিক্ষার্থীরা বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) যেহেতু হল খোলার বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের সঙ্গে মিটিংয়ে বসবে, আমরা আশা করি মিটিংয়ে একটা যৌক্তিক সিদ্ধান্ত আসবে। যদি যৌক্তিক কোনো সিদ্ধান্ত না আসে তাহলে আমরা ২৫ ফেব্রুয়ারি সংবাদ সম্মেলন করে পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা করব।’
এ সময় শিক্ষার্থীদের পক্ষে খাইরুল ইসলাম দুখু বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে আমরা ক্যাম্পাসের বাইরে অবস্থান করছি। আর করোনার কারণে আমাদের অর্থনৈতিক অবস্থাও অনেকটা নাজুক। ফলে আর আমাদের মেসে থাকা সম্ভব হচ্ছে না। আমরা হলে ফিরতে চাই।’
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি জানান, আবাসিক হল খুলে দেওয়ার দাবিতে গতকাল দ্বিতীয় দিনের মতো বিক্ষোভ মিছিল ও অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষার্থীরা। ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ মিছিল ও আবাসিক হলের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন তারা। বেলা সাড়ে ১১টায় ক্যাম্পাসের ডায়ানা চত্বর থেকে শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ মিছিল শুরু করেন। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের হল ও ক্যাম্পাস খোলা-সম্পর্কিত সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে প্রতিবাদ জানান শিক্ষার্থীরা। একই সঙ্গে মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার দাবি জানান তারা। আজ সকালে সংবাদ সম্মেলন করে পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে বলে জানিয়েছেন আন্দোলনকারীরা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. শেখ আবদুস সালাম বলেন, হল খোলার ব্যাপারে সরকার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে সেটাই চূড়ান্ত। পরীক্ষার বিষয়ে তিনি বলেন, আগামীকাল অনুষদীয় ডিনদের নিয়ে সভা ডাকা হয়েছে। সেখানে পরীক্ষার ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
বরিশাল থেকে নিজস্ব প্রতিবেদক জানান, আবাসিক হল খুলে দেওয়ার দাবিতে রবিবার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনের নিচে খোলা জায়গায় রাতযাপন করেন কিছু শিক্ষার্থী। হল খুলে না দেওয়া পর্যন্ত এখানে রাতযাপন অব্যাহত রাখার কথা জানিয়েছেন তারা। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে শিক্ষার্থীরা অনিরাপদ উল্লেখ করে রবিবার রাত ১০টার দিকে কিছু শিক্ষার্থী প্রশাসনিক ভবনের নিচে খেলা জায়গায় অবস্থান নেন। তারা চটের বস্তার ওপর গায়ের চাদর, কাঁথা, কম্বল, বালিশ নিয়ে সেখানে রাতযাপন করেন। শিক্ষার্থী মাহমুদ হাসান তমাল বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়েছে। অথচ আবাসিক হল খুলে দেওয়া হয়নি। হল খুলে না দেওয়ায় শিক্ষার্থীরা বিপাকে পড়েছেন। বাইরে শিক্ষার্থীরা নানাভাবে নির্যাতন ও ছিনতাইয়ের শিকার হচ্ছেন। ক্যাম্পাস খুলে দেওয়ার দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসের প্রশাসনিক ভবনের নিচে রাতযাপন অব্যাহত রাখবেন।’
শিক্ষার্থী সিয়াম জামান জানান, গভীর রাতে মেসে ঢুকে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের নির্যাতনকারীদের গ্রেফতার, চিহ্নিতদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের, শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা প্রদানের তিন দাবি এখন পর্যন্ত আদায় হয়নি। শিক্ষার্থীরা এখনো নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। এ কারণে তারা দ্রুত আবাসিক হল খুলে দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন। মঙ্গলবার রাতে নগরীর রূপাতলী হাউজিংয়ের বিভিন্ন মেসে ঢুকে বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তত ২০ জন শিক্ষার্থীকে নির্যাতন করে দুর্বৃত্তরা। এরপর শুক্রবার রাতেও রূপাতলী হাউজিংয়ে খুলনা থেকে আগত বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিক্ষার্থী ছিনতাইয়ের শিকার হন। এদিকে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলাকারী চিহ্নিতদের গ্রেফতার দাবিতে গতকাল বিকালে ঢাকা-বরিশাল-কুয়াকাটা মহাসড়কে বিক্ষোভ মিছিল করেন বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (ববি) শিক্ষার্থীরা। একই সঙ্গে তারা প্রতিবাদী পোস্টারও প্রদর্শন করেন।
শাবিপ্রবি প্রতিনিধি জানান, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে চলমান সব পরীক্ষা স্থগিত ঘোষণা করা হয়েছে। গতকাল উপাচার্য অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদ এ তথ্য নিশ্চিত করেন। সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয় খোলার পর ¯œাতক প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় বর্ষের পরীক্ষা নেওয়া হবে। বর্তমানে চলমান বাকি পরীক্ষাগুলোও নেওয়া হবে ওই সময়। এর আগে ২৩ ফেব্রুয়ারির মধ্যে সব আবাসিক হল খুলে দেওয়ার ব্যাপারে প্রশাসনকে শনিবার আলটিমেটাম দেন শিক্ষার্থীরা। শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শেকৃবি) আবাসিক হলগুলোয় অবস্থানরত শিক্ষার্থীদের আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে হল ত্যাগের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। গতকাল সন্ধ্যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচটি হলের প্রভোস্টদের স্বাক্ষরিত পাঁচটি আলাদা নোটিসের মাধ্যমে এ নির্দেশনা দেওয়া হয়।
নোটিসে বলা হয়েছে, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলও বন্ধ রয়েছে। প্রশাসনের দৃষ্টিগোচর হয়েছে সাম্প্রতিক সময়ে হলগুলোয় অননুমোদিতভাবে কিছুসংখ্যক শিক্ষার্থী অবস্থান করছেন, যা সরকারি সিদ্ধান্তের পরিপন্থী। সরকার কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত অমান্য করে শিক্ষার্থীদের আবাসিক হলে অবস্থান করার কোনো সুযোগ নেই। যেসব শিক্ষার্থী অননুমোদিতভাবে হলে অবস্থান করছেন, তাদের আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে হল ত্যাগ করার নির্দেশ দেওয়া যাচ্ছে।’
উল্লেখ্য, দেশে প্রথম করোনাভাইরাস শনাক্ত হয় গত বছর ৮ মার্চ। এরপর সংক্রমণের ঝুঁকি এড়াতে ১৭ মার্চ থেকে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়। পরিস্থিতি বিবেচনায় দফায় দফায় বাড়ে ছুটি। সে ছুটি চলমান রয়েছে। সব শেষ ১৪ ফেব্রুয়ারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছুটি ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বাড়ানো হয়।