পরিচালনা কমিটির সভাপতি এবং অধ্যক্ষের পাল্টাপাল্টি অভিযোগে অস্থির পরিস্থিতি বিরাজ করছে রাজধানীর শেখ বোরহানুদ্দীন পোস্ট গ্র্যাজুয়েট কলেজে। কলেজের প্রায় ৮৪ কোটি টাকার তহবিল ঘিরেই মূলত এই সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে।
শিক্ষকদের অভিযোগ, কলেজের নামে জমি কেনা নিয়ে অনিয়ম হয়েছে। এ ছাড়া কলেজের টাকায় পরিচালনা কমিটির সভাপতির মোবাইল ফোন কেনা, সম্মানীসহ বিভিন্ন নামে বড় অঙ্কের আর্থিক সুবিধা নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। অন্যদিকে সভাপতি নিজের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ অস্বীকার করে কলেজের অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে ব্যবহারিক পরীক্ষার টাকা নেওয়াসহ আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ তুলেছেন।
অনিয়মের অভিযোগে অধ্যক্ষকে কারণ দর্শানোর নোটিশও দেওয়া হয়েছে। যদিও অধ্যক্ষ বলছেন, তাঁর বিরুদ্ধে যে অভিযোগ করা হয়েছে, তা সত্য নয়। তবে একাধিক শিক্ষক বলেছেন, সভাপতি আসেন সাময়িক সময়ের জন্য, অনিয়ম হয়ে থাকলে এবং তা সামাল দিতে না পারার দায় অধ্যক্ষের ওপরও পড়ে।
পাল্টাপাল্টি এই অভিযোগের মধ্যে কলেজের শিক্ষকদের একটি অংশ অধ্যক্ষের পক্ষে। তবে পরিচালনা কমিটিতে থাকা তিন শিক্ষক প্রতিনিধি সভাপতির পক্ষে। এসব অভিযোগ পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তর এবং জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে জমা দিয়েছেন শিক্ষকেরা। এ বিষয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করে কাজ শুরু করেছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়।
রাজধানীর চানখাঁরপুল এলাকায় অবস্থিত শেখ বোরহানুদ্দীন পোস্ট গ্র্যাজুয়েট কলেজে প্রায় ১০ হাজার শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে। কলেজটিতে শিক্ষক আছেন ১১০ জন।
কলেজটির পরিচালনা কমিটির সভাপতি অধ্যাপক হারুনর রশীদ খান বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য। একাধিক শিক্ষক ও পরিচালনা কমিটির সদস্য বলেন, কলেজের দ্বিতীয় ক্যাম্পাসের জন্য কলেজ থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে কেরানীগঞ্জে ৬ একর জমি কেনার সিদ্ধান্ত নেয় পরিচালনা কমিটি। একটি আবাসন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ইতিমধ্যে ৪৩১ দশমিক ৬৮ শতাংশ (সোয়া চার একরের কিছু বেশি) জমি কেনাও হয়েছে। এ জন্য ১০ কোটির বেশি টাকা খরচ হয়েছে।
অভিযোগ উঠেছে, এই জমি কেনার লেনদেনের বিষয়টি পরিচালনা কমিটির সব সদস্যকে না জানিয়ে অনেকটা সভাপতির চাপে দ্রুততার সঙ্গে করা হয়েছে। কয়েকটি প্লটে কেনা এই জমির মালিকদের কম দাম দিয়ে দলিলে বেশি টাকা দেখানো হয়েছে। একটি দলিল জাল বলে অভিযোগ উঠেছে। সাধারণত সরকারি কেনাকাটায় চেকের মাধ্যমে টাকা দেওয়ার কথা থাকলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নগদে দেওয়া হয়েছে।
শিক্ষকদের অভিযোগ, কলেজের নামে জমি কেনা নিয়ে অনিয়ম হয়েছে।
অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে ব্যবহারিক পরীক্ষার টাকা নেওয়াসহ আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে।
৮৪ কোটি টাকার তহবিল ঘিরে সমস্যা।
সভাপতির বিরুদ্ধে বিভিন্ন নামে আর্থিক সুবিধা নেওয়ার অভিযোগ।
পাল্টা অভিযোগ অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে।
অবশ্য এ বিষয়ে সভাপতি অধ্যাপক হারুন বলেন, নির্ধারিত মূল্যায়ন কমিটির মাধ্যমে সরকারি নিয়মেই জমি কেনা হয়েছে। আর কলেজের একজন শিক্ষক প্রতিনিধি কাছে দাবি করেন, একটি আবাসন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে গড়ে প্রতি শতক জমির দাম ২ লাখ ১৭ হাজার করে নির্ধারণ করা হয়। এখানে হয়তো কোনো জমির দাম পড়েছে তিন লাখের বেশি, আবার কোনো জমির দাম দেড় লাখের মতো। কিন্তু শুধু কম টাকায় কেনা জমি নিয়ে অভিযোগ করা হচ্ছে।
পদাধিকারবলে পরিচালনা কমিটির সদস্যসচিব কলেজের অধ্যক্ষ মো. আবদুর রহমান। তাঁকে বাইরে রেখে জমি কেনার সুযোগ নেই। যদিও অধ্যক্ষের দাবি, সভাপতির চাপে তিনি জমি কিনতে বাধ্য হয়েছেন। তাঁরা চেয়েছিলেন একই প্লটে জমি কিনতে।
কলেজটির পরিচালনা কমিটির সদস্য ও ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান তাসলিমা বেগম কাছে দাবি করেন, জমি কেনার সিদ্ধান্ত পরিচালনা কমিটিতে হলেও কীভাবে লেনদেনটি হয়েছে, সেটি তাঁদের জানানো হয়নি।
অভিযোগ আছে, পরিচালনা কমিটির সভাপতির মোবাইল ফোনসেট কেনার জন্য কলেজ থেকে প্রায় ৮৪ হাজার টাকা নেওয়া হয়। টেলিফোন বিল বাবদও মাসে ৪ হাজার টাকা নেন তিনি। পরিচালনা কমিটির প্রতি সভার জন্য ১২ হাজার টাকা (ভ্যাট বাদে) করে নেন সভাপতি। এর মধ্যে ২ হাজার টাকা যাতায়াত খরচ। অথচ তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকা, পানি ও পরিবেশ বিভাগের শিক্ষক, যে বিভাগের (কার্জন হল) অবস্থান কলেজ থেকে আধা কিলোমিটারের মধ্যে। এরপরও যাতায়াত খরচ নিচ্ছেন। সম্মানীর টাকা পরিচালনা কমিটির অন্য সদস্যরা নিলেও তাঁদের একেকজনের পরিমাণ সভাপতির অর্ধেক।
অধ্যাপক হারুন মোবাইল ফোনসেট কেনা বাবদ টাকা নেওয়ার বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, তাঁর সভাপতি হওয়ার আগেই পরিচালনা কমিটি সভাপতিদের জন্য মোবাইল ফোনসেট দেওয়ার ব্যবস্থা চালু করে। তাঁর আগের সভাপতিও মোবাইল ফোনসেট কেনা বাবদ টাকা নিয়েছেন। সম্মানী নেওয়ার প্রথাও আগে থেকে চলে আসছে।
পরিচালনা কমিটির সভাপতি ও একজন শিক্ষক প্রতিনিধি বলেন, গত এইচএসসি পরীক্ষার সময় রাজধানীর ধানমন্ডির আইডিয়াল কলেজের শিক্ষার্থীদের কেন্দ্র পড়ে তাঁদের কলেজে। সে সময় ব্যবহারিক পরীক্ষার জন্য ওই কলেজ থেকে ৫ লাখ টাকা দেওয়া হয় অধ্যক্ষকে। এ বিষয়ে সভাপতির করা তদন্তে ‘অনিয়ম’ ধরার পরই পরিচালনা কমিটির সভাপতির বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরনের অভিযোগ তোলা হচ্ছে।
যদিও অধ্যক্ষ মো. আবদুর রহমান বলেছেন, নিয়ম মেনেই পরীক্ষার নির্ধারিত ব্যবহারিক ফি ও সরঞ্জাম ক্রয় বাবদ সবার সামনে এই টাকা নেওয়া হয়েছিল। এখান থেকে তিনি কোনো টাকা নেননি।
:প্রথম আলো