জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে (জাবি) সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করে আবাসিক হলগুলো ফাঁকা করে দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তবে এই সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করেছেন আন্দোলনকারীরা। তাঁরা বৃহস্পতিবারের জন্য পরবর্তী কর্মসূচির ঘোষণা দিয়েছেন।
প্রাধ্যক্ষ কমিটির এক জরুরি বৈঠক শেষে বুধবার বিকেল সাড়ে চারটার দিকে ছাত্রছাত্রীদের ১৬টি হলের প্রধান ফটকে তালা ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। পাশাপাশি বন্ধ করে দেওয়া হয় ক্যাম্পাসের সব দোকানপাট। এর আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ কার্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক আবদুস সালাম মিঞাঁ স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে ক্যাম্পাসে সভা-সমাবেশ বন্ধের নির্দেশ দেওয়া হয়।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের এসব পদক্ষেপের বিষয়ে রাত সাড়ে আটটার দিকে উপাচার্যের বাসভবনের সামনে সংবাদ সম্মেলন করেন আন্দোলনকারীরা। সংবাদ সম্মেলনে ঘোষণা দেওয়া হয়, তাঁরা আন্দোলন অব্যাহত রাখবেন। বৃহস্পতিবার দুপুরে প্রশাসনিক ভবনের সামনে থেকে তাঁরা বিক্ষোভ মিছিল বের করবেন। এরপর সন্ধ্যায় উপাচার্যের বাসভবনের সামনে প্রতিবাদী কনসার্ট করা হবে।
বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি নজির আমিন চৌধুরী বলেন, ‘ফারজানা ইসলামকে অপসারণের দাবিতে আমাদের কর্মসূচি চলবে। আমরা হল ছাড়ার নির্দেশ মানছি না। রাতে হলে থাকার জন্য আমরা যাব।’
বিশ্ববিদ্যালয় শাখা সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের (মার্ক্সবাদী) সভাপতি মাহাথির মোহাম্মদ বলেন, ‘আমরা প্রশাসনের এই সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করেছি। এই ভিসি যেহেতু অবৈধ, ফলে তাঁর প্রশাসনের সমস্ত সিদ্ধান্ত অবৈধ। তিনি হল ভ্যাকেন্ট করে সব শিক্ষার্থীকে বের করে দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে নিরাপদে দুর্নীতির স্বর্গরাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে চান।’ তাঁর অভিযোগ, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আন্দোলনরতদের একটি ফেসবুক পেজ হ্যাক করে মিথ্যা তথ্য ছড়াচ্ছে।
এদিকে চলমান এই অচলাবস্থায় ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষের স্নাতক সম্মান প্রথম বর্ষের সব ভর্তি কার্যক্রম অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করা হয়েছে। কেবল অনলাইনে বিষয়ভিত্তিক পছন্দক্রমের ফরম পূরণ আগের নির্দেশনা অনুযায়ী চলবে। বুধবার বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেপুটি রেজিস্ট্রার (শিক্ষা) আবু হাসান স্বাক্ষরিত অন্য একটি বিজ্ঞপ্তিতে এই ঘোষণা দেওয়া হয়।
দিনের অবস্থা
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধের সিদ্ধান্ত অমান্য করে উপাচার্য ফারজানা ইসলামকে অপসারণের দাবিতে বুধবার সারা দিন আন্দোলন অব্যাহত রেখেছেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। তাঁরা ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ-মিছিল, সংহতি সমাবেশ এবং অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছেন। অন্যদিকে ফটকে শতাধিক পুলিশ পাহারায় বসিয়ে উপাচার্য ফারজানা ইসলাম সারা দিন তাঁর বাসভবনে অবস্থান করেন। এদিন তিনি গণমাধ্যমের সঙ্গেও আনুষ্ঠানিক কোনো কথা বলেননি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের চলমান উন্নয়ন প্রকল্প নিয়ে উপাচার্যের ‘মধ্যস্থতায়’ ছাত্রলীগকে বড় অঙ্কের আর্থিক সুবিধা দেওয়ার অভিযোগের তদন্তের দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। ২৩ আগস্ট শুরু হওয়া এ আন্দোলন ১৮ সেপ্টেম্বর উপাচার্যের পদত্যাগ দাবির আন্দোলনে রূপ নেয়। বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যে পদত্যাগ না করায় ২ অক্টোবর থেকে আন্দোলন মোড় নেয় উপাচার্যকে অপসারণের দাবিতে। ১০ দিন উপাচার্যের কার্যালয় অবরুদ্ধ রাখার পর গত সোমবার সন্ধ্যা সাতটা থেকে উপাচার্যের বাসভবনের সামনে অবস্থান নেন আন্দোলনকারীরা। পরদিন ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীরা তাঁদের পিটিয়ে সরিয়ে দেন। এর প্রতিবাদে রাতে হল থেকে বেরিয়ে আসেন শিক্ষার্থীরা। রাত দেড়টা পর্যন্ত উপাচার্যের বাসভবনের সামনে অবস্থান করেন।
এরই ধারাবাহিকতায় বুধবার সকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের দুটি প্রশাসনিক ভবন ও পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের দপ্তর থেকে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বের করে দেওয়ার মাধ্যমে আবারও আন্দোলন শুরু করেন তাঁরা। সকাল সাড়ে ১০টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের মুরাদ চত্বর থেকে একটি বিক্ষোভ মিছিল বের হয়। মিছিলটি ক্যাম্পাস প্রদক্ষিণ করে পুরোনো প্রশাসনিক ভবনের সামনের ‘উপাচার্য অপসারণ মঞ্চে’ গিয়ে অবস্থান নেয়।
সংহতি সমাবেশ
দুপুর ১২টায় উপাচার্যের অপসারণ দাবি, ছাত্রলীগের মারধর ও বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে সংহতি সমাবেশ শুরু করেন আন্দোলনকারীরা। সমাবেশে অংশ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ও মানবিকী অনুষদের ডিন মোজাম্মেল হক বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেন।
অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, উপাচার্য ছাত্রলীগের হামলাকে গণ-অভ্যুত্থান বলেছেন। কিন্তু প্রকৃত গণ-অভ্যুত্থান ঠেকাতে হল বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে শিক্ষার্থীদের পেটানোয় তাঁর নৈতিকতার পূর্ণ অবক্ষয় হয়েছে।
সমাবেশে সংহতি প্রকাশ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক তানজিম উদ্দিন খান বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো প্রশ্নালয়ে পরিণত না হয়ে দুর্নীতিগারে পরিণত হয়েছে। উপাচার্যের অভ্যুত্থানের সংজ্ঞা দেখে তাঁর জ্ঞানের দেউলিয়াত্ব প্রকাশ পেয়েছে। গোপালগঞ্জ, পাবনা ও বুয়েটের পর জাহাঙ্গীরনগরে দেখা গেল ক্ষমতাসীনেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে কীভাবে পশুত্বালয়ে পরিণত করেছে।
সমাবেশ শেষে বিকেল সাড়ে চারটার দিকে পুরোনো প্রশাসনিক ভবনের সামনে থেকে আবার বিক্ষোভ মিছিল বের করেন আন্দোলনরতরা। মিছিলটি উপাচার্যের বাসভবনসংলগ্ন সড়কে গিয়ে শেষ হয়। পরে সেখানে তাঁরা অবস্থান নিয়ে উপাচার্যের অপসারণের দাবিতে স্লোগান দিতে থাকেন, যা রাত সাড়ে আটটায় সংবাদ সম্মেলনের মধ্য দিয়ে শেষ হয়।
আবাসিক হল ফাঁকা
অনির্দিষ্টকাল বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণার পর আবাসিক হলগুলো ফাঁকা হয়ে গেছে। মঙ্গলবার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বিকেল সাড়ে পাঁচটার মধ্যে শিক্ষার্থীদের হল ছাড়ার নির্দেশ দেয়। সোমবার রাতের মধ্যে অধিকাংশ ছাত্রী হল ছাড়েন। তবে নির্দেশনা অমান্য করে শিক্ষার্থীদের একটি অংশ ক্যাম্পাসে অবস্থান করতে থাকে।
এই অবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাধ্যক্ষ কমিটি বুধবার বেলা একটার মধ্যে হল ফাঁকা করার নির্দেশ দেয়। শিক্ষার্থীরা এ নির্দেশ অমান্য করে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। এরপর জরুরি বৈঠকে বসে প্রাধ্যক্ষ কমিটি। সভা শেষে বেলা আড়াইটায় প্রাধ্যক্ষ কমিটির সভাপতি বশির আহমেদ জানান, বেলা সাড়ে তিনটার মধ্যে হল না ছাড়লে তল্লাশি চালানো হবে। এ-সংক্রান্ত লিখিত আদেশ আবাসিক হলগুলোর নোটিশ বোর্ডে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। সাড়ে চারটার দিকে হলগুলোর প্রধান ফটকে তালা ঝুলিয়ে দেয় প্রশাসন। পরে পাঁচটা নাগাদ হলগুলো শিক্ষার্থীশূন্য হয়ে পড়ে।
প্রাধ্যক্ষ কমিটির সভাপতি বশির আহমেদ জানান, হল-সংলগ্ন দোকানপাট পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত বন্ধ রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। যেসব হলের তালা আন্দোলনকারীরা ভেঙে ফেলেছেন, তা দ্রুত মেরামত এবং এ-সংক্রান্ত প্রাথমিক প্রতিবেদন দিতে হল প্রশাসনকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। প্রতিটি হলে সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপনের বিষয়টি নিশ্চিত করতে গাণিতিক ও পদার্থবিষয়ক অনুষদের ডিন অজিত কুমার মজুমদারকে আহ্বায়ক করে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে।
:প্রথম আলো